ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি-
সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীদের ২০ লাখ টাকা কাঠ ব্যবসায়ীর ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎ ঠিকাদারের ১ লাখ টাকা ছিনতাই পুলিশ পিটানো ও ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রকাশ্যে হুমকির অভিযোগ বিতর্কিত আইনজীবী আনোয়ার গাজী বহু অভিযোগে এ যাবৎ পাঁচ বার জেল হাজত খেটেছেন বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে। পুরাণবাজারের সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীদের মালামালের ২০ লাখ টাকা আত্মসাৎ, শহরের ৫নং কয়লাঘাট এলাকার বিশিষ্ট কাঠ ব্যবসায়ী বীর মুক্তিযোদ্ধার ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎ, তালতলা নিবাসী তরুণ ঠিকাদারের ১ লাখ টাকা ছিনতাই, ২০-২৫জন পুলিশের সামনে কর্মরত পুলিশ কনস্টেবলকে বেদম পিটিয়ে রক্তাক্ত করা, প্রকাশ্য বিচারাদালতে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে হুমকি দেয়ার মতো ঘটনায় পৃথক ৫টি মামলায় আনোয়ার গাজী এ যাবৎ ৫বার জেল হাজত খাটেন। আইনজীবী হওয়ার পূর্বে ৩বার এবং আইনজীবী হওয়ার পর ২বারসহ মোট ৫বার। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আনোয়ার গাজী প্রতিবারই মামলার আরজি অনুযায়ী ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর কখ
নো ঘটাবে না মর্মে বিশেষ শর্তে লিখিতভাবে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেলেও বার বারই শর্ত ভঙ্গ করে একের পর এক দুষ্কর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। তার এহেন আইনবিরোধী কর্মকাণ্ডে সাধারণ জনমনে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আইনজীবী আনোয়ার গাজীর জন্য বাংলাদেশে বোধ হয় কোনো আইন নেই। এমনকি চাঁদপুর জেলা আইনজীবী সমিতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলও তার অপ্রতিরোধ্য অবৈধ ও বেআইনি কর্মকাণ্ড এতটুকু ঠেকাতে পারছে না। যদিও চাঁদপুর জেলা আইনজীবী সমিতি তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিধিসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও সে এসবের কোনো কিছুরই এতটুকু তোয়াক্কা করছে না। তার অন্যায় ক্ষমতা নিয়ে সচেতন জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
একটি সূত্র জানায়, আনোয়ার গাজী মূলতঃ ছোটবেলা থেকেই উচ্ছৃঙ্খল ধরনের। সে ছোটবেলা থেকেই কাউকে কোনো তোয়াক্কা করতো না। তার হীন স্বার্থে তিনি মানবতাবিরোধী যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারেন। নব্বই দশকের প্রথম দিকে তিনি পুরাণবাজারের বেশকিছু সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীর সাথে ভুষা মালের ব্যবসা শুরু করেন। বিভিন্ন হিন্দু ব্যবসায়ীর নৌকায় করে আনা বিভিন্ন মালামাল তিনি পুরাণবাজার ঘাট থেকেই তার সংঘবদ্ধ দলবলসহ জোর করে ভয়-ভীতি দেখিয়ে আড়ত-গদিঘরে নিয়ে যেতেন। এক্ষেত্রে মালামালের মূল্য যদি ১ লাখ টাকা হতো তাহলে সে ব্যবসায়ীকে মাত্র ১০ হাজার টাকা দিতেন। বাকি টাকা মাল বিক্রি করে পরে দেয়া হবে বলে বিদায় করে দিতেন। কিন্তু মাল বিক্রি করে তিনি আর কোনো টাকা দিতে চাইতেন না। পাওনাদারকে দীর্ঘদিন দেই-দিচ্ছি করে ঘুরিয়ে শেষে আরও ১০ হাজার টাকা হাতে দিয়ে মাল খারাপ ছিলো বলে তার পালিত সন্ত্রাসীদের দিয়ে জীবননাশের ভয়-ভীতি দেখিয়ে বিদায় করে দিতেন। এভাবে তিনি পুরাণবাজারের বেশ ক’জন সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীর ২০ লাখ টাকা সহজেই হাতিয়ে নিয়ে আত্মসাৎ করেন। এসব ঘটনা তৎকালীন চাঁদপুর জেলার একাধিক গোয়েন্দা বিভাগে রেকর্ডভুক্ত হয় এবং এ ব্যাপারে সে সময় মামলা হলে তিনি দীর্ঘদিন জেলহাজত খাটেন। মোদ্দা কথা, সে সময় পুরাণবাজারের হিন্দু ব্যবসায়ীরা তার অত্যাচার ও জুলুম-নির্যাতনের ভয়ে স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেনি। অনেকে আবার ভয়ে ব্যবসা গুটিয়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন। এ নিয়ে পুরাণবাজারের তৎকালীন ব্যবসায়ী মহলে আনোয়ার গাজীর বিরুদ্ধে অনেক বিচার-আচার ও দেন-দরবার হয়। অতঃপর তার অভিভাবকরা বাধ্য হয়ে তাকে সৌদি আরবে কর্মসংস্থানের জন্য পাঠালে তিনি সেখানে ব্যাপক মাদকাসক্তির কাজে লিপ্ত হন। এক পর্যায়ে তাদের সাথে আনোয়ার গাজী নেশার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ব্যাপক মারামারি করে সৌদি সরকারের মামলা খেয়ে জীবন নিয়ে বাংলাদেশে ফেরৎ চলে আসতে বাধ্য হন।
সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালের দিকে শহরের ৫নং কয়লাঘাট এলাকার বিশিষ্ট কাঠ ব্যবসায়ী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ শাহজাহান মিয়ার সাথে ভালো মানুষ সেজে যৌথভাবে কাঠের ব্যবসা শুরু করেন আনোয়ার গাজী। বেশ কিছুদিন যৌথভাবে ব্যবসা করার পর উপযুক্ত প্রমাণপত্রের ভিত্তিতে শাহজাহান মিয়া আনোয়ার গাজীর কাছে ৩০ লাখ টাকা পাওনা হন। কিন্তু দেই-দিচ্ছি করে তিনি শাহজাহান মিয়াকে ঘুরাতে থাকেন। এ ব্যাপারে শাহজাহান মিয়া চেয়ারম্যান সাহেবকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার না পাওয়ায় তিনি আদালতের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হন। মামলায় সরাসরি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে চাঁদপুর থানা পুলিশ আনোয়ার গাজীকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠায় এবং তিনি দীর্ঘদিন জেল হাজত খাটেন। পরে কিসত্দিতে টাকা দেয়ার শর্তে জামিন নিলেও আনোয়ার গাজী টাকা ফেরৎ না দিয়ে দীর্ঘদিন গা ঢাকা দিয়ে পালিয়ে থেকে পুরো ৩০ লাখ টাকাই আত্মসাৎ করেন। এর ফলে বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়া কাঠ ব্যবসায় মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হন এবং পারিবারিকভাবে আর্থিক সংকটে পড়ে মানবেতর জীবন-যাপন করতে বাধ্য হন।
সূত্র আরও জানায়, ১৯৯৬ সালে চাঁদপুর শহরের কুমিল্লা রোডস্থ তালতলা নিবাসী তরুণ ঠিকাদার খোকন পরিবারের প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে ১ লাখ টাকা তুলে বাসায় ফেরার পথে মাদকাসক্ত অবস্থায় আনোয়ার গাজী টাকার ব্যাগসহ ১ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যান। এ ব্যাপারে চাঁদপুর থানায় আনোয়ার গাজীর বিরুদ্ধে ১ লাখ ছিনতাইয়ের মামলা হলে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। তিনি পুলিশের ভয়ে দীর্ঘদিন পালিয়ে বেড়ান এবং কোনো একটি কাজের প্রয়োজনে গোপনে শহরের স্ট্র্যান্ড রোডে এলে এলাকাবাসীসহ ঠিকাদার খোকন তাকে দেখতে পেয়ে ধরার জন্য ধাওয়া করেন। তিনি জনতার রোষানল ও গ্রেফতার এড়ানোর ভয়ে দৌড়ে চৌধুরীঘাটের দিকে পালাতে থাকলে একপর্যায়ে জীবন বাঁচাতে ডাকাতিয়া নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে নদী পার হতে গেলে জনতা চতুর্দিক থেকে দ্রুত নৌকা নিয়ে তাকে ঘিরে ফেলে নদী থেকে তাকে উঠিয়ে পিটুনি দেয়। পরে থানায় খবর দিয়ে জনতা পুলিশের হাতে তাকে তুলে দেয়। অতঃপর পুলিশ তাকে কোর্টে চালান দিলে বিজ্ঞ বিচারক তার জামিন নামঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়। এ মামলায় তিনি ১৭ দিন জেলহাজত খেটে টাকা ফেরৎ দেয়ার শর্ত সাপেক্ষে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান। অবশ্য সামাজিক ও আইনের চাপে আনোয়ার গাজী ঠিকাদার খোকনকে পুরো ১ লাখ টাকা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন। গতকাল ৯অক্টোবর বুধবার দুপুরে ঠিকাদার খোকন তার বাসায় অসুস্থ শরীরে সাংবাদিকদের কাছে এ তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করেন। এক পর্যায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়া ও ঠিকাদার খোকনের সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন ছিল, একজন চিহ্নিত জেল হাজতখাটা প্রতারক ও জেল হাজতখাটা ছিনতাইকারী আইনজীবী হয় কীভাবে?
অপর একটি সূত্র জানায়, গত বছর চাঁদপুর সদর জিআরও কোর্টে কর্মরত পুলিশ কনস্টেবল মোঃ হুমায়ুন কবিরকে ২০-২৫জন পুলিশের সামনে আনোয়ার গাজী বেধড়ক পিটিয়ে মারাত্মক রক্তাক্ত জখম করে হাসপাতালে পাঠান। ঘটনার সময় উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা আনোয়ার গাজীকেও ধরে ব্যাপক উত্তম-মধ্যম দিয়ে ধোলাই করে। পুলিশের পিটুনি খেয়ে আনোয়ার গাজীর মুখমণ্ডল ফুলে যায় এবং সেই সাথে প্যান্ট-শার্টও ছিঁড়ে যায়। এক পর্যায়ে পুলিশ তাকে টেনে-হেঁচড়ে সিএসআই’র কৰে নিয়ে মাটিতে অর্থাৎ ফ্লোরে বসিয়ে দীর্ঘক্ষণ আটক রাখে। তুলোধুনা খাওয়া আনোয়ার গাজীর কাছে তখন মনে হয়েছিল, ‘সারাজীবন আমি নিজের হাতে বহু মানুষকে পিটিয়েছি, আসলেই-তো মাইরের ওপর কোন ঔষধ নাই’। পরে গ্রেফতার এড়াতে তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের বুদ্ধি-পরামর্শে প্রচণ্ড প্রস্রাবের বেগের ভান করে তার পছন্দসই আইনজীবীদের সাথে নিয়ে আনোয়ার গাজী টয়লেটে যাওয়ার নাম করে টয়লেটের পেছন দিক দিয়ে ময়লা-আবর্জনার মধ্য দিয়ে কোনো রকমে জীবন হাতে নিয়ে দ্রুত দৌড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। দীর্ঘদিন তিনি গা ঢাকা দিয়ে পালিয়ে থাকেন। এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। পরে গোপনে পালপাড়ার বাসায় এলে এবং ট্রাকরোডস্থ মিশন রোডের মাথা থেকে চাঁদপুর মডেল থানা পুলিশের বেশ কিছু সংখ্যক সদস্য আনোয়ার গাজীকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসে এবং পুলিশ ওইদিনই তাকে কোর্টে চালান দিলে বিজ্ঞ বিচারক তার জামিন নামঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়। চাঞ্চল্যকর এ মামলায় বিতর্কিত আইনজীবী আনোয়ার গাজী দীর্ঘ সাড়ে ৩ মাস জেল হাজত খাটেন। এ মামলায় বিশেষ শর্তে লিখিতভাবে মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে জেলগেটে দাঁড়িয়ে তাকে গ্রেফতার অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া চাঁদপুর মডেল থানার এক এসআইকে, একজন সিনিয়র আইনজীবীকে ও একজন সিনিয়র সাংবাদিককে প্রকাশ্যে হত্যা করার মোবাইলে হুমকি দিলে তারা প্রত্যেকে তার বিরুদ্ধে সাথে সাথে চাঁদপুর মডেল থানায় জিডি এন্ট্রি করেন।
সূত্র জানায়, সর্বশেষ গত ৭অক্টোবর দুপুরে চাঁদপুর মডেল থানার একদল পুলিশ বিতর্কিত আইনজীবী আনোয়ার গাজীকে তার চেয়ারম্যানঘাটস্থ ‘টর্চার সেল’ নামক চেম্বার থেকে মাদকাসক্ত অবস্থায় গ্রেফতার করে। চাঁদপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অসীম কুমার দেকে প্রকাশ্যে হুমকি, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, সরকারি কর্মকর্তাকে আক্রমণ ও মামলার নথি ছিনিয়ে নেয়া সংক্রান্ত মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানার ভিত্তিতে আনোয়ার গাজীকে গ্রেফতার করে চাঁদপুর মডেল থানায় নিয়ে আসে। ওইদিনই তাকে কোর্টে চালান দেয়া হলে বিজ্ঞ বিচারক তার জামিন নামঞ্জুর করে চাঁদপুর জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়। বর্তমানে তিনি সেখানেই রয়েছেন।