শওকত আলী :
চাঁদপুরে বসবাসরত কয়েক হাজার দলিত সম্প্রদায়ের হরিজন, ডোম, ঋষি, রবি দাস ও মনিঋষিরা শহর ও শহরতলির বিভিন্ন স্থানে বসবাস করে যাচ্ছে, প্রায় ২শ’ বছর যাবত। তারা প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলার জন্য সব সময় নিজেদের প্রস্তুত রাখে বলে জানান। তারা প্রাকৃতিক দূর্যোগ ঝড়-তুপান- বন্যা- ভূমীকম্প- জ্বলচ্ছাস সহ সবধরনের দূর্যোগে বেঁচে থাকতে ও জানমাল রক্ষা করতে নিজেদের মধ্যে একতা সৃষ্টি করে প্রস্তুত থাকেন বলে তাদের মতামত প্রকাশ করেন।
দলিতরা জনান, এসব দূর্যোগে তাদের যে পরিমান বাড়ি ঘর ক্ষয়ক্ষতি হয়, সে বাড়ি ঘর মেরামত করতে সরকারি বা বেসরকারি কোন সংস্থা থেকে সাহায্য সহযোগীতা পাননা বলে অভিযোগ করেন। তারা বলেন, দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ আবাসন নিজেদের অর্থায়নে মেরামত করতে হয়। দূর্যোগে খাদ্য সহায়তা পর্যন্ত পাননি বলে দলিত নেতারা ক্ষোভপ্রকাশ করে জানান। ত্রাণ সহযোগীতা নিতে হলে অনেক কাঠখর পোহাতে হয় তাদেরকে। তারা অবহেলার মধ্যে থাকতে হয় বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার কাছে। তাদের কোনমতে মাথা গোজার ঠাঁই টুকু দখল হয়ে যাবে এ ভয়ে তারা দূর্যোগের সময় আশ্রয় হিসেবে নিরাপদ স্থানে জাননা। কষ্ঠ শিকার করে নিজ এলাকায় পরে থাকেন বলে দলিতরা অভিমত প্রকাশ করেন। তারা এ দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের বসবাসকৃত স্থানে বহুতল ভবন করে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে আকুল আবেদন জানান। তারা যে অর্থ উপার্যন করেন তা’ দিয়ে সন্তানদের নিয়ে বসবাস করে জমি ক্রয় করা তাদের পক্ষে সম্ভব না বলে তারা জানান। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই তারা এ দেশে বসবাস করছেন।
দলিতরা আরো জানান, তারা সচেতন ভাবে ও পরিকল্পনা অনুযায়ী বিগত বছর গুলোতে বসবার করে যাচ্ছে। তাদের দূর্যোগে ক্ষতি সাদিত হলেও তারা ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে চলাচল- বসবাস করে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। তবে এ অবহেলিত দলিত জনগোষ্ঠি সরকারের সঠিক সহযোগীতা নিয়ে শান্তিতে বসবাস করার নিশ্চয়তার জন্য বর্তমান মুক্তিযোদ্ধের সরকারের কাছে সহযোগীতা চাচ্ছে।
এ ব্যাপারে চাঁদপুর রেলওয়ে হরিজন কলোনির শ্রী শ্রী মহাবীর ও রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক বিধান চন্দ্র দাস হরিজন (জনি) জানান, দূর্যোগের সময় হরিজনরা অন্যদের চেয়ে বেশি কষ্ঠ করে থাকে। বন্যার পানিতে পুরো চাঁদপুর প্লাবিত হলে নিজেদের স্থানে থেকে মোকাবেলা করতে হয়। এ সময় বিশুদ্ধ পানির কারণে অনেক সময় পানি বাহিত রোগে দলিতরা আক্রান্ত হয়ে থাকে। এ দূর্যোগের সময় সরকারি ত্রাণ থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। কিছু পেতে হলে অনেক চড়াই উতড়াই পারি দিয়ে কিছু পেতে হয়। বিভিন্ন দূর্যোগে তাদের বসত বাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হলেও সরকারি কোন ত্রাণ তহবিল থেকে তা’ সংস্কার করা হয় না। বড় ধরনের দূর্যোগের কথা শুনলে দলিতরা আতঙ্কিত হয়ে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে তাদের অনেক ধারণা রয়েছে। বিশ্বের জলবায়ুর তুলনায় বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে তাদের ধারণা রয়েছে। মূলত বিষয় হচ্ছে হরিজনরা দূর্যোগ পূর্ণ পরিবর্তনের পরিস্থিতি বুঝে তারা সঙ্গবদ্ধ ভাবে বসবাস করে। এটা তাদের জন্য সু-ভাগ্যপূর্ণ ব্যপার হয়ে দাড়িয়েছে। দূর্যোগে তারা একে অপরকে বিভিন্ন ভাবে সহযোগীতা করে খাপখেয়ে জীবন যাপন করে যাচ্ছে। পরিকল্পনা মোতাবেক দূর্যোগের সময় দেশের যে কোন প্রান্তে ক্ষতি হতে পারে। এ ব্যাপারে তারা তখন প্রস্তুত থাকে এবং সবসময় সচ্ছার হয়ে সুক্ষ্য পরিকল্পনার মাধ্যমে পূর্বের ন্যায় আবার ফিরে আসার চেষ্ঠা করে থাকে।
পুরাণ বাজার হরিজন কলোনির হরিজন যুবক্লাবের সভাপতি শ্যামল চন্দ্র হরিজন জানান, প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় কষ্ঠ শিকার করে থাকতে হয়। এ পর্যন্ত পুরান বাজারে বড় ধরনের দূর্যোগের সময় কোন ক্ষতি হয়নি আমাদের। দূর্যোগের সময় আমরা এলাকায় থাকি। আশ্রয়ন প্রকল্পে গিয়ে ঠাঁই নেই না। নিতে গেলে আমাদের কলোনির বসত ভিটা দখল হয়ে যাওয়ার ভয় রয়েছে। ৯৮ সালের বন্যায় অন্যরা আশ্রয়ের জণ্য পাকা বিদ্যালয়ে নিরাপদ স্থানে গেলেও আমরা যাই না। তুলনামূলক ভাবে পুরান বাজার হরিজন কলোনিটি শহরের বিভিন্ন স্থানের তুলনায় উচু স্থান হওয়ায় আমাদেরকে অন্য কোথাও যেতে হয়নি। এখানে পানি উঠে না। ক্ষয়ক্ষতি হলে দেরিতে বরাদ্ধ আসে। পূর্বে সমস্য ছিলো অনেক। এখন সরকার ব্যবস্থা নেওয়ায় তেমন সমস্যা হয় না আমাদের। তবে দূর্যোগের সময় ত্রাণ সহযোগীতা পাই না। এ পর্যন্ত পুরান বাজার হরিজনরা দূর্যোগের সময় কোন ত্রান সহযোগীতা পায়নি। তবে এখানে বসবাসরত সকলেই ত্রাণ সহযোগীতা পাওয়ার যোগ্য। এখানে বসবাসরত ৫০টি পরিবারের মধ্যে ১০জন সরকারি চাকুরী করে। আর বাকি সবাই হত দরিদ্র। এসব দলিত পরিবারের সকলে ত্রাণ সহযোগীতা পাওয়া একান্ত প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। এ সময় পাড়া মহল্লায় পানি দিয়ে কষ্ঠ করে কাজ করতে হয়। পানি দিয়ে কাজ করে শহর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখি। তা না হলে ড্রেনেজ ব্যবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। পানি আটকিয়ে পানিবাহিত মহামারি হতে পারে। এ জন্য আমরা আন্তরিক ভাবে শহরবাসীর শান্তির লক্ষ্যে কাজ করে থাকি। এ পর্যন্ত দূর্যোগের সময় সরকারের সমাজ সেবা অধিদপ্তর, পৌরসভা ও কোন সংস্থা আমাদের নামের তালিকা করে ত্রাণ সহযোগীতা করে নাই। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে আমরা সবসময় সজাগ রয়েছি। এ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য আমরা পূর্ব থেকেই পরিকল্পনা করে থাকি।
শহরের স্বর্ণখোলা হরিজন কলোনির সূর্য্যমূখী যুবক্লাবের সভাপতি শ্যামল হরিজন জানান, প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় ক্ষতিগ্রস্থ ঘরবাড়ি নিজেদের ব্যবস্থাপনার ও অর্থায়নে মেরামত করে থাকি। দূর্যোগ মোকাবেলায় আশ্রয়নকেন্দ্রে গিয়ে আশ্রয় নেই। পরিবর্তিত জলবায়ু সম্পর্কে আমরা অবগত রয়েছি। ঝড়-তুফান- বৃষ্টি- বন্যা সহ সকল দূর্যোগ সম্পর্কে আমাদের ধারনা রয়েছে। এ সময় আমরা পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে থাকি দূর্যোগ মোকাবেলার জন্য। আমরা দূর্যোগ মোকাবেলার জন্য এলাট থাকি। তখন সকলে এক হয়ে কাজ করে দূর্যোগ মোকাবেলা করি। এ ক্ষেত্রে দূর্যোগ মোকাবেলার সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী চলি। আমরা এ পরিস্থিতিতে খাপ খেয়ে চলছি। দূর্যোগে যে ক্ষতি হয় তা পুষিয়ে নিতে সমাজের সকলের সহযোগীতা নিয়ে থাকি এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সহযোগীতাও পাই।
নতুন বাজার মুচি বাড়ির পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি নারায়ন রবি দাস জানান, দূর্যোগ মোকাবেলায় কেহ আমাদের সহযোগীতা করতে এগিয়ে আসে না। কিভাবে দূর্যোগ মোকাবেলা করবো সে সম্পর্কে কিছুই যানি না। সরকারি ত্রাণ দূর্যোগের সময় দেওয়া হয় না। পূর্বে ভিজিবি কার্ডের চাউল দেওয়া হতো। কিন্তু বর্তমানে তাও দেওয়া হচ্ছে না। দূর্যোগে ক্ষতি হলে নিজেদের বাসাবাড়ি নিজেরাই অর্থ ব্যয় করে ঠিক করতে হয়। আশ্রয়ন প্রকল্পের দলিতরা কোন ঘরবাড়ি পায়না। এসব থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। দূর্যোগের সময় নিজ বাড়িতে কষ্ট শিকার করে থাকি। কারণ আশ্রয় নিতে অন্যত্র গেলে বাড়িঘর দখলের ঝুঁকি থাকে। যার ফলে যত কষ্টই হয় তার মধ্যে নিজ এলাকায় দূর্যোগের মধ্যে থাকতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে অবগত আছি। ঝড়- বৃষ্টি- বন্যা মোকাবেলা করেই বেঁচে আছি। এ পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবেলা করে খাপ খাইয়ে আমাদেরকে চলতে হয়।
চাঁদপুর পৌরসভার ক্লিনার সুপারভাইজার নন্দ কিশোর হরিজন জানান, প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় হরিজনরা বিগত বছর গুলোতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকলেও সরকারি কোন সহযোগীতা পায়না। দলিতরা তাদের ক্ষতিগ্রস্থ বাড়িঘর নিজেদের অর্থায়নে পূর্ণসংস্কার করে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোন সরকারি সাহায্য পায়না। পৌরসভা নির্মিত ঘরে থাকলেও ক্ষতি হলে পৌরসভা তা মেরামতের উদ্যেগ নিচ্ছেনা। বড় ধরনের দূর্যোগের সময় নিজ ঘরবাড়ি ফেলে রেখে আশ্রয় নিতে হয় স্থানীয় সরকারি পাকা বিদ্যালয়ে। এ দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি তাদের যানা রয়েছে। আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মিল রেখে চলাচল ও বসবাস করে থাকি। ঝড়- বৃষ্টি- তুফান ও বন্যার সময় কষ্ট শিকার করে নিজেদের এলাকায় থাকি। যখন আর এলাকায় থাকা যায়না তখন অন্যত্র যাই।
শিরোনাম:
মঙ্গলবার , ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ২৯ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।