বর্তমান আন্ত সংযুক্ত বিশ্বে ইউক্রেন খুব দূরের জায়গা নয়। পৃথিবীতে এখন যে ধরনের আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগ আছে, সেখানে যেকোনো রাষ্ট্রে অস্থিতিশীলতা বা সংঘাত হলে তার সরাসরি প্রভাব অন্যান্য দেশেও এসে পড়ে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এ কারণে আমাদেরও পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে হবে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের কারণে এই মুহূর্তে অন্তত ১০ ধরনের বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়তে যাচ্ছে বলে আমরা ধারণা করতে পারি।
এক. জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি আমদানিনির্ভর দেশ। এই সংঘাতের কারণে তেলের বাজার সম্পূর্ণভাবে অস্থিতিশীল হয়ে গেছে। দ্রুতই দাম বাড়ছে। গতকালই প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারে পৌঁছেছে। এই দাম আরো বাড়ার আশঙ্কা আছে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও চাপ বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর পড়বে।
দুই. পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র বাস্তবায়িত হচ্ছে। যদি রাশিয়া ও রাশিয়ার বিভিন্ন সংস্থা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় চলে আসে তাহলে আমাদের পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।
তিন. বিশ্বের সরবরাহব্যবস্থা বিনষ্ট হয়ে যাবে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। আমরা জানি, আমাদের তৈরি পোশাক খাত রপ্তানির ওপর নির্ভর করে। এটি খুব টাইম সেনসেটিভ (সময়নির্ভর)। অর্থাৎ কোথাও পণ্য পাঠাতে এক সপ্তাহ দেরি হলে তারা বাজার ধরতে পারে না। সে ক্ষেত্রে সরবরাহব্যবস্থায় প্রভাব বা ভেঙে পড়ার কারণে আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা আছে।
চার. বিশ্বের গম রপ্তানির বড় অংশই আসে রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশ অঞ্চল থেকে। ফলে গমের রপ্তানি বাজার পুরোপুরি বিঘ্নিত হবে। সাময়িকভাবে রপ্তানি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। তার কারণে খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ কমে গেলে খাদ্যের দাম বাড়বে। এ কারণে আমরা আশঙ্কা করছি, খাদ্য নিরাপত্তার ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশ গম আমদানিকারক শীর্ষ দেশগুলোর অন্যতম না হলেও আমদানি করে। খাদ্যমূল্যের ওপর চাপ এলে এর প্রভাব অন্য পণ্যের ওপরও পড়বে। গমের দাম বাড়লে চালের দামও বেড়ে যাবে।
পাঁচ. আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজার পুরোপুরি অস্থির হয়ে গেছে। মুদ্রা বিনিময়ের হার বেড়ে যাচ্ছে। এর যে অর্থনৈতিক চাপ, তা আমাদের ওপর পড়া শুরু করবে। একই সঙ্গে আমরা দেখতে পাব, আন্তর্জাতিক চলাচল, পণ্য স্থানান্তর, আমদানি-রপ্তানি—সব কিছুর সঙ্গে বীমা অনেক গুণ বেড়ে যাবে। এর ফলে পণ্যের দামের ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে। অর্থনীতি, বিশেষ করে ভোগ্যপণ্যের ওপর চাপ বেশি হবে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির প্রবণতা বেড়ে যাবে।
ছয়. ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বর্তমান যে বৈশ্বিক ধারা, তা সম্পূর্ণভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেল। অর্থাৎ বৃহৎ রাষ্ট্র দ্বারা পরিবেষ্টিত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো কিভাবে তাদের নিরাপত্তা বজায় রাখবে, সেটি এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেবে। ছোট রাষ্ট্রের জন্য অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি হলো। এটি শুধু ইউক্রেনের জন্য নয়, বিশ্বের যেকোনো জায়গায় যে কারো বেলায় এটা ঘটার পথ তৈরি হলো।
সাত. এবার আমরা প্রচলিত যুদ্ধ ছাড়াও বিভিন্ন পন্থা দেখতে পাচ্ছি, যা বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ এবং একই সঙ্গে শিক্ষণীয়। অভিযান শুরুর আগে ও সঙ্গে সঙ্গে সাইবার হামলা চালিয়ে ইউক্রেনের সব সাইবারব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে। একইভাবে অভিযানের আগে রাশিয়ার পক্ষ থেকে বড় ধরনের ডিজ-ইনফরমেশন ক্যাম্পেইন বা কুতথ্যের প্রচারণা দেখতে পেয়েছি। এগুলো থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
আট. কূটনৈতিকভাবে বর্তমান বিশ্বে যে বিভাজন আছে, তা আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। সেখানে দুই দিক থেকেই আমাদের ওপর চাপ আসতে পারে। এই চাপ পক্ষে কথা বলার জন্য। কূটনৈতিক মন্তব্য করার ক্ষেত্রেও এই চাপ বোধ হতে পারে। জাতিসংঘে ভোটের ক্ষেত্রেও হতে পারে। অর্থাৎ কূটনৈতিক চাপের চ্যালেঞ্জের মুখে আমরা পড়তে যাচ্ছি।
নয়. বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী, বিশেষ করে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কাছে রাশিয়ার তৈরি সামরিক সরঞ্জাম আছে। যেমন আমাদের মিগগুলো রাশিয়ার তৈরি। আমাদের হেলিকপ্টারবহরের অনেকগুলোই রাশিয়ার তৈরি। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা আটটি ‘অ্যাটাক হেলিকপ্টার’ কিনেছি রাশিয়ার কাছ থেকে। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং এগুলোকে ভবিষ্যতে চলমান রাখাও চ্যালেঞ্জের মুখে, অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যেতে পারে, যদি রাশিয়ার ওপর ব্যাপক আকারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
দশ. আশঙ্কা করছি, আরেকটি নতুন ধারার। একটি দেশের বা একটি অঞ্চলের সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে বাইরের কোনো দেশ থেকে এমনভাবে অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া, যাতে তারা দেশটির সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। আর তাদের মাধ্যমে অনেক ধরনের বহিরাক্রমণ শুরু হয়। এটি রাশিয়া-ইউক্রেনের ঘটনায় আমরা পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছি।
আমাদের করণীয় কী
যুদ্ধের দুই পক্ষ থেকেই সমর্থন চেয়ে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। এখানে আমাদের খুব সতর্কভাবে এগোতে হবে, যাতে আমরা কোনোভাবেই কোনো পক্ষের সঙ্গে না মিলে যাই। আমাদের যে কৌশলগত নিরপেক্ষতা আছে বা আমরা রাখছি, তাকে যেকোনো মূল্যে বজায় রাখতে হবে। আমরা কোনো সংঘাতের পক্ষ নিতে চাই না। আমরা বিশ্বাস করি, একটি দেশ যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তার সার্বভৌমত্ব কোনোভাবেই অন্য দেশের ক্ষুণ্ন করা উচিত নয়।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান, প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ