“সরজমিনে ফরিদগঞ্জের ছয়টি কেন্দ্র পর্যবেক্ষণকালে জনগণের হতাশাব্যঞ্জক অভিব্যক্তি :
এমন ভোট ডাকাতি ও কেন্দ্র দখলের নির্বাচন আমরা কখনো দেখিনি
এ এইচ এম আহসান উল্লাহ
সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ফরিদগঞ্জের ছয়টি কেন্দ্র ঘুরে যে চিত্র দেখা গেলো তাকে ভোটগ্রহণ বলা কষ্টকর। ভোট কেন্দ্র দখলের চিত্র এরশাদ আমলের নির্বাচনকেও হার মানিয়েছে। প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারদের মারধর করে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে গেছে চেয়ারম্যান প্রার্থী আবু সাহেদ সরকারের সমর্থকরা। অন্য প্রার্থীদের এজেন্টদের মারধর করে, কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে সরকার দলীয় কর্মীরা। শ� শ� ব্যালট পেপারে প্রকাশ্যে হেলিকপ্টার মার্কায় সীল মেরেছে। প্রিজাইডিং অফিসারসহ অন্য কর্মকর্তারা এক রকম অসহায় ছিলেন। তাদেরকে প্রকাশ্যে দেশীয় অস্ত্র দেখিয়ে হুমকি দেয়ায় তারা ভীত সন্ত্রস্ত ছিলেন। এমনকি রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, স্ট্রাইকিং ফোর্সের দায়িত্বে থাকা ইউএনও, ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের জানিয়েও কোনো ফল পাওয়া যায়নি।
সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে পিরোজপুর জনকল্যাণ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় ভোটার উপস্থিতি তেমন একটা নেই। কেন্দ্রের ভেতরে সাংবাদিকরা ঢোকার পর বেশ কিছু যুবক বিভিন্ন বুথ থেকে বের হয়ে চলে যেতে থাকে। ৪নং বুথে ঢুকে দেখা গেলো সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসাররা সবাই নীরবে বসে আছেন। কোনো ভোটার নেই। কারো কাছে ব্যালট পেপারের বই আছে আবার কারো কাছে নেই। বুথে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীদের এজেন্ট ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর এজেন্ট নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো হেলিকপ্টার প্রার্থীর কর্মীরা অন্য প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। এ বুথের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার জানালেন কিছু যুবক এসে আমাকে ছুরি দেখিয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ব্যালট পেপারের বই ছিনিয়ে নিয়ে সীল মেরে ব্যালট বাক্সে ঢুকিয়ে ফেলে। এ বুথে ভোটার সংখ্যা ২শ� ৪৯ জন। এরপর একই কেন্দ্রের ৩ ও ৭নং বুথে গিয়ে দেখা গেলো চেয়ারম্যান প্রার্থীর ১শ� পাতার ব্যালট পেপারে ২টি বইয়ের সব ক�টি ব্যালট পেপারে হেলিকপ্টারে সীল মারা। এ বিষয়ে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারদের কাছে জানতে চাইলে তারা মুখ খুলতে রাজি হননি। কিছুক্ষণের মধ্যে কেন্দ্রে আসেন স্ট্রাইকিং ফোর্সের দায়িত্বে থাকা কচুয়ার এসিল্যান্ড মাঈনুদ্দিন। তাঁকে এ কেন্দ্রের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হয় এবং তাঁকে সীল মারা ব্যালট পেপার দেখানো হয়। তখন তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমার করণীয় কিছু নেই। আমি আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে। কেন্দ্রের এ অবস্থা সম্পর্কে প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে জানতে চাইলে তিনি অনেকটা বিব্রতবোধ করেন। তখন তিনি এ কেন্দ্রে সাময়িক ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখেন।
সকাল ১১টায় কচুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাঁর স্ট্রাইকিং ফোর্স নিয়ে এ কেন্দ্রে আসেন। তিনি কেন্দ্রের পরিস্থিতি জেনে ৭নং বুথের চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ব্যালট পেপার বই (নং ৫৭৭৬), ৩নং বুথের বই (নং- ৫৭৭৩) এবং ৭নং বুথে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ব্যালট পেপার বই (নং ৬৫৭৫) বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেন।
বেলা ১২টায় যাওয়া হয় ৮৫নং বিরামপুর এসজেএস উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে। এখানেও দেখা গেলো ১১নং বুথে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ৩টি ব্যালট পেপারের বই, ৩নং বুথে ১টি বই, ৫নং বুথে ১টি বই ও ৬নং বুথে ১টি বইয়ের পুরো ব্যালট পেপারে হেলিকপ্টার মার্কায় সীল মারা। এ ব্যাপারে কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি সকাল থেকেই এ পরিস্থিতি দেখে কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে মতামত দিয়েছি। রিটার্নিং অফিসার ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকেও জানানো হয়েছে, কিন্তু তারা কোনো কিছু জানাননি।
বেলা ১২টা ৪০ মিনিটে ৭৬নং সন্তোষপুর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে যাওয়া হয়। এ কেন্দ্রের কয়েকটি বুথের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার জানান, তারা দায়িত্ব পালনকালীন কিছু যুবক এসে জোরপূর্বক ব্যালট পেপারের বই ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তারা কয়েকজন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারকে মারধরও করে। সকাল সোয়া ১০টায় পূর্ব লাড়�য়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, এ কেন্দ্রে কোনো বুথে হেলিকপ্টারের এজেন্ট ছাড়া অন্য কোনো এজেন্ট নেই।
দুপুর ২টায় এ প্রতিবেদকসহ আরো ক�জন সাংবাদিক ইউএনও অফিসে অবস্থানকালে দেখা গেছে যে, ৯২নং পূর্ব হর্ণি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ছয়টি ব্যালট বাক্স প্রিজাইডিং অফিসার ইউএনও অফিসে নিয়ে আসেন। প্রিজাইডিং অফিসার আবদুর রহমানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ কেন্দ্রের ভোট সাড়ে ১২টায় স্থগিত করা হয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কেন্দ্রের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারদের মারধর করা হয়েছে, ১ হাজারের মতো ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং প্রকাশ্যে দেশীয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে কেন্দ্রের ভেতরে মহড়া দেয়া হয়েছে। এ জন্য আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে ভোটগ্রহণ স্থগিত করে দিয়েছি। এ কেন্দ্রে মোট ভোটার ১ হাজার ৬শ� ৩৭।
এমনিভাবে আরো কিছু কেন্দ্রে গিয়ে এ রকম চিত্র দেখা গেছে। কোনো কেন্দ্রেই ভোটার উপস্থিতি তেমন দেখা যায়নি। অথচ বেলা ১২টার মধ্যে ভোট কাস্ট হয়ে গেছে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ। আর কেন্দ্রগুলোতে এমন পরিস্থিতি যখন চলছিলো তখন কেন্দ্রের ভেতরে ও বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ স্ট্রাইকিং ফোর্সকে অবস্থান করতে দেখা গেছে। ফরিদগঞ্জের নির্বাচনের এ চিত্র দেখা স্থানীয় জনগণ হতাশা ব্যক্ত করে বলেছে, এমন ভোট ডাকাতি ও কেন্দ্র দখলের নির্বাচন আমরা কখনো দেখিনি। এরশাদীয় কায়দার নির্বাচনকেও হার মানিয়েছে। কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারসহ অন্যরা ছিলো ভীত সন্ত্রস্ত। আর প্রশাসনের এমন প্রস্তুতি ছিলো শুধুমাত্র লোক দেখানো।