মানবতা দীপ্ত, ঐতিহ্যানুসারী, প্রাগ্রসর চেতনাসম্পন্ন, মুরশীদে কামেল, আলহাজ্ব হযরত মাওলানা মোবারক করিম (রহঃ) প্রতিভার ঔজ্জ্বল্যে, নিষ্ঠার ঐকান্তিকতায়, মননশীল গবেষণায়, সমকালের মূল্যবোধে ও পীড়িত সমাজ প্রেক্ষাপটে এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। শৈশব কাল হতেই তাঁর কাজ-কর্মে ভবিষ্যতে এক মহা মনীষীতে রূপান্তরিত হওয়ার পূর্বাভাস দেখা দিয়েছিলো। বিশেষ করে ক্বারী ইব্রাহীম (রহঃ)-এর বিশেষ সুদৃষ্টি ও আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন।
তাঁর জন্ম তারিখ সম্বন্ধে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রাথমিক শিক্ষা হতে শুরু করে শেষ পর্যন্ত উজানী মাদ্রাসাতেই পড়াশোনা সমাপ্ত করেন। তাঁর চাচা মাওঃ ইসমাইল (রহঃ)-এর সাথে বিভিন্ন মাহফিলে যেতেন এবং ওয়াজ-বক্তৃতা করতেন। এভাবেই এক সময় সারাদেশে খ্যাতিমান আলেমে দ্বীন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
তাঁর পিতা মাওঃ শামসুল হক (রহঃ) তাঁকে মারফতের সবক প্রদান করেন এবং তাঁর মৃত্যুর এক বছর পূর্বে তাঁকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যান। শামছুল হক (রহঃ) ক্বারী ইব্রাহীম (রহঃ)-এর নিকট হতে খিলাফত প্রাপ্ত ছিলেন। তিনি এমন ব্যক্তিত্ব ছিলেন তাঁকে সালাম ও সম্মান করতে সবাই এগিয়ে যেত। নিরহঙ্কারী ও বিনয়ী এ মানুষটি কারো সালামে মুগ্ধ হতেন না বরং আরো বিনয়ে নুয়ে পড়তেন।
তাঁর চারিত্রিক সুষমা, বিনয়, নম্রতা, সকলের সাথে সুসম্পর্ক ও সৌহার্দ্য যেন তাঁর জন্মগত বৈশিষ্ট্য ছিলো। অতিথি আপ্যায়নে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর চারিত্রিক মাধুর্যতায় অমুসলিমরা পর্যন্ত মুগ্ধ ছিলো। কারণ তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, সংখালঘুদের সাথেও তিনি কোমল আচরণ করতেন। আলেম-উলামা, মন্ত্রী, এমপি, জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত প্রত্যেক শ্রেণীর পেশাজীবীকে তিনি যথাযোগ্য মর্যাদা দান করতেন। অত্যন্ত হেকমতের সাথে তাদেরকে আমল ও সুন্নতের প্রতি যত্নবান হবার এবং নিষ্ঠার সাথে দেশ ও জাতির সেবা করার উপদেশ দিতেন। মোট কথা তাঁর এলেম, আমল, ইখলাস, পরিশ্রম ও সাধনা সব কিছুই একত্রে তাঁর মাঝে স্বাতন্ত্র্য গড়ে তুলেছিলো। তিনি ছিলেন নববী চরিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
আধ্যাত্মিক জগতের এ মহান সাধক ক্বারী ইব্রাহীম (রহঃ)-এর সুযোগ্য পুত্র শামছুল হক (রহঃ)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র ও খলিফা ছিলেন। এ পথের পথিকদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বাগ্রে। ইলমে মারেফতের চর্চায় তিনি ছিলেন জগত বিখ্যাত। যার ফলে দেশ ও বিদেশে তাঁর ৪-৫ লক্ষ ভক্ত মুরিদ ছড়িয়ে আছে। তিনি যে শুধু একজন সাধক ও আধ্যাত্মিক রাহবার ছিলেন তা-ই নয়, বরং প্রচলিত সামাজিক দুর্নীতি ও কুপমণ্ডুকতার শিকড় উপড়ে ফেলে ন্যায় ভিত্তিক মানব সমাজ গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মানুষে মানুষে হানাহানি- সংঘাত বন্ধে ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি করতে প্রাণন্ত প্রয়াস চালান। সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, মদ ও জুয়া বন্ধ করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তাঁর সুমধুর কণ্ঠে কোরআন ও হাদীসের বাণী শুনে দিক হারা মানুষ পেয়েছে পথের দিশা, সন্ত্রাস বর্জন করে বেছে নিয়েছে ইবাদতের পথ, মদের বোতল ছেড়েছে বহু মদ্যপ।
নারীকে পর্দায় থাকার পাশাপাশি পুরুষরা যেন নারীর যথাযথ অধিকার রক্ষা করে এবং তাদেরকে উপযুক্ত আসনে সমাসীন করে সেজন্যেও আহবান করতেন। অনৈতিক নিয়মনীতি বর্জন করে সুন্নতের আদলে ও সঠিক নীতিতে ব্যবসা বাণিজ্য করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি বলতেন, মানুষকে মানবিক গুণাবলির সমন্বয়ে মানুষ হতে হবে। শুধুমাত্র দৈহিক অবয়বে মানুষ হলে চলবে না। তাঁর ভাষায় ‘হুঁশ. হুঁশের নাম মানুষ, বেহুঁশের নাম পাগল।’ সমাজে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাধন, অথনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা এবং সমাজ হতে জোর জুলুম বিদায় করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। গরিব-দুঃখীদের দেদারচে দান সদ্কা করতেন।
তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি। ১৯৮২ সন থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত উজানী মাদ্রাসায় মোহতামীম (প্রিন্সিপাল) ও সেক্রেটারীর পদে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর আমলে মাদ্রাসা সর্ব দিকে উন্নতি লাভ করে। শিক্ষার সকল উপকরণ ত্বরিৎ গতিতে ব্যবস্থা করতেন। তাঁর মতে, শিক্ষাহীন জাতি হলো অন্ধের ন্যায়। মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের সুবিধার জন্য মাদ্রাসাকে আধুনিকতার সাথে ঢেলে সাজান। তাঁর এ সময়ে মাদ্রাসায় বাংলা, ইংরেজির অনুপ্রবেশ ঘটে। বাংলা ও আরবী সাহিত্যে ব্যাপক চর্চা শুরু হয়। তিনি উন্নত রুচিশীল ও আধুনিক মানুষ হলেও আধুনিকতার নামে অশস্নীলতা ও বেলেল্লাপনা মোটেও পছন্দ করতেন না।
ছাত্র-শিক্ষক কাউকে তিনি অবজ্ঞা করতেন না। সকলেই ছিলো তাঁর স্নেহের ভিখারী। একবার মাদ্রাসার অর্থ সঙ্কট দেখা দিয়েছিল, ওস্তাদদের বেতন দেয়ার মত সমার্থ্য ছিলো না। তিনি নিজের ধান বিক্রি করে ওস্তাদদের বেতন পরিশোধ করেন। তিনি কখনো স্কুল, কলেজে পড়তে নিষেধ করতেন না। বরং তাঁর ভাষ্য ছিলো ‘ইরেজি পড়, ইংরেজ হইও না।’ ইসলামের সীমায় থেকে জাগতিক শিক্ষা অর্জনের প্রতি উৎসাহিত করতেন। স্কুল-কলেজের ছাত্ররা তাঁর কাছে দোয়ার জন্য আসলে তাদের জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করতেন এবং কোরআন-হাদীস শিক্ষার প্রতি তাগিদ দিতেন। এছাড়াও হাজারো গুণাবলি দ্বারা তিনি সর্বস্তরের জনগণের হৃদয়ের গহীনে স্থান করে নিয়েছিলেন।
মানবীয় সকল গুণের আঁধারে এ শুকতারাটিও যে একদিন হারিয়ে যাবে হয়তো জগৎবাসী তেমনভাবে তা’ চিন্তা করেনি। কিন্তু সব প্রাণীই যে একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে আল্লাহর এ অমোঘ বিধানে আমাদের হযরত গত ১১ এপ্রিল দিবাগত রাত ১০টা ৩০মিনিট তাঁর নিজস্ব বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। ১২ এপ্রিল শুক্রবার দুপুর ৩টায় তাঁর জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয় । এতে প্রায় ৬ লাখ লোকের সমাগম হয়। জানাজায় ইমামতি করেন তাঁর সুযোগ্য বড় সাহেবজাদা, বর্তমান গদিনশিন পীর ও মোহতামীম, মাওঃ ফজলে এলাহি সাহেব। তাঁকে মাকবারায়ে ইব্রাহীমিতে চিরতরে শায়িত করা হয়। দাফনের পর হতে তাঁর কবর হতে এক প্রকার সুগন্ধ ছড়াচ্ছিল, যা জনমনে তাঁর প্রতি ভক্তি ও আবেগ আরও বাড়িয়ে দিল। তিনি তিন ছেলে, সাত মেয়ে, অসংখ্য গুণগ্রাহী ও লাখ লাখ ভক্ত মুরীদ রেখে যান। কবির ভাষায় :
দুই দুয়ারী পান্থশালা,
হেথায় মোদের ক্ষণিক স্থিতি
বিদায় নিলে ফিরব না আর,
অন্তহীন এ বিদায় নীতি।
লেখক : শামসুল আবরার, ছাত্র, জামেয়া ইসলামিয়া ইব্রাহীমিয়া উজানী মাদ্রাসা।