৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬ সাল- সকাল ৭টা
সালমান শাহর বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরী ছেলেকে দেখতে যান সকাল ৭টায়। কিন্তু তাকে ঢুকতে দিচ্ছিল না বাড়ির দারোয়ান।বলছিল, ম্যাডামের নিষেধ আছে। কিন্তু বাধা মানেননি বাবা।ছেলের বাসায় যাবেন তাতে কার অনুমতির তোয়াক্কা করবেন তিনি! লিফট বন্ধ।সিঁড়ি ভেঙেই ওঠেন তিনি। বাসায় ঢুকেই বউমা সামিরাকে বলেন ছেলেকে ডাকতে।ইনকাম ট্যাক্সের কাগজপত্রে সই লাগবে। কিন্তু সামিরা রাজি হন না।বলেন, ‘বাবা, ওতো ঘুমুচ্ছে’। সালমানের বাবা বলেন,‘ওকে, আমিই তাহলে যাই’। বেডরুমে যেতে চান তিনি। কিন্তু সামিরা তাকে যেতে দেন না। চা এনে দেন শ্বশুরকে। চা পান করে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে আবার বলেন তিনি, ‘ ওকে একটু ডেকে তোল, আমি চলে যাবো। সই দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়বে’। কিন্তু সামিরা কিছুতেই রাজি হন না। বাবা ফিরে আসেন। ছেলে ঘুমুতে থাকে।
৬ সেপ্টেম্বর- সকাল ১১টা
সকাল ১১টায় সালমানের মা নীলা চৌধুরীর কাছে ফোন আসে।কে যেন বলে, ‘ইমন ভাইকে দেখতে হলে এখনই আসেন’। শুনে চিৎকার করে ওঠেন মা।স্বামীকে জিগেস করেন, ‘কী হইসে আমার ছেলের? তুমি না একটু আগে আসলা?’ সালমানের বাবা কমরউদ্দিন বলেন, ‘হ্যাঁ তাইতো। কী হয়েছে?’ তারা দ্রুত যান সালমানের বাসায়। গিয়ে দেখেন সালমান বিছানায় উল্টোপাশে মাথা দিয়ে শুয়ে আছেন, চোখ বন্ধ। হাত পায়ের নখ নীল হতে শুরু করেছে। চার-পাঁচজন মেয়ে তার হাত পা মালিশ করছে। নীলা চৌধুরী চিৎকার করে উঠলেন, ‘কী হয়েছে আমার ছেলের?’ সালমানের স্ত্রী সামিরা কিছু বলেন না। তিনি ছেলের পাশে যান, ডাকেন ছেলেকে, ‘ইমন দেখো, তোমার মা আসছি’ । কিন্তু ওঠেনা ছেলে।নীলা স্বামীকে দেখান ছেলের ঠোঁট নীল হয়ে আসছে। তারা ছোটেন তাকে নিয়ে হাসপাতালে। তখনো সালমান বেঁচে আছেন। লিফট বন্ধ। সিঁড়ি ভেঙে নামতে দেরি হয়ে গেলো। হলি ফ্যামেলি হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু তাকে সেখানে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানালো কর্তৃপক্ষ। তারা ছুটলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু ততক্ষণে আর নেই সালমান। ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করলেন এক মহানায়ককে।
অপমৃত্যু মামলা!
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সালমানের লাশ ময়নাতদন্ত করে এটিকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হলো। এর আগে জানা যায়, সালমান সিলিং ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। সালমানের ঘরের গৃহপরিচারিকা তাকে দড়ি কেটে নামান। ঘটনা অস্বাভাবিক ঠেকে সালমানের মা-বাবার কাছে। তারা হত্যা মামলা করেন রমনা থানায়। কিন্তু রমনা থানা এটিকে অপমৃত্যু মামলা হিসেবে নিয়ে মামলাটিকে হালকা করে দেয়।প্রতিবাদ করেন নীলা চৌধুরী। পুলিশ বলে, তদন্ত হোক, তদন্তে বের হয়ে এলে এটি অটোমেটিক হত্যা মামলা হয়ে যাবে।নীলা চৌধুরী পুলিশের সঙ্গে পেরে ওঠেন না।
গুঞ্জন, শোক, প্রতিবাদ
সারাদেশের মানুষ এ ঘটনায় গভীরভাবে শোকাহত হয়ে পড়ে। মোট একুশ জন তরুণী সালমানের মৃত্যু সংবাদ শুনে আত্মহত্যা করেন। কেউ কেউ দাবি করতে থাকেন, শাবনূরের সঙ্গে প্রেমের জেরেই আত্মহত্যা করেছেন সালমান। কেউ আবার স্ত্রী সামিরার দিকে তীর সন্দেহেরে তীর ছোড়েন।স্ত্রীর সঙ্গে কলহ চলছিল সালমানের। আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল সামিরার। তিনিই হত্যা করেছেন সালমানকে।সারাদেশে সালমান ভক্তরা ফুঁসে ওঠে। সরকার বাধ্য হয় পুনরায় তদন্ত টিম গঠন করতে। মৃত্যুর আটদিন পর তদন্ত টিম ফের ময়নাতদন্তের নির্দেশ দেয়।সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের তিনজন অধ্যাপকের সমন্বয়ে তদন্ত টিম ময়নাতদন্তে নামে।
ফের সালমানের মুখ…
আটদিন পর সালমানের লাশ তোলা হলো। লাশ দেখে তদন্ত টিম অবাক হয়ে গেলো। আটদিন পরও সালমান একদম জীবন্ত মানুষের মতো ঘুমুচ্ছিলেন। তার শরীর একটুও গলেনি, পচেনি। কেবল চোখ দুটো সামান্য গলে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে না কবরের অন্ধকারে অধিক ঘুমে কে জানে? তদন্তটিম প্রধান নারগিস বাহার চৌধুরী বলেন,‘আমার কাছে মনে হয়েছে সালমান যেন এখনই মারা গেছেন। তাকে দেখে মনে হয়নি আটদিন আগে মারা গেছেন তিনি। শরীর অক্ষত ছিল তার। তবে এরকম হতে পারে। ভেতরের সব পরিবেশ যদি ঠিক ঠাক থাকে তাহলে বডি অনেকদিন লাস্টিং করে।মেডিকেল সায়েন্স বলে এটা হতে পারে। এটাকে বলে এডুফুসিয়ার ফরমেশান।আমরা খুব চমৎকারভাবে তার শরীর পর্যবেক্ষণ করেছি। আমরা দেখেছি, তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ণ নেই।শরীরের কেমিক্যাল পরর্যবেক্ষণ করে কোথাও কোনো টক্সিক পাইনি।মানে তাকে কোনো কিছু খাওয়ানো হয়নি। বা তিনি খাননি।ফলে আমরা সব বিবেচনা করে দেখেছি এটি আসলে আত্মহত্যা।’
অতঃপর…
এ রিপোর্টটির পরপরই মামলাটি থেমে যায়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়। প্রশ্ন ফুরোয় না কারো মন থেকে। সালমান কেন যাবেন অসময়ে? সালমানের মা, বাবা, হাজারো দর্শক, ভক্ত বিশ্বাস করেন না তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
কেন পারেন না? এ নিয়ে আছে নানান অস্বাভাবিকতা ঘটনা, নানান সন্দেহ, নানান গুজব, নানান তথ্য উপাত্ত… যা বিশ্বাস করতে দেয় না যে সালমান আত্মহত্যা করেছেন। তবু সবাইকে বিশ্বাস করতে হলো। কেননা ময়নাতদন্ত রিপোর্টে স্বয়ং বিজ্ঞান বলছে সালমান আত্মহত্যা করেছেন।
তাই আমরাও চোখ বুঁজে কেবল কষ্টই অনুভব করি প্রিয় নায়কের জন্য। তবু যদি কোনো গোপন সুচতুর ঘাতক লুকিয়ে থাকে এসবের অন্তরালে যাকে আমরা চিনতে পারিনি,যার জন্য আমাদের সালমান হারানো অসংখ্য বেদনা ভারাক্রান্ত মনে কোনো ক্ষমার স্থান নেই।
সূত্র: বিবিসি বাংলা