নিজস্ব প্রতিবেদক
বিএনপি জোটের টানা অবরোধ ও নাশকতার কারণে সৃষ্ট চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় সবচেয়ে বেশি দুরবস্থায় পড়েছেন হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। দৈনিক আয় ছাড়া রাজধানীতে যাদের বেঁচে থাকার ভিন্ন কোনো উপায় নেই। লাগাতার অবরোধে ক্রমাগত বিক্রির পরিমাণ কমে যাওয়ায় তাদের মাথায় হাত পড়েছে। অবরোধের আগেও যে পরিমাণ রোজগার হতো, তা দিয়ে এসব দিনমজুর ও ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীর সপরিবারে জীবনযাপন ছিল অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যের। ফলে চালান ভেঙে জীবন ধারণ করছেন। বাড়ছে ঋণের বোঝা।
ঢাকা শিশু পার্কের সামনে চটপটি-ফুসকা বিক্রি করেন মানিক মিয়া, পার্কে বেড়াতে আসা মানুষই তার প্রধান খরিদ্দার, আর প্রতিদিনের আয়েই চলে তার সংসার। টানা অবরোধের মধ্যে গাড়িতে আগুন দেয়া আর বোমাবাজির কারণে পার্কে বেড়াতে আসা মানুষের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। এখন ছুটির দিনেও ভিড় দেখা যাচ্ছে না সেখানে। মানুষ কমে যাওয়ায় মানিকের বেচাকেনাও নেই বললেই চলে, তবুও নিয়মিত দোকান সাজিয়ে বসেন তিনি, যদি বেচা-বিক্রি হয়। মানিক বলেন, লোকজন আসছে না, বেচাবিক্রি একদম নেই। কোনো দিন দোকান খুলছি, আবার কোনো কোনো দিন খোলার অবস্থাও হচ্ছে না। মানিক বলেন, দোকানের বেচাকেনা থেকে যে আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চলে। এখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। শিশু পার্কের টিকিট বিক্রেতা পূবালী ব্যাংকের কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক বলেন, সাধারণ সময়ের তুলনায় পার্কে দর্শনার্থী অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। কোনো কোনো দিন হাতেগোনা কিছু দর্শনার্থী আসছেন।
শিশু পার্কের সামনে বাচ্চাদের খেলনা, মেয়েদের সাজসজ্জার পণ্য, গৃহস্থালি পণ্য, খাবারের শতাধিক দোকানের পাশাপাশি বাদাম, হাওয়াই মিঠাইয়ের কিছু ভ্রাম্যমাণ হকারও বসেন নিয়মিত। ক্ষুদ্র আয়ের এই বিক্রেতাদের সবার অবস্থাই এক। এরা সবাই দিনের রোজগার দিয়েই সংসার চালান, কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার আশু নিরসনের কোনো সম্ভাবনা না দেখে উদ্বিগ্ন তারা। এভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকলে পুঁজি হারানোর পাশাপাশি নিজেদের জীবন ধারণ নিয়ে শঙ্কার কথা জানান এসব ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী।
রাজধানীর পুরান পল্টন, বায়তুল মোকাররম, গুলিস্তান, দিলকুশা ও মতিঝিল এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, হকাররা জামা-কাপড়, খাদ্য, বই, ক্রোকারিজ, জুতা, খেলনা, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী নিয়ে ব্যবসা করছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন-চার মাস আগেও হকারদের ব্যবসা ভেদে প্রতিদিন সর্বনি¤œ ৪০০ থেকে সর্বোচ্চ এক থেকে দুই হাজার রোজগার হতো। বর্তমান পরিস্থিতিতে রোজগারের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ২০০-৩০০ টাকা। ফলে অনেক ব্যবসায়ীকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে শিগগিরই যেসব ব্যবসায়ীর এখনো লোকসান হয়নি তাদেরও একই পরিণতি হবে।
ফুটপাতের এসব বিক্রেতা বলছেন, মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে কম, যারা বের হচ্ছে তারা কাজ শেষ করে দ্রুত ঘরে ফিরছে, ফলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেনাকাটা করছে কম।
গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের বিপরীত ফুটপাতের খেলনা ব্যবসায়ী মো. আকরাম মিয়া বলেন, তিন মাস আগেও খেলনা বেশ বিক্রি হচ্ছিল। কিন্তু ইদানীং তেমন বিক্রি হচ্ছে না, তাই আয়-রোজগার কম। রাতে একটু বেচাবিক্রি হয় বলে দুই বেলা খেয়ে বেঁচে আছি।
এদিকে হকার গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের (ডব্লিউবিবিটি) পক্ষ থেকে করা এক জরিপ থেকে জানা যায়, স্বল্প পুঁজি নিয়ে ঢাকা শহরে মোট ২ লাখ ৩৫ হাজার হকার বাস করছেন। এর মধ্যে স্থায়ীভাবে বাস করছেন ৬৫ হাজার হকার। অস্থায়ীভাবে রয়েছেন ৭৫ হাজার। আর ভ্রাম্যমাণ হকার রয়েছেন ৯৫ হাজার। এদের মধ্যে ২৯ শতাংশ হকার কাপড়, ২৯ শতাংশ হকার খাদ্যজাতীয় পণ্য বিক্রি করেন। বাকি ৪২ শতাংশ হকার বই, ক্রোকারিজ, জুতা, খেলনা, মাটির জিনিসপত্র, গাছের চারা, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রীর ব্যবসা করেন। এসব হকারের একেক জনের পুঁজি প্রায় ২০০ থেকে ১ লাখ টাকা বা তারও বেশি। ওই পুঁজি খাটিয়ে তারা প্রতিদিন গড়ে সর্বনি¤œ ২০০ থেকে ২ হাজার টাকা আয় করেন। এ ছাড়া দেশের নি¤œ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই হকারের কাছ থেকে নিত্যপণ্য কিনে থাকেন। এ পেশায় আসার আগে প্রত্যেকের পরিবার নিয়ে থাকা, খাওয়া, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুবিধা নিশ্চিত করা বা তাদের টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। এ পেশায় এসে অধিকাংশ হকার ও ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীর পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ছিন্নমূল হকার সমিতির সভাপতি কামাল সিদ্দিকি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে হকারদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি ক্রেতার সংকট। পাশাপাশি অবরোধের কারণে যেসব এলাকায় যানবাহন পুড়িয়ে দিচ্ছে সেসব এলাকায় হকারদের বসতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে অধিকাংশ হকার চালান ভেঙে দিন যাপন করছেন। এভাবে চলতে থাকলে ধীরে ধীরে ঋণের বোঝা বাড়বে, চরম দুরবস্থায় পড়বে এসব ব্যবসায়ীর পরিবার। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে হকারদের দোকান খুললেই প্রতিদিন ন্যূনতম ২০০ টাকা খরচ হয়। এর মধ্যে চাঁদা, বিদ্যুৎ, ঝাড়ুদার বিল অন্যতম। প্রতিদিন বিভিন্ন হকারের সঙ্গে কথা হচ্ছে। তারা জানিয়েছে, সারাদিনে যে বেচাবিক্রি হচ্ছে তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, হরতাল ও অবরোধে দেশের সার্বিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ীদের।
শিরোনাম:
রবিবার , ২৬ জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ১৩ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।