মিজান লিটন
আর্সেনিক একটি মরণব্যাধি রোগ। পানিজনিত সমস্যার ফলে এ মরণব্যাধি রোগটি মানুষের শরীরে দেখা যায়। যার শেষ পরিনতি হয় মৃত্যুতে। দেশের প্রতিটি স্থানে এ রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে। সরকারিভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা বাস্তবায়নে ধীরগতি হওয়ায় মৃত্যুর মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রয়োজনের তুলনায় বিশুদ্ধ আর্সেনিকমুক্ত পানি পান না করা এর প্রধান কারণ। দেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় মরণব্যাধি আর্সেনিক গ্রাস করছে চাঁদপুরবাসীকেও। সুপেয় মিঠা পানির উৎসস্থল পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর তীরে সর্বগ্রাসী আর্সেনিকের ভয়াল থাবা প্রতিনিয়ত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে আর্সেনিকের রূপ। আর্সেনিক নিয়ে এখনই প্রতিরোধসহ পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা না হলে জেলার সিকি কোটি মানুষের জীবনে নেমে আসবে অনিশ্চিত মরণব্যাধি আসেনিকোসিসের প্রাদুর্ভাব।
চাঁদপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে ’৯৩ সালে নলকূপের প্রথম চাঁদপুরে আর্সেনিক শনাক্ত করা হয়। এরপর জেলার ৮টি উপজেলার অধিকাংশ নলকূপের পানিতে আর্সেনিক শনাক্ত হতে থাকে। ধারবাহিকতায় ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে জেলার সর্বত্র আর্সেনিকের থাবা। তবে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক থাকলেও এ অঞ্চলের মানুষের সচেতনতায় অনেকাংশেই রক্ষা পেয়েছে বিশাল জনপদ। মানুষ নলকূপের পানি পান করা থেকে বিরত থাকা ও বিকল্প বিশুদ্ধ খাবার পানি গ্রহণ করায় এ রক্ষা পায়।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে চাঁদপুর জেলার ৮টি উপজেলার মোট জনসংখার মধ্যে আর্সেনিকের মাত্রা হাজীগঞ্জে ৯৮ দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ। এছাড়া চাঁদপুর সদরে ৭২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মতলব উত্তরে ৮২ দশমিক ৮৮ ভাগ। হাইমচরে ৮২ দশমিক ১৭ শতাংশ। মতলব দক্ষিণে ৯১ দশমিক ৬০ ভাগ। শাহরাস্তি উপজেলায় ৯৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কচুয়ায় উপজেলায় ৯৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ ও ফরিদগঞ্জ উপজেলায় ৯৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ মানুষ আর্সেনিকের ঝুঁকিতে রয়েছে।
এদিকে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের সর্বশেষ তথ্যমতে ঝুঁকির বিপরীতে আর্সেনিক মুক্ত পানি পান করে চাঁদপুর সদরে ৩৯ শতাংশ মানুষ। হাজীগঞ্জ উপজেলায় ২৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। মতলব উত্তর উপজেলায় ২৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। হাইমচর উপজেলায় ২৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। মতলব দক্ষিণ উপজেলায় ২৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ। শাহরাস্থি উপজেলায় ২১ দশমিক ৮৯ ভাগ। কচুয়া উপজেলায় ২২ দশমিক ৯১ শতাংশ ও ফরিদগঞ্জ উপজেলার ৪৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি ব্যবহার করছে।
জেলার সিকি কোটি মানুষের জীবন রক্ষায় সর্বত্র আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানির জন্য প্রয়োজন গভীর নলকূপ। আর্সেনিকের হাত থেকে রক্ষা ও বিশুদ্ধ পানির সংস্থানের উৎস হচ্ছে গভীর নলকূপ। বর্তমানে জেলার মোট জনসংখ্যার প্রতি ১শ’ জনে ১টি করে গভীর নলকূপ প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে প্রাথমিকভাবে জেলায় প্রয়োজন ২০ হাজার গভীর নলকূপের। অথচ এর বিপরীতে সরকারিভাবে সবর্ত্র গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে এ পর্যন্ত মাত্র ৮ হাজার। গত ২০১৩-২০১৪ অর্থ বছরে মাত্র ৩শ’ নলকূপ স্থাপন করা হয়।
অপরদিকে আর্সেনিকের থাবায় জেলায় আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়েছে অনেকেই। জেলা সিভিল সার্জন বিভাগের সর্বশেষ এপ্রিল-২০১৪ পরিসংখ্যানে জেলায় ৮ হাজার ৩শ’ ৮৩ জন আর্সেনিকোসিস রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ ৩ হাজার ৫শ’ ৪৫ জন ও মহিলা ৪ হাজার ৮শ’ ৩৮ জন।
উপজেলা ভিত্তিক পরিসংখ্যানে আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়েছে কচুয়া উপজেলায় ৭শ’ ৯৩ জন, শাহরাস্তিতে ৫ হাজার ১শ’ ১৭ জন, হাজীগঞ্জে ১ হাজার ১শ’ ৫৫ জন, মতলব দক্ষিণে ৫শ’ ৩১ জন, মতলব উত্তরে ৪শ’ ৫০ জন, চাঁদপুর সদরে ৪শ’ ৬৩ জন, হাইমচরে ৬৪ জন ও ফরিদগঞ্জ উপজেলায় ৩শ’ ৩৮ জন রোগী পাওয়া গেছে।
এ আতঙ্কজনক চিত্রই জানান দিচ্ছে আস্তে আস্তে জেলার মানুষ মরণব্যধি আর্সেনিকোসিস রোগের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এখনই এ রোগ প্রতিরোধ করা না গেলে চরম মূল্য দিতে হবে এ অঞ্চলের জনপদসহ তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে। বিশেষজ্ঞদের মতে আর্সেনিকোসিসের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো বিশুদ্ধ পানি পান করা। তবে গভীর নলকূপের পানিতে পয়েন্ট ৫-এর নিচে আর্সেনিকের মাত্রা মানবদেহের জন্য তেমন প্রভাব ফেলে না। বিশেষজ্ঞদের মতে মানবদেহের জন্য পয়েন্ট ৪-এর উপর আর্সেনিক ধারাবাহিকভাবে আর্সেনিকোসিস রোগে পরিণত হয়। ফলে ঐ রোগীর হাত, পা, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ খোঁসা ও পচন দেখা দেয়। যা পরবর্তীতে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করাও সম্ভব হয় না।
শিরোনাম:
শুক্রবার , ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ২৫ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।