সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়ম-নীতির প্রতি প্রকাশ্যে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে এককালের গভীর ডোবায় সয়েল টেস্ট ও কোনো প্রকার পাইলিং ছাড়াই অনুমোদিত প্রায় ২৫ বছরের পুরানো চারতলা ফাউন্ডেশন ভবনের উপর আটতলা ভবন নির্মাণের টার্গেটে আরেক ‘রানা প্লাজা’র মতো ভয়াবহ মৃত্যুকূপ তৈরির লোমহর্ষক ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে হাজার হাজার লোকের সামনে আটতলার নকশাবিহীন চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের নাকের ডগায় অর্থাৎ চাঁদপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মুখে চাঁদপুর-কুমিল্লা সড়কের উত্তর পাশ সংলগ্ন স্থানে সম্পূর্ণ অবৈধ ও বেআইনিভাবে এ বহুতল আটতলা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। চারতলা ফাউন্ডেশন ভবনের উপর আটতলা ভবন নির্মাণের এ অপপ্রয়াসের লক্ষ্যে আজ শুক্রবার ১৮ জুলাই পাঁচতলার ছাদ ঢালাই দেয়ার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। এতে প্রায় সহস্র লোকের নিশ্চিত ভয়াবহ মৃত্যু ঝুঁকির পাশাপাশি এলাকাবাসীর মাঝে ব্যাপক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা এবং আশপাশের ভবনগুলোর লোকজনের মাঝে মারাত্মক আতঙ্কভাব দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট পৌর কর্তৃপক্ষকে কোনো রূপ তোয়াক্কা না করে দীর্ঘদিন যাবৎ পাঁচতলা ভবন নির্মাণের কাজ করায় সচেতন এলাকাবাসীর মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ, মারাত্মক অসন্তোষ ও চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। ফলে যে কোনো সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি এবং ‘রানা প্লাজা’র মতো ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। এ ব্যাপারে গতকাল বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই এ প্রতিবেদকসহ জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার বেশ ক’জন সাংবাদিক ঘটনাস্থলে সরজমিনে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে বিস্তারিত জানতে পারেন।
এলাকাবাসী জানায়, চাঁদপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মুখে পৌরসভাধীন ১৫নং ওয়ার্ডের চাঁদপুর-কুমিল্লা মহাসড়কের উত্তর পাশ সংলগ্ন স্থানে অবস্থিত মৃত মোহাম্মদ ইয়াসিন শেখ জীবদ্দশায় ১৯৯৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তারিখে ৯ শতাংশ তৎকালে সদ্য ভরাট ডোবার উপর চারতলা আবাসিক ভবন নির্মাণের জন্য তৎকালীন চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান মোঃ ইউসুফ গাজীর কাছ থেকে অনুমোদন লাভ করেন। যার (চাঁরপুর পৌরসভা কার্যালয়ের) স্মারক নম্বর হচ্ছে ১০৩৩/প্রকৌশল/নক্সা/৯৭/৭৯৮ তারিখ ১০-৯-১৯৯৭। জীবিত থাকাবস্থায় ইয়াসিন শেখ চাঁদপুর পৌরসভার প্ল্যান পাস অনুযায়ী সকল প্রকার নিয়ম-নীতি মেনেই অর্থাৎ অনুমোদিত চারতলার নকশানুযায়ী দোতলার কাজ সম্পন্ন করেন। অতঃপর তার মৃত্যুর পর তারই জ্যেষ্ঠপুত্র মোঃ শাহজাদা শেখ ওরফে সাজু শেখ চারতলা ফাউন্ডেশন ভবন নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করেন। উল্লেখ্য, উক্ত ৯ শতাংশ ৯২নং চাঁদপুর বিষ্ণুদী মৌজার সিএস ১৩৩, এসএ ২২১, বিএস ৪৯৫নং খতিয়ানভুক্ত সাবেক ৭২৩ (সিএস দাগ) ও হালে বিএস দাগ ১৩৩৪ নং ভুক্ত সম্পত্তিটি অত্যন্ত নিচু ও ডোবা ছিলো। সয়েল টেস্ট ও কোনো প্রকার পাইলিং করা ছাড়াই প্রকাশ্য দিবালোকে আটতলা বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। সাজু শেখ চাঁদপুর পৌরসভা থেকে চারতলা আবাসিক ভবনের অনুমোদন নিয়ে প্রকাশ্যে জেলা প্রশাসনের সামনে ভবনটি বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর যাবৎ ড্যামকেয়ার মনোভাব নিয়ে অব্যাহতভাবে ব্যবহার করে বিশাল অঙ্কের টাকায় লাভবান হয়েছেন।
বর্তমানে নিচতলা ও দোতলায় চাঁদপুর মেডিকেল সেন্টার নামে একটি বেসরকারি হাসপাতাল এবং চতুর্থ তলায় একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট (যেখানে প্রতিদিন শিক্ষক ও কর্মচারী এবং ছাত্র ও ছাত্রীসহ শতাধিক লোকের সমাগম ঘটে) ভাড়া দিয়ে রমরমা বাণিজ্য করে চলেছেন। একমাত্র তৃতীয় তলাটিকে সাজু শেখ তাদের আবাসিক ফ্লোর হিসেবে ব্যবহার করছেন। হঠাৎ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ এবং কলাগাছ থেকে বটগাছ হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞানকারী উক্ত সাজু শেখ বিশাল অঙ্কের টাকায় লাভবান হওয়ার জন্য চারতলা ফাউন্ডেশনের আবাসিক বাড়ির উপর সম্পূর্ণ অবৈধ ও বেআইনিভাবে আটতলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে দীর্ঘদিন ধরে পাঁচতলার স্থাপনা নির্মাণ শেষে বর্তমানে ছাদ ঢালাইয়ের যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। তিনি আজ শুক্রবার যে কোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও পাঁচতলার ছাদ ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন করবেনই। চাঁদপুর পৌরসভা কর্তৃক অনুমোদিত নকশার বাইরে অর্থাৎ চারতলা ফাউন্ডেশনের উপর আটতলা ভবন নির্মাণ করা হলে তা আরেক ‘রানা প্লাজা’র ভয়াবহ ঘটনার মতই হবে বলে অভিজ্ঞ ও পর্যবেক্ষক মহলের জোর আশঙ্কা। প্রকাশ্যে এহেন সম্পূর্ণ অবৈধ ও বেআইনিভাবে বর্ধিত নির্মাণ কাজের ব্যাপারে চাঁদপুর জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও পৌর কর্তৃপক্ষের কোনো প্রকার মাথা ব্যথা নেই বলেই অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়। অথচ পৌর এলাকায় এ বিষয়টি সার্বক্ষণিক ও সক্রিয়ভাবে মনিটরিং করার জন্য পৌরসভার প্রকৌশল বিভাগের আলাদা একটি টিম রয়েছে।
চাঁদপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মুখে বা বিপরীতে অত্যন্ত জনবহুল ও ব্যস্ততম এলাকায় উক্ত ভবনের নিচতলায় ৪টি দোকান, নিচতলার অপর পাশে ও দোতলায় অবস্থিত হাসপাতাল এবং পলিটেকনিকে সবসময় কম-বেশি ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ লোক অবস্থান করে। এছাড়া ভবনটির পশ্চিম পাশে জনতা ব্যাংক ও মেরি স্টোপ ক্লিনিকসহ ৩/৪টি আবাসিক ভবন, উত্তর পাশে এক সময়ের নিচু ডোবা ভরাট করে তথায় নির্মিত ৮/১০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও পূর্ব পাশে তিনতলা বিশিষ্ট একটি আবাসিক ভবন রয়েছে। চারতলা ফাউন্ডেশনের উপর অবৈধভাবে আটতলা ভবন নির্মিত হলে ভবনটি যে কোনো সময় আশপাশের ভবনগুলোর উপর ভয়াবহভাবে ধসে পড়ে ‘রানা প্লাজা’র মতই মহাবিপর্যয় ডেকে আনবে।
কে এই সাজু শেখ?
এককালের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী প্রয়াত মোহাম্মদ ইয়াসিন শেখের ২ পুত্র ও ৪ কন্যার মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া মোঃ শাহজাদা শেখ ওরফে সাজু শেখ সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে চাকুরি করে অবসর গ্রহণ করেন। পিতার ক্ষুদ্র আয় এবং তার চাকুরির যৎসামান্য টাকায় হতদরিদ্র মোহাম্মদ ইয়াসিন শেখের বড় সংসারে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানো’র মতো অবস্থা ছিলো। সাজু শেখের বড় বোনের স্বামী মারা গেলে মৃত স্বামীর পেনশনসহ আনুষঙ্গিক টাকা দিয়ে বড় ভাগিনা মিঠুকে ১৯৯২ সালে মালয়েশিয়া পাঠানো হয়। মিঠু ১৯৯২ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সুদূর মালয়েশিয়ায় কঠোর পরিশ্রম করে ৬৫ লাখ টাকা তার মায়ের কাছে পাঠায়। উক্ত টাকার লোভে সাজু শেখ অত্যন্ত সুকৌঁশলে বিধবা বড় বোনকে তার স্বামীর বাড়ি থেকে নিজেদের পৈত্রিক বাড়িতে নিয়ে আসেন। অত্যন্ত সহজ-সরল প্রকৃতির বড় বোন পিত্রালয়ে আসলে তাকে ফুসলিয়ে পিতার ওয়ারিশের পাশাপাশি অতিরিক্ত সম্পত্তি হিসেবে আলাদাভাবে একটি ফ্ল্যাট দেয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়ে জ্যেষ্ঠ পুত্র মিঠুর উক্ত কষ্টার্জিত পুরো ৬৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন বলে একটি বিশ্বস্ত সূত্রে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বড় বোনের পুত্রের টাকায় ছোট ভাই রিপন শেখকে সৌদি আরবে পাঠিয়ে দেশে থাকা একমাত্র পুত্র হিসেবে অর্থাৎ রিপন শেখের অনুপস্থিতিতে তার পিতা মোহাম্মদ ইয়াসিন শেখকে দীর্ঘ অসুস্থতার মৃত্যু শয্যায় অনেকটা জিম্মি করে ৯ (নয়) শতাংশ সম্পত্তি গোটা চারতলা ভবনসহ নিজের (সাজু শেখের) ও সৌদি আরবে থাকা ছোট ভাই রিপন শেখের নামে একতরফাভাবে লিখিয়ে নিয়ে সম্পূর্ণ অবৈধ ও বেআইনিভাবে ৪ বোনকে তাদের ন্যায্য পৈত্রিক হক সম্পত্তি থেকে মারাত্মকভাবে বঞ্চিত করে। সে সাথে বড় বোন থেকে নেয়া ভাগিনা মিঠুর সারাজীবনের কষ্টার্জিত ৬৫ লাখ টাকা প্রকাশ্যে আত্মসাৎ করার দুঃসাহস দেখায়।
এতে মানসিকভাবে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে মনের কষ্টে মরহুম মোহাম্মদ ইয়াসিন শেখের জ্যেষ্ঠ কন্যা অর্থাৎ মিঠুর মা এবং মিঠুসহ তাদের পরিবারের সদস্যরা এ বাড়িতে তথা পিতা ও নানার বাড়িতে আসা-যাওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। এছাড়া মরহুম মোহাম্মদ ইয়াসিন শেখের কনিষ্ঠা কন্যার জামাতা স্থানীয় আলম মিজির বড় শ্যালক সাজু শেখ উক্ত বাড়ি নির্মাণের সময় আলম মিজিকে একটি দোকান দিবে বলে আলম মিজির কাছ থেকে আর্থিকসহ সর্বপ্রকার সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেন। কিন্তু গভীর দুঃখের বিষয়, ভবন নির্মাণ শেষে ছোট বোনের জামাতা আলম মিজিকে দোকান না দিয়ে এবং তার পাওনা অর্থ ফেরৎ না দিয়ে তাকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে জোর করে শ্বশুর বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রতারিত আলম মিজি প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়ে অবশেষে হার্ট অ্যাটাক করে মৃত্যুবরণ করেন। অত্যন্ত বদ মেজাজী ও উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির উক্ত সাজু শেখের বিরুদ্ধে এলাকার লোকজনের সাথে খারাপ ব্যবহার করাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া কথায় কথায় এলাকার সকলকে দাপট দেখিয়ে বেড়ানো সাজু শেখ প্রায়ই দম্ভের সাথে বলেন যে, তার নাকি সেনাবাহিনী ও পুলিশ প্রশাসনের উচ্চ পদে অনেক লোক রয়েছে। কেউ তার অন্যায় কাজের বাধা হয়ে দাঁড়ালে তাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলা দিয়ে ১৩ শিকের ভেতরে ঢুকানো তার জন্য অত্যন্ত মামুলি ব্যাপার বলে সকলকে হুমকি-ধমকি দিয়ে থাকেন। এ ব্যাপারে মোঃ শাহজাদা শেখ ওরফে সাজু শেখের বক্তব্য জানার জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সরজমিনে তার দোকানে গিয়ে খোঁজ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত মোবাইল ০১৫৫৮৪১০৮৫৪ নম্বরে বার বার ফোন করেও বন্ধ পাওয়া যায়।
এছাড়া এ ব্যাপারে গতকাল চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিকের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, এ ব্যাপারে যদি উপযুক্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে অবশ্যই প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ব্যাপারে চাঁদপুরের পুলিশ সুপার মোঃ আমির জাফরের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি অবশ্যই বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি দুঃখজনক অধ্যায়। এ ধরনের কোনো অনিয়মের অভিযোগ চাঁদপুরে পাওয়া গেলে অবশ্যই কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এহেন বিষয়ে সরাসরি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হিসেবে চাঁদপুুর পৌরসভার বর্তমান মেয়র মোঃ নাছির উদ্দিন আহাম্মেদ এ প্রতিবেদককে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানান, অনুমোদিত নকশা ও পৌর অনুমোদনের বাইরে যাওয়ার কারো কোনো সুযোগ নেই এবং পৌর আইনের বাইরে কাউকে কোনো অন্যায় কাজ করার সুযোগ দেয়া হবে না। এ ব্যাপারে যদি কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে পৌর নীতিমালা অনুযায়ী কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এমতাবস্থায় এহেন জনগুরুত্বপূর্ণ ভয়াবহ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের শুধুই কি ‘কাগুজে বাঘ’ হয়ে থাকবে না কি ‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম’ অবশেষে কোন্ পন্থা গ্রহণ করা হবে তা-ই এখন দেখার বিষয়।