চাঁদপুর নিউজ ==
বাবা-মার ইচ্ছা ছিলো ছেলে অনার্স-মাস্টার্স পাস করার পর বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে অফিসার হবে। বাবা-মার সে স্বপ্ন পূরণ হলো না। পুলিশের নির্মম গুলিতে অকালে প্রাণ হারাতে হয়েছে চাঁদপুর সদর উপজেলার ১২নং চান্দ্রা ইউনিয়নের পূর্ব বাখরপুর গ্রামের হাজী কোব্বাত আলী পাটওয়ারী বাড়ির অবসরপ্রাপ্ত সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হাজী আনোয়ার উল্লা পাটওয়ারীর ৪র্থ ছেলে তাজুল ইসলাম রতন (২৬)।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে চাঁদপুর শহরে অবরোধের সমর্থনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের মিছিলে পুলিশের গুলিতে চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে সদ্য মাস্টার্স পাস করা মেধাবী ছাত্র রতন নিহত হয়। কলেজে পড়ার কারণে ৬ বছর যাবৎ চাঁদপুর শহরে থাকতেন রতন। সরকারি কলেজের জিয়া ছাত্রাবাসে থেকে রতন ২০১৩ সালে ম্যানেজমেন্টে অনার্স-মাস্টার্স পাস করেন। এখানে থেকেই তিনি চাকুরির চেষ্টা করে আসছিলেন। পাশাপাশি বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তাজুল ইসলাম রতন জিয়া ছাত্রাবাস শাখা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক বলে তার সহপাঠীরা জানায়।
সন্তান হারানো শোকে এখন বাকরুদ্ধ পিতা আনোয়ার উল্লাহ ও মা রওশন আরা। গতকাল দুপুরে সরজমিনে নিহত রতনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে আছেন পিতা আনোয়ার উল্লাহ পাটওয়ারী। বাড়ির পেছনে পুকুর ঘাটলায় আহাজারি করছেন মা রওশন আরা ও আত্মীয়স্বজন। তাদেরকে সান্ত্বনা দিতে উপস্থিত প্রতিবেশীরা। এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় রতনের বাবা-মার। তারা জানান, সোমবার সন্ধ্যায় মা রওশন আরা ছেলের মোবাইলে ফোন করে জানতে চান, বাবা তুমি কোথায়? উত্তরে রতন মা�কে বলেছিলো সে হোস্টেলে আছে। মার সাথে ছেলে রতনের এ কথাই ছিলো শেষ। বৃদ্ধ বাবা আনোয়ার উল্লাহ জানান, তার ৫ ছেলে ২ মেয়ে। ২ ছেলে প্রবাসী। তিনি পূর্ব বাখরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সেখান থেকে অবসর নিয়ে বাড়িতেই আছেন। ২ ছেলে রতন ও সাদ্দাম চাঁদপুরে লেখাপড়া করে। রতন মাস্টার্স পাস করেছে। ছোট ছেলে মমিনুল ইসলাম সাদ্দাম (২২) অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। সে বাড়ি থেকেই কলেজে আসা-যাওয়া করে। রতন ছাত্র রাজনীতিতে বিএনপির সমর্থক ছিলো বলে তার বাবা জানান। মাস্টার্স পাস করার পর চাঁদপুর কলেজ ছাত্রাবাসে থেকেই চাকুরির জন্য নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়েছিলো রতন। বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ছেলে রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলো, তবে মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না।
চাঁদপুর নিউজ ====
বাবার সাথে ছেলে রতনের শেষ কথা হয়েছিল যেভাবে�
প্রবাসে থাকা দু�ছেলে বাড়ির জন্য কিছু টাকা পাঠিয়েছিলো। ঐ টাকা উত্তোলনের জন্য বাবা আনোয়ারুল্লাহ সোমবার বিকেলে ফোনে কথা বলেন ছেলে রতনের সাথে। রতন বাবাকে বলেছিলো, ছোট ভাই সাদ্দামকে মঙ্গলবার সকালে চাঁদপুর পাঠিয়ে দিতে। রতন ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে রেখেছে। ছোট ভাই সাদ্দাম আসলে রতন সে টাকা তার কাছে দিয়ে দেবে। এটাই ছিলো বাবার সাথে নিহত রতনের শেষ কথা।
কথা অনুযায়ী গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টায় বড় ভাই রতনের কাছ থেকে টাকা আনার জন্য সাইকেলযোগে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সাদ্দাম। সাদ্দাম চাঁদপুর পৌঁছছে কি-না তা জানার জন্যে বাবা আনোয়ারুল্লাহ সকাল সাড়ে ১০টায় ছেলে রতনের মোবাইলে ফোন করে। তখন রতনের মোবাইল অন্যজন রিসিভ করে জানায়, চাঁদপুর শহরের কালীবাড়িতে গণ্ডগোল হয়েছে। রতন হাসপাতালে। কিছুক্ষণ পর রতনের ঐ মোবাইল থেকে ফোন করে তার বাবাকে জানানো হয়, রতনের গায়ে গুলি লেগে সে মারা গেছে। এ খবর শোনামাত্র বাবা আনোয়ার উল্লাহ বাকরুদ্ধ হয়ে লাঠি ভর ছাড়াই ঘর থেকে বের হন চাঁদপুর যাবার জন্য। চান্দ্রা বাজার আসলে দেখেন দোকানে টিভি চলছে। খবর দেখা ও শোনার জন্য অনেক মানুষের ভিড়। তিনিও তাদের সাথে দাঁড়িয়ে খবর দেখছেন। খবরে বলছে রতনসহ চাঁদপুরে গুলিতে দু�জন নিহত। তখন তিনি নিশ্চিত হন তার আদরের ধন রতন আর নেই। বাকরুদ্ধ হয়ে ছেলেকে এক নজর দেখার জন্যে চাঁদপুর আসতে গাড়ি খুঁজছেন। অবরোধের কারণে গাড়ি না পাওয়ায় চাঁদপুর আসা হয়নি। বাজারের লোকজন সান্ত্বনা দিয়ে রতনের বাবাকে বাড়ি নিয়ে আসে। সন্ধ্যা পর্যন্ত অসহায় বাবা-মা ছেলের মুখ দেখতে পায়নি। ময়না তদন্ত শেষে যখন লাশ বাড়িতে নিয়ে যায় তখন সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। রতনের মা-বাবা, ভাই-বোনসহ সবাই আহাজারি করছে। তাদের আর্তচিৎকারে সেখানকার পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। তাজুল ইসলাম রতন গ্রামের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে, এমনকি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের কাছেও খুবই পরিচিত মুখ ছিলো। সবাইকে এক বাক্যে বলতে শোনা গেছে, রতন যেমন মেধাবী ছাত্র ছিলো, তেমনি ন�্র, ভদ্র ও বিনয়ী ছিলো। কোনো ধরনের অপরাধের ছাপ তার মধ্যে ছিলো না। এভাবে একজন নিরীহ , ভদ্র ছাত্র নেতাকে গুলি করে হত্যা করা চান্দ্রা ইউনিয়নবাসী মেনে নিতে পারছে না। নিহত রতনের বাবা-মা তাদের সন্তান হত্যার বিচার চায়।