মিজানুর রহমান রানা
ইলিশ নিধনের মহোৎসব নয়, আমরা চেষ্টা করেছি মানুষ যাতে এ ব্যাপারে সচেতন হয়
———— জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সফিকুর রহমান
‘ইলিশ নিধনের মহোৎসব নয়, আমরা চেষ্টা করেছি মানুষ যাতে মা ইলিশ না ক্রয় করে এবং জেলেরা যাতে এ ব্যাপারে সচেতন হয় এবং মা ইলিশ না ধরে’। চলতি বছরের প্রধান প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান শেষে এমনই বললেন চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সফিকুর রহমান। তিনি আরো বলেন, তবে ১০০ ভাগ সফল না হলেও আমরা ব্যর্থ একথা বলবো না। কারণ আমরা সাধারণ মানুষ, মা ইলিশ ক্রেতা এবং জেলেদের মধ্যে প্রতীকী একটি বিষয় জানিয়ে দিয়েছি যে, মা ইলিশ ধরা অপরাধ।’
মা ইলিশ রক্ষায় অভিযানে এবছর সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গুলো জোর তৎপরতা চালালেও আশনুরূপ ফল পাওয়া যায়নি বলেই মনে করছেন জেলার সচেতন মহল। ইলিশ রক্ষায় চাঁদপুর- হাইমচর থেকে চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত পদ্মা-মেঘনাকে সরকার ইলিশ প্রজননের অভয় আশ্রম ঘোষণা করে ৫ অক্টোবর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত নদীতে সকলপ্রকার জাল ফেলা ছিলো নিষিদ্ধ। এবছরেও জেলা টাস্কফোর্স, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা চাঁদপুর সদর দল, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড হাইমচর উপজেলা, মতলব উত্তর উপজেলা, মতলব দক্ষিণ উপজেলা ও বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীসহ মোট ৭টি সরকারি সংস্থা নৌ-পথ ও সড়ক পথে অভিযান চালায়। অথচ এত কিছুর পরেও প্রশাসনের চোখে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও একশ্রেণির লোভী জেলে নদীতে জাল ফেলে অবাধে মা ইলিশ নিধনের মহা-উৎসবে নেমে পড়ে।
বুধবার চাঁদপুরের জেলা মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক লোক দেখানো একটি প্রতিবেদন দেখানো হয়েছে। এ প্রতিবেদনে বিগত ১০ দিনের মূল হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে ৭টি সংস্থা মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানে কাজ করেছেন এমনটি উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- এতো অভিযান সত্ত্বেও চাঁদপুরে মা ইলিশ সংরক্ষণের নামে নিধনের মহোৎসব ছিলো দেখার মতো।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কোনো কোনো বাহিনী মা ইলিশ সংরক্ষণে ব্যাপক অভিযানে চালিয়েছে। সাধারণ জনগণ জেলেদের কাছ থেকে মাছ ক্রয় করে বাড়ি ফেরার পথে আইনশৃংখলা বাহিনী ব্যাগ টেনে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আথচ অজ্ঞাত কোনো কারণে ওই সকল সংস্থার সম্মুখে জেলেরা মাছ বিক্রি করলেও তারা যেন দেখেও না দেখার ভাণ করে চলে আসে। আবার কোনো কোনো সংস্থা নদীতে অভিযান চালিয়ে শত শত জেলেদের মধ্যে থেকে ৫/৭জনকে আটক করে সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে হাজির করিয়ে বাহাবা নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তে ও দেখো গেছে। জেলে আটক হলেও ওই সকল অভিযানে ইলিশের দৃশ্য ৫/১০ কেজি বেশি নয়। কিন্তু যখনই এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় তখন ওইসকল বাহিনী বা সংস্থার কর্মকর্তাদের কাছে উত্তর আসে মাছ ছিলো না ট্রলারে। নাম প্রকাশে অনিশ্চুক কোন কোন জেলের কাছে জানতে চাইলে তারা জানান ভিন্নকথা। তারা জানা সংশ্লিস্ট বাবিনি গুলো ১ মণ মা ইলিশ আটক করে ১০/১৫ কেজি ইলিশ দেখানো হয়। আর আটককৃত বাকি ইলিশ মাছগুলো নদী থেকেই হাওয়া হয়ে যায়।
এদিকে গতকাল বুধবার ছিলো ১০ দিনব্যাপী এই অভিযানের শেষ দিন। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. সফিকুর রহমানের স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ৫ অক্টোবর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত জেলায় মোট ৫৭টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে। এ সকল মোবাইল কোর্টে জেলা টাস্কফোর্স, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা চাঁদপুর সদর দল, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড হাইমচর উপজেলা, মতলব উত্তর উপজেলা, মতলব দক্ষিণ উপজেলা ও বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীসহ মোট ৭টি দল অংশ নেয়। অভিযান হয় ১০৯টি। ১০২টি ঘাটে এরা অবতরণ করে। ২৭৪টি মাছ ঘাট, ৬৯৮টি মাছের আড়ত, ৬৯৮টি বাজার তারা পরিদর্শন করে। উল্লেখিত সংস্থাগুলো বিগত ১০ দিনের অভিযানে ৪.১৯৪ মে. টন ইলিশ আটক করে । পাশাপাশি জব্দ করা হয় ৪০.২৩০ লক্ষ মিটার কারেন্ট জাল। যার আনুমানিক মূল্য ৮০ হাজার ৪ ৬০ টাকা। আটজ মাছ গুলো এতিম খানা ও গরিব-দুস্থদের মাঝে বিতরন ও জব্দ কৃত জাল আগুনে পুরিয়ে বিনষ্ট করা হয়েছে বলে ও ঐ প্রতিবেদনে উল্লেখ্য করা হয়েছে। অপরদিকে এসব অভিযানে মোট ১৩৫ জন জেলেকে আটক করা হয়। দের মধ্যে ১১জনকে ২ বছর, ৮৮জনকে ১ বছর এবং বাকি ৩৬জন জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করা হয়। এছাড়াও এদের কাছ থেকে সের্বমোট ৩ লাখ ২২ হাজার ৯শ’ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। আর মামলা দেওয়া হয়েছে ২১৬টি।
এ সকল প্রতিবেদন বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. সফিকুর রহমান জানান, এবারের মা ইলিশ রক্ষা কার্যক্রম প্রত্যাশিতভাবেই শেষ হয়েছে। যদিও আমরা আরো বেশি প্রত্যাশা করেছি। আমাদের প্রত্যাশা ১শ’ভাগ পূরণ হয়নি। কারণ হিসেবে তিনি দেখান লোকবল সংকট, বাজেট বরাদ্ধ কম, প্রযাপ্ত নৌযান সংকট। তিনি আরো জনান আমরা যেভাবে চেষ্টা করেছি মা ইলিশ রক্ষা করতে সেভাবে জনগণ ও জেলেরা তাতে অংশগ্রহণ বা আমাদের সহযোগিতা করেনি। তবে এ ব্যাপারে স্থানীয় চেয়ারম্যান বা জনপ্রতিনিধিদের যথেষ্ট আন্তরিকতামূলক কার্যক্রম পেয়েছি। যা আমাদের মা ইলিশ রক্ষা কার্যক্রমকে প্রাণবন্ত করেছে। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আটককৃত জালগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আর ৩৬৩০ কেজি মাছ এতিমখানা ও দুস্থদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। আর মাত্র ৩৪৭ কেজি কোল্ড স্টোরে রক্ষিত রয়েছে।