
জানতে চাইলে বিইআরসির চেয়ারম্যান সমকালকে জানান, গ্যাসের নতুন দাম নির্ধারণের বিষয়ে তারা সরকারের সম্মতি পেয়েছেন। বিভিন্ন শ্রেণির গ্রাহকের ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম নির্ধারণে হিসাব শেষ পর্যায়ে। যে কোনো সময় দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হবে। বর্ধিত দাম কার্যকর হবে ১ জানুয়ারি থেকে। বিইআরসির একজন কর্মকর্তা জানান, আগামী ২০ থেকে ২২ ডিসেম্বরের মধ্যে দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে।
গত বছরের ১ আগস্টে সর্বশেষ গ্যাসের দাম বাড়িয়েছিল বিইআরসি। তখন গড়ে ২৬.২৯ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। এবারও গড়ে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ দাম বাড়ানো হতে পারে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন কোম্পানির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এ বছরের ৭ থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে সব পর্যায়ের গ্রাহকরা দাম বৃদ্ধির এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। বিইআরসি সূত্র জানিয়েছে, বাসাবাড়ির গ্যাসের দাম দুই চুলার জন্য মাসিক বিল ৬৫০ টাকা থেকে বেড়ে এক হাজার টাকা হতে পারে। এ ছাড়া সিএনজির দাম প্রতি ঘনমিটার ৩৫ থেকে বেড়ে ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা, গৃহস্থালিতে মিটারভিত্তিক গ্যাসের দাম ৭ থেকে বেড়ে ৯ থেকে ১০ টাকা এবং শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত ক্যাপটিভ বিদ্যুতের জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৮ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১০ টাকা হতে পারে। অন্য খাতেও গ্যাসের দাম সামান্য হলেও বাড়তে পারে। গড়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানো হতে পারে।
শিল্পোদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পেট্রোবাংলাসহ গ্যাস বিক্রেতা সরকারি কোম্পানিগুলো প্রায় প্রতিটিই লাভজনক।
পেট্রোবাংলার তহবিলে ২৫ হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। তাই গ্যাসের দাম বর্তমানে বাড়ানো যৌক্তিক হবে না। এতে সার্বিক অর্থনীতি ও জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে সমকালকে বলেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির যে উদ্যোগ এবার নেওয়া হয়েছে সেটা কোম্পানিগুলোর আর্থিক মন্দা দূর করার জন্য নয়। কারণ, গ্যাস বিক্রেতা কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থা খারাপ নয়। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। সরকার বাসাবাড়িতে গ্যাসের সংযোগ বন্ধ রেখেছে। পাইপলাইন বসিয়ে নতুন কোনো বাসাবাড়িতে আর কখনই সংযোগ দেওয়া হবে না। রান্নার গ্যাসের দাম একটু বেশি হারেই বাড়ানো হবে; যাতে বাসাবাড়িতে এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার বাড়ে। এদিকে এলপিজি সিলিন্ডারের দাম আগের চেয়ে কমে এসেছে। পাইপলাইন গ্যাস ও সিলিন্ডার গ্যাসের মধ্যে দামের বৈষম্য কমানো হবে। পর্যায়ক্রমে সরকার এলপিজিকেই উৎসাহিত করতে চায়। এ ছাড়া ২০১৮-১৯ সাল থেকে আমদানি করা গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে। আমাদের গ্যাসের চেয়ে আমদানি করা গ্যাসের দাম কয়েকগুণ বেশি। ফলে দেশীয় গ্যাসের দাম ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে একটা পর্যায়ে নিতে হবে; যাতে ভবিষ্যতে সরকার লোকসানে না পড়ে। এসব চিন্তা থেকেই গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে বলে ওই কর্মকর্তা মনে করেন।
শিল্পোদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, তারা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাচ্ছেন না। দিনের অধিকাংশ সময় গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ থাকে না। কারখানা চালু রাখায় কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রতি মাসে গ্যাসের বিল ঠিকই গুনতে হচ্ছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় বহু কারখানায় গ্যাসের বদলে বাতাস প্রবেশ করে। সেই বাতাসও গ্যাসের দামে কিনতে হচ্ছে বলে উদ্যোক্তারা অভিযোগ করেন। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে গণশুনানির সময় ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা বারবার গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করেছেন। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কয়েক দফা বৈঠক করে গ্যাসের দাম না বাড়ানোর অনুরোধ করে। তার পরও গ্যাসের দাম বাড়ছে বলে বিইআরসি জানিয়েছে।
গত ৮ আগস্ট অনুষ্ঠিত তিতাস গ্যাসের গণশুনানিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা এবং বর্তমানে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি তপন চৌধুরী বলেছিলেন, গত বছর গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে বস্ত্র খাতের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে ব্যাপকভাবে। ফলে অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, অনেক কারখানায় গ্যাসের চাপ এত কম থাকে যে, উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে রাখা যায় না। কিন্তু মিটারে ঠিকই বিল ওঠে। নতুন করে দাম বাড়ানো হলে বস্ত্রসহ শিল্প খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি আরও বলেন, গ্যাস কোম্পানিগুলো দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অপচয় কমাতে পারে। সেখান থেকে বড় অঙ্কের আর্থিক সাশ্রয় হতে পারে।
সিএনজি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর সমকালকে বলেন, গত বছর সিএনজির দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু লাইনে ঠিকমতো গ্যাস থাকে না। ফলে তাদের ব্যবসা কমছে। আবার দাম বাড়লে লোকজন গাড়িতে গ্যাস নেওয়াই বন্ধ করে দেবে। এখন তেলের দাম কম। গ্যাসের বদলে জ্বালানি তেলকেই প্রাধান্য দেবেন গাড়ির মালিকরা।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, যেখানে বাসাবাড়িতে গ্যাসই থাকে না সেখানে গ্রাহকরা বাড়তি অর্থ গুনতে যাবে কেন? এটা অন্যায়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ালে উৎপাদন খরচ বাড়বে। দাম বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের। পরিবহন ভাড়াও বাড়িয়ে দেবেন মালিকরা। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। চাপে পড়বে অর্থনীতি।
গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাসের এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকার আশপাশ এলাকায় ৩০০ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন রয়েছে। এখান থেকে অবৈধভাবে বাসাবাড়িসহ ছোট শিল্প-কারখানাও গ্যাস ব্যবহার করছে। গ্যাসের অবৈধ এ ব্যবহার কমানো গেলে বৈধ শিল্প গ্রাহকরা দুর্ভোগ থেকে অনেকটাই রেহাই পেতেন।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ইশতিয়াক আহমেদ সমকালকে জানান, গ্যাস সংকটের প্রধান কারণ ঘাটতি। পাশাপাশি একটি বড় কারণ হলো চুরি। তিনি জানান, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত গ্যাসের দৈনিক উৎপাদন ৩০ কোটি ঘনফুট বেড়েছে। বৈধ নতুন সংযোগের কারণে গ্যাসের চাহিদা বেড়েছে খুব বেশি হলে ১০ কোটি ঘনফুট। বাকি গ্যাসটুকু কই যাচ্ছে, প্রশ্ন রাখেন ইশতিয়াক আহমেদ। সম্প্রতি সংঘটিত কয়েকটি দুর্ঘটনার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, দুর্ঘটনার পর দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো কারখানা অবৈধভাবে অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহার করছে।
গ্যাসের সংকট সত্ত্বেও কেন দাম বাড়ানো হচ্ছে_ জানতে চাইলে বিইআরসি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, পেট্রোবাংলার ওপর আরোপিত করের পরিমাণ বেড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস কোম্পানিগুলোর কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বেড়েছে। তাই গ্যাসের দাম বাড়াতে হচ্ছে। কারণ, এ ছাড়া তাদের আয়ের অন্য কোনো উপায় নেই। সরকার ভর্তুকি দিলে দাম অল্প বাড়ালেই চলত। সরকার ভর্তুকি দিতে চাইছে না। তবে কমিশনের চেষ্টা থাকবে বৃদ্ধির হার যেন গ্রাহকদের জন্য সহনীয় পর্যায়ে থাকে।