অবশেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ প্রাপ্তির শর্ত হিসেবে এর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। বহুজাতিক সংস্থাটির নির্দেশিত হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ এখন ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন (২ হাজার ৩৫৭ কোটি) ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গতকাল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রিজার্ভের এ পরিসংখ্যান উঠে আসে।
তবে আইএমএফ নির্দেশিত হিসাবের পাশাপাশি নিজস্ব পরিসংখ্যানও প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেখা যায়, ১২ জুলাই দেশের গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর আইএমএফ নির্দেশিত হিসাব (বিপিএম৬) অনুযায়ী, রিজার্ভের পরিমাণ ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত মানদণ্ড অনুসরণ করতে গিয়ে এক ধাক্কায় দেশের রিজার্ভ কমেছে ৬৪০ কোটি ডলার।
২০১২ সাল থেকে আইএমএফের সদস্য দেশগুলো ব্যালান্স অব পেমেন্টস এবং ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম৬) অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাবায়ন করে আসছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক তা শুরু করতে সময় নিয়েছে আরো প্রায় এক যুগ। তবে বিপিএম৬ মূলনীতি অনুযায়ী হিসাব করা রিজার্ভও বাংলাদেশের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভ নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নিট রিজার্ভ হিসাবায়নের ক্ষেত্রে আইএমএফ থেকে নেয়া এসডিআরসহ স্বল্পমেয়াদি বেশকিছু দায় বাদ দেয়া হয়। সে হিসাবে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভের পরিমাণ এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দিন থেকে আইএমএফের সুপারিশ অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাবায়ন শুরু হবে বলে গত মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। যদিও সে সময় গণমাধ্যম কর্মীদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকই নিট রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করে না। বাংলাদেশ ব্যাংকও সেটি করবে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘১ জুলাই থেকে আইএমএফের বিপিএম৬ গাইডলাইন অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাবায়ন শুরু হয়েছে। এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবায়নের পাশাপাশি আইএমএফের সুপারিশকৃত রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করা হবে। তবে নিট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করা হবে না।’
ডলার সংকট কাটাতে আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণপ্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার ছাড় দিয়েছে সংস্থাটি। তবে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে বেশকিছু শর্ত পরিপালন করতে হবে বাংলাদেশকে। এর মধ্যে অন্যতম শর্ত হলো ৩০ জুনের মধ্যে বিপিএম৬ মূলনীতি অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের এ শর্ত পরিপালন করতে পেরেছে বলে জানা গেছে। তবে এজন্য জুনের শেষ সপ্তাহে বাজার থেকে ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ৩০ জুন বিপিএম৬ মূলনীতি অনুযায়ী দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করা হয়। এতে বিপিএম৬ মূলনীতি অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ ২৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিসংখ্যান নিয়ে অনেক আগে থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছে আইএমএফ। সংস্থাটির সুপারিশ ছিল, রিজার্ভের হিসাবায়ন করতে হবে বিপিএম৬ মূলনীতি অনুসরণ করে। এক্ষেত্রে রফতানি উন্নয়ন তহবিলসহ (ইডিএফ) বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা প্রায় সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে বাদ দিতে হবে। আইএমএফের শর্ত মেনেই শেষ পর্যন্ত গতকাল রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করা হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ৭ বিলিয়ন ডলারের ইডিএফ তহবিল এখন ৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। এ কারণে আইএমএফের শর্ত পূরণ করা কিছুটা সহজ হয়েছে। বিপিএম৬ মূলনীতি অনুযায়ী হিসাবায়নের ক্ষেত্রে রিজার্ভের অর্থে গঠন করা গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ডে (জিটিএফ) ২০ কোটি, লং টার্ম ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (এলটিএফএফ) তহবিলে ৩ কোটি ৮৫ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে দেয়া ৬৪ কোটি ডলার ও বাংলাদেশ বিমানকে দেয়া ৪ কোটি ৮০ লাখ এবং শ্রীলংকাকে ২০ কোটি ডলারসহ মোট ৬৪০ কোটি ডলার বাদ দেয়া হয়েছে।
রিজার্ভের ন্যূনতম মানদণ্ড হলো কোনো দেশের অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় বহনের মতো সক্ষমতা থাকা। চলতি বছরের মে মাসে দেশের মোট আমদানি ছিল ৬৪৬ কোটি ডলার। মে মাসের আমদানি আমলে নিলে ২৩ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ দিয়ে প্রায় চার মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করা সম্ভব হবে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শর্ত ও কঠোরতার কারণে দেশের আমদানি বাণিজ্য সংকুচিত হয়ে এসেছে। এ কারণে বাজারে বেশির ভাগ আমদানি পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। অনেক পণ্যের সরবরাহও কমে এসেছে। অর্থনীতিকে স্বাভাবিক করতে হলে আমদানির ওপর বিধিনিষেধ তুলে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রতি মাসে গড় আমদানির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপও বাড়বে। সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় শিগগিরই রিজার্ভের ওপর থেকে চাপ কমবে না বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাজার থেকে ডলার কিনে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের শর্ত পূরণ করেছে। ৩০ জুন বিপিএম৬ মূলনীতি অনুযায়ী দেশের রিজার্ভের যে পরিমাণ ছিল, সেটি আইএমএফের শর্ত পূরণ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এটি একদিক থেকে ভালো সংবাদ। আইএমএফ জানল, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার শর্ত পূরণের জন্য আন্তরিক। তবে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হয়নি। এটি সরকারের জন্য ভালো খবর নয়।’
রিজার্ভকে সুসংহত রাখতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডলার বিক্রি বন্ধ করতে হবে বলে মনে করেন ড. আহসান এইচ মনসুর। এ অর্থনীতিবিদের ভাষ্য হলো ‘ডলারের বিনিময় হারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। গত অর্থবছরের পুরো সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে। এখন আর নতুন করে ডলার বিক্রি করা যাবে না। আমরা দেখতে চাই, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিনিময় হার ও রিজার্ভকে স্থিতিশীল রাখতে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
দুই দশক ধরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ঊর্ধ্বমুখী। ২০১৬ সালের ৩০ জুন রিজার্ভের গ্রস পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। এরপর ২০১৯ সালের শেষ পর্যন্ত রিজার্ভ ছিল কিছুটা স্থিতিশীল। ২০২০ সালে কভিড-১৯-এর প্রভাবে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়। রিজার্ভের পরিমাণও দ্রুতগতিতে বেড়ে যায়। ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। তবে এর পর থেকে ক্রমেই রিজার্ভের পরিমাণ কমেছে। শুধু ২০২২-২৩ অর্থবছরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে ৬৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। আর পণ্য রফতানি হয়েছে ৪৭ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের। অর্থবছরের ১১ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে ৮ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার।