চাঁদপুরে দলিত জনগোষ্ঠীর নিজস্ব আবাসন নেই ॥
তারা পৌরসভা-রেলওয়ে জায়গায় ২’শ বছর বসবাস ॥ বর্তমানে পশুর মতো তাদের জীবন জাপন
শওকত আলী
চাঁদপুরে বসবাসরত দলিত জনগোষ্ঠীর কয়েক হাজার মানুষের নিজস্ব কোনো আবাসন ব্যবস্থা নেই। তারা বাংলাদেশ রেলওয়ের নিজস্ব সম্পত্তি ও চাঁদপুর পৌরসভার নিজস্ব হরিজন কলোনীতে প্রায় ২’শ বছর যাবৎ বসবাস করছে। তারা বৃটিশ শাসন আমন থেকে পূর্ব পুরুষের অধিকার নিয়ে বংশক্রমান্বয়ে প্রায় ২’শ বছর যাবৎ বসবাস করছে বলে দলিতরা জানান। সীমিত জায়গায় ২’শ বছর বসবাস করায় তাদের বংশ বৃদ্ধি হওয়ায় এখন তারা হাঁস, মুরগী ও অন্যান্য পশুর মতো একই ঘরে ৩-৪টি পরিবারের ৮-১০জন একই সাথে বসবাস করে জীবন কাটাতে হচ্ছে। আবাসন সংকটের পাশাপাশি তাঁরা টয়লেট ও পানির সমস্যায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট শিকার করতে দেখা যাচ্ছে। তারা এদেশে একখন্ড ভূমি মালিকানা পাচ্ছে না। বর্তমান বর্ষা মৌসুমে তাদের সমস্যার অন্ত নেই। চালের উপর ফুটা হয়ে যাওয়া, বৃষ্টির পানিতে একাকার হয়ে যায় ঘরের বিতরের ফ্লোর। মারাত্বক ঝুঁকির মধ্যে প্লাষ্টিক দিয়ে মাথা রক্ষা করে, বৃষ্টি দিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে। শিশু ও মহিলারা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে। চাঁদপুর শহরের ৩টি হরিজন কলোনী, একটি ঋষি কলোনী ও কয়েকটি মুচি বাড়িতে ঘুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চাঁদপুর শহরের দলিত সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার শিশু-মহিলা ও পুরুষ স্বাধীনতার পর থেকে অবহেলিত অবস্থায় জীবন যাপন করে যাচ্ছে। তাদের আবাসন সমস্যা টুকু সবচেয়ে বেশি। যে কোনো মানুষ বসবাস করার প্রয়োজনে কয়েকটি রুমের প্রয়োজন হয়ে থাকে। আর দলিত সম্প্রদায়ের মানুষেরা একই ঘরে লজ্জা বির্ষজন দিয়ে একই ঘরে ৪-৫টি পরিবার বন্দি কারাগারের মতো বাস করছে। এরা, এদের প্রয়োজন থাকলেও অন্যত্র গিয়ে বসবাস করতে পারছে না বৈষর্ম্যরে কারণে। সকাল বেলা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে সীমিত টয়লেটের কারণে লাইন ধরে দাড়িয়ে থাকতে হয়। টয়লেটগুলোর ভিতরে স্যাঁত স্যাঁতে অবস্থা তার মধ্যে দরজা না থাকায় প্লাষ্টিক বা কাপড় টানিয়ে ব্যবহার করতে তাদের। তীব্র পানি সংকট। বাহির থেকে পানি আহরণ করতে হয়। টয়লেটগুলোতে অস্বাস্থ্যকর অবস্থা বিরাজমান। প্রয়োজনের তুলনায় পানির কল নেই। রেলওয়ে কলোনীতে একটি পানির কল ও পুরাণবাজার হরিজন কলোনীতে পৌরসভার একটি করে পানির কল রয়েছে। যে কলটিও অধিকাংশ সময় নষ্ট থাকায় পানি সংকট লেগেই রয়েছে। বিশুদ্ধ পানি না থাকায় শিশুরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। এছাড়া এ পরিবেশের মধ্যে শিশুরা পড়া-শুনা করতে হয়। পুরাণবাজার হরিজন কলোনীর প্রায় ৫’শ মানুষ সারাক্ষণ আতংকে থাকতে হয়। এখানে আইন শৃঙ্খলার মারাত্বক অবনতি ঘটছে প্রতিদিন। এক শ্রেণি দলিত লোকেরা চোলাই মদ বিক্রি করায় এখানে বহিরাগত মানুষের বিচরণের ফলে সাধারণ হরিজনরা মারাত্বক ঝুঁকির মধ্যে ও নিরাপত্তাহিনতায় রাত্রি যাপন করতে হচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এখানকার আইন শৃঙ্খলা দিন দিন ভেঙ্গে পরছে। মহিলারা এখানকার সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি হয়ে নির্যাতিত হচ্ছে বলে এখানকার ভুক্তভোগী দলিত সম্প্রদায়ের নারীরা অভিযোগ করে জানান।
চাঁদপুর রেলওয়ে হরিজন কলোনীর শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক বিধান চন্দ্র হরিজন (জনি) বলেন, এখানে ৬’শ লোকের বসবাস। এদের মধ্যে ভোটার রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩’শ। হরিজনদের বসবাসের জন্য রেলওয়ে এখানে ৩৫টি রুমের একটি আবাসন কলোনীর ব্যবস্থা করেছে, প্রায় ২’শ বছর পূর্বে। এর মধ্যে ২৫টি কোয়াটার বসবাস অনুপযোগী। ১০টি কোয়াটারে কষ্ট স্বীকার করে বসবাস করতে হচ্ছে এখানকার ৬’শ দলিত পরিবারদের। ২৫টি জরাজীর্ণ কোয়াটারে এখানকার হরিজনরা ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে। প্রায় ৬শ’ লোকের নৃত্যদিন ব্যবহারের জন্য এখানকার দলিতদের মারাত্বক কষ্ট স্বীকার করতে হয়। কয়েক’শ লোকের নিত্যদিনের পানি ব্যবহারের জন্য মাত্র একটি রেলওয়ের পানির কল রয়েছে। পানি সরবরাহ হচ্ছে অপ্রতুল। তার মধ্যে মাসে ১০/১২ দিন কলটি নষ্ট থাকে। এখানকার মহিলারা বাহির থেকে পানি সংগ্রহ করে তাদের নিত্যদিনের চাহিদা পূরণ করে। রেলওয়ে এলাকায় বসবাসরত হরিজনরা ২শ’ বছর বসবাস করলে ও তারা জমির মালিকানা পায়নি। বর্তমানে এই সম্পত্তির মালিক বাংলাদেশ রেলওয়ে। বৃটিশ আমলে ভারতের মাদ্রাজ থেকে হরিজনদের এদেশে আনার পর তাদের বসবাসরত এই সম্পত্তি হরিজনদের নামে দেওয়া হলেও ৭১ সালের পর সরকার তা’ নিয়ে যায় বলে এখানকার দলিত হরিজনরা জানান। বর্তমান বর্ষা মৌসুমে এখানে বসবাসরত দলিতদের কোয়াটারের চালের উপর দিয়ে অনাবরত পানি পরতে থাকে। তবুও কষ্ট শিকার করে বসবাস করতে হচ্ছে তাদের। সরকারি সম্পত্তি হলেও সরকার এসব কোয়াটার মেরামতে কোনো উদ্যোগ বা ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। চাঁদপুরের যে কয়টি হরিজন কলোনী রয়েছে এসব কলোনীগুলোতে এখানকার বসবাসরত হরিজনদের জন্য সরকারের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর একটি বাড়ি একটি খামারের প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রয়োজন। সে প্রকল্পের এজেন্ডার হিসাবে ইউনিয়ন থেকে গ্রাম পর্যায়ে আবাসন কার্যক্রম চলছে। একই নিয়মে যদি চাঁদপুরের হরিজন কলোনীগুলোতে পৌরসভার মাধ্যমে আমরা প্রধান মন্ত্রী অগ্রাধিকার ফান্ড থেকে আমাদের আবাসন ও বসবাসের সমাধান করলে সরকারের কাছে দেশের ৮০ লক্ষ দলিত কৃতজ্ঞ থাকবো বলে বিধান চন্দ্র হরিজন (জনি) জানান।
পুরাণবাজার হরিজন যুব ক্লাব সভাপতি শ্যামল চন্দ্র হরিজন জানান, আমাদের কলোনীতে পৌরসভা কর্তৃক হরিজন কলোনী নির্মানের সময় ৫০টি রুম বিশিষ্ট লম্বা হরিজন কলোনী নির্মান করা হয়েছিল। ৫০টি পরিবারের নামে ৫০টি কোয়াটার বরাদ্দ দেওয়া হয়। বর্তমানে এ কলোনীতে প্রায় ১৫০টি পরিবারের প্রায় ৫শ’ জন মানুষ বসবাস করছে। একই ঘরে মা-বাবা, ভাই বোন পরিবার পরিজন নিয়ে ১০-১২ জনের গাদা গাদি করে বসবাস করতে হচ্ছে। অনেকে বাসস্থান সংকটে পৌরসভায় চাকুরি করেও কোয়াটার পাচ্ছে না। পৌর কর্মচারী রয়েছে ১৫০ জন। কিন্তু এখানে কোয়াটার রয়েছে ৫০টি। সাবেক পৌর চেয়ারম্যান ভাষা সৈনিক প্রয়াত আব্দুল করিম পাটওয়ারীর আমলে এখানে ৩৫টি পাঁকা কোয়াটার নির্মিত হয়। পরবর্তীতে বাকি ১৫টি কোয়াটার হরিজনরা নিজ খরচে নির্মান করে। পুরাণবাজার হরিজনরা এপারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষ করে নতুন বাজারেও কাজ করতে হয়। এ কাজের জন্য তারা মাত্র ৯শ’ টাকা প্রতিমাসে পৌরসভা থেকে পেয়ে থাকে। বর্তমানে বৈদ্যুাতিক বিল প্রতি কোয়াটারে ৭শ’ টাকা দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন পৌর মেয়র। এখানকার ৫শ’জন দলিত হরিজনদের জন্য ৩টি পুরুষ ও ৩টি মহিলা টয়লেট রয়েছে। এসব টয়লেটের দরজা নেই, ভিতরে পানির কলও নেই। বাহির থেকে পানি নিয়ে ও টয়লেটে কাপড় ও প্লাস্টিক আবরণ দিয়ে এই টয়লেটগুলো ব্যবহার করতে হয়। পৌরসভার পানি সরবরাহের জন্য একটি কল রয়েছে তাও অধিকাংশ সময় নষ্ট থাকে। বাহির থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয় প্রয়োজন মিটানোর জন্য। ১শ’ বছরের পুরাতন এসব কোয়াটার সংস্কার করা হচ্ছে না দীর্ঘদিনেও। বর্তমান বর্ষা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টি হলেই ছাদ চুষে পানি পরে। হরিজনরা ১শ’ বছর এ সম্পত্তি ভোগ দখল করলেও এর মালিকানা তাদের নেই, এ সম্পত্তির মালিক চাঁদপুর পৌরসভা। ঝড় তুফানের সময় ঝুঁকি নিয়ে ও অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি নিয়ে দলিতদের এখানে বসবাস। পুরাণবাজার হরিজন কলোনীর হরিজনরা প্রায় ৪ লক্ষ টাকা ব্যায় করে গ্যাস সংযোগ এনে ব্যবহার করছে। সে গ্যাস সংযোগও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গ্যাস ঠিকাদার সরকারি নিয়ম মোতাবেক এখানে গ্যাস পাইপ স্থাপন করে নাই। পৌরসভার পক্ষ থেকে জরাজীর্ন এসব কোয়াটার মেরামত করা হচ্ছে না। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ বা সহযোগিতা নেই। এ কলোনীর প্রায় ৩০জন শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও ২০জন কিশোর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ও ১২ জন কিশোর কলেজে পরাশুনা করে। এখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে শিশুরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ কলোনীটিতে বিশুদ্ধ পানির অভাব রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এদের জীবন মান উন্নয়নের জন্য সুন্দর পরিবেশ বাসস্থান ও মাদক মুক্ত এলাকা চাচ্ছে এখানকার দলিতরা। এছাড়া শিশুদের খেলা ধুলার জন্য একটি মাঠের প্রয়োজন বলে তারা জানান। এ কলোনীতে আইন শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। রাতের বেলা এরা মারাত্বক আতংকের মধ্যে রাত্রী কাটাতে হয়। এখানে বহিরাগদের প্রভাব রয়েছে প্রচুর। মাদকেরও প্রভাব রয়েছে। রাতের বেলা এখানকার কলোনীর গেইট বন্ধ রাখা যায় না মাদক সেবীদের অত্যাচারে। তাই এ এলাকার হরিজনরা পৌর কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করে তাদেরকে সুন্দর পরিবেশ ও আইন শৃঙ্খলার প্রতি বেশি নজর দিবেন বলে তারা তাদের মত পোষণ করেণ।
স্বর্ণখোলা সুর্যমুখি যুবক্লাব সভাপতি শ্যামল হরিজন জানান, চাঁদপুর পৌরসভা সাবেক চেয়ারম্যানের আমলে পৌরসভা থেকে ৩৫টি একতলা ভবন নির্মান করা হয়। এছাড়া হরিজনদের নিজস্ব অর্থায়নে ৬৫টি ছোট-বড় ঘর নির্মান করা হয়েছে। প্রায় ১শ’টি ঘরে ৬শ’ লোকের বসবাস। একই ঘরে ৪-৫টি পরিবার বাস করছে গাদা গাদি করে। বৃষ্টির সময় ছাদ ধসে পানি পরে। ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে। যে কোন সময় এ ছাদ ভেঙ্গে যেতে পারে। ৬শ’ লোকের জন্য ৪টি টয়লেট রয়েছে। এসব টয়লেটের কোনো দরজা নেই। গ্যাস সংযোগ নেওয়া হয়েছে নিজেদের প্রচেষ্টায়। বর্তমানে এই মাস থেকে বৈদ্যুতিক বিল দিতে হবে ৭শ’ টাকা করে। মাসিক বেতন পাব ৯শ’ টাকা। ২শ’ টাকা দিয়ে সংসার, ছেলে-মেয়ের পড়া শুনা ও চিকিৎসা করাবো কি করে। পৌর কর্তৃপক্ষ বহু বছর পূর্বে ৩৫টি ঘর সামান্য মেরামত করলেও বর্তমানে ভবনের অবস্থা খুবই জরাজীর্ন। পৌর কর্তৃপক্ষ হরিজনদের অভিযোগের পরও সংস্কার করছেন না। বৃষ্টির পানি পরে বসবাস অনুপযোগি হয়ে পড়েছে এ কলোনীর বাসিন্দাদের। যে বেতন পাই তা দিয়ে সংসার চলে না। এখন আবার বিদ্যুৎবিল দিতে হবে ৭শ’ টাকা, সংসার চলবে কি করে।
নতুন বাজার সিএসডি গোডাউন সংলগ্ন মুচি বাড়ির পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি নারায়ন চন্দ্র রবি দাস জানান, এ কলোনীতে প্রায় শিশুসহ ২শ’ লোকের বসবাস। এখানে স্বাধীনতার ১শ’ বছর পূর্বে আমাদের পূর্ব পুরুষের বসবাস ছিল। এখানে প্রায় ২০ শতাংশ জায়গা রয়েছে। এ সম্পত্তির মালিক আমরা রবিদায় সম্প্রদায়ের লোকেরা। আমাদের এ কলোনীর বসবাসরত এলাকাবাসীর সহযোগিতার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য পাই না। বর্তমান বর্ষা মৌসুমে বাসা বাড়ি ঠিক করতে না পারায় বৃষ্টির পানি দিয়ে কষ্ট শিকার করে বসবাস করতে হচ্ছে। ঝড় তুফানের সময় মারাত্বক ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হয়। একটি নিদিষ্ট জায়গায় প্রায় ২শ’ লোক গাদাগাদি করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করছি। সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের রুম বরাদ্দ চেয়ে ও কোনো রুম না পেয়ে আমরা দীর্ঘ বহু বছর যাবৎ অমানবিক ভাবে জীবন যাপন করছি। এখানে বিশুদ্ধ পানির অভাব রয়েছে। শিশুরা বিশুদ্ধ পানির অভাবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাই সরকারি ভাবে সহযোগিতার আশা করছেন মুচি বাড়ির রবি দাস সম্প্রদায়ের লোকেরা।