চাঁদপুরে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার অভাব ॥ এরা বাঙ্গালির সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী
শওকত আলী ঃ
চাঁদপুরে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। তারা নিরাপত্তা হীনতায় ভোগছে দীর্ঘ বহু বছর যাবত। তারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আইন নিয়ন্ত্রনকারী কর্তৃপক্ষ ও প্রভাবশালীদের পিছনে হেটেও তাদের বিচার তথা নিরাপত্তা পাচ্ছেনা। তারা এদেশের এক শ্রেণীর প্রভাবশালী ভূমীদস্যু, দূর্বৃত্ত ও সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে জিম্মী জিবন যাপন করছে। তারা সবসময় আতংক ও ভয়ের মধ্যে তাদের সন্তানদের নিয়ে বসবাস করতে হয়। প্রশাসন তাদের অভিযোগ গ্রহণ করলেও অভিযোগের তদন্ত করে কোন প্রকার সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে না বলে জানান সংখ্যালঘু নেতারা। সংখ্যালঘুদের জায়গা জোড় করে ভূয়া কাগজপত্র ও দলিল সৃষ্টি করে চাঁদপুরে দখল করে নিচ্ছে এক শ্রেণীর ভূমীদস্যু প্রভাবশালী চক্ররা। তাই বাধ্য হয়ে অনেক সংখ্যালঘু নিজেদের জায়গা কম মূল্যে বিক্রি করে দিয়ে ভারত চলে যাচ্ছে। অনেকে জায়গা বিক্রি করে টাকা ব্যাংকে রেখে ব্যাংক সুদ গ্রহণ করে, তা দিয়ে কষ্ট শিকার করে ভারা বাসায় থাকছে। অনেক সংখ্যালঘু পরিবার প্রভাবশালীদের ভয়ে জায়গা বিক্রি করতে না পেরে ভয়ে আতংকে দিন কাটাচ্ছে। আইন মোতাবেক ও দলিল মূলে চাঁদপুরে সংখ্যালঘুদের বহু সম্পত্তি রয়েছে। সে সম্পত্তি তারা ভোগ করতে পারছে না। চাঁদপুরে সংখ্যালঘু সংখ্যা অনেক বেশী। তবুও তারা সাহস করে কোন কাজ করতে মনযোগী হচ্ছে না। চাঁদপুর শহরের সংখ্যালঘু অধ্যাশিত এলাকা হিসেবে শহরের পুরাণ বাজারে অসংখ্য সংখ্যলঘু পরিবার রয়েছে। এছাড়া শহরের অপর অংশের নতুন বাজার, বড় স্টেশন, বকুল তলা, পাল বাজার এলাকা, পাল পাড়া, ঘোষ পাড়া, আদালত পাড়া সহ শহরের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষের বসবাস রয়েছে। এরা বাংলদেশের কৃষ্টির সাথে মিল রেখে বাংলা নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ সহ সব ধরনের বাঙ্গালী সংস্কৃতির অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। এ বছর সংখ্যালঘুরা পান্তা ইলিশ, পুজা আর্চনা, শিশুদের খেলা ধুলা, চিত্রাংকন সহ বিভিন্ন প্রতিযোগীতার মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী সংস্কৃতির কৃষ্টি ধরে রাখতে উৎসাহ উদ্দিপনার মধ্য দিয়ে বাঙ্গালীর সংস্কৃতিকে পালন করে এ দেশের ঐতিহ্য ধরে রাখছে।
এ ব্যাপারে রেলওয়ে বড় স্টেশন হরিজন কলোনির শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ মহাবীর মন্দির কমিটির সাধারাণ সম্পাদক ও চাঁদপুরের হরিজন পঞ্চায়েত কমিটির কোষাধক্ষ্য বিধান চন্দ্র হরিজন জানান, বৃটিশ আমলে এ দেশের মানুষের কল্যানে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য হরিজনদের ভারতের মাদ্রাজ থেকে আনা হয়েছিলো। তখন তাদের নিজস্ব বসবাসের জন্য কলোনী, স্থাপন ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যাবস্থা ছিলো রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। স্বাধীনতার পূর্বে যে পরিমান নিরাপত্তা ছিলো বর্তমানে সে পরিমান নিরাপত্তা ব্যাবস্থা আমাদের নেই। আমরা এখন নিরাপত্তহীনতা ও ঝুঁকিতে বসবাস করছি। চাঁদপুরের সকল স্থান থেকে রেলওয়ে হরিজন কলোনীটি নিরাপত্তার দিক থেকে অন্ধকারে রয়েছে। আমরা সর্ব সময় টেনশন ভোগ করছি। কোন সমস্যায় পরলে স্থানীয় প্রশাসনকে জানালে তারা এসে ব্যাবস্থা গ্রহণ করেন। রাজনৈতিক নেতাদের কাছে গেলে সহযোগীতা পাওয়া যায়। প্রশাসন ও নেতারা নিজ থেকে আমাদের কোন খবর নেওয়া দায়িত্ব মনে করেন না। স্থানীয় যুব সমাজের কাছে আমরা এক প্রকার জিম্মি অবস্থায় জীবন যাপন করছি। এই এলাকার যুবকরা বেপরোয়া। তাই আমরা তাদের উৎপাতে আতংকে থাকতে হয় সব সময়। এসব যুবকদের উৎপাতে ও অত্যাচারে আমাদের জীবন অতিষ্ট হয়ে পরেছে। এসব যুবকদের মধ্যে ধর্মীয় প্রতিহিংসা কাজ করছে। এছাড়া সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হরিজনরা নিজেদের কৃষ্টি কালচার ও বাঙ্গালী সংস্কৃতি লালন করছে। বাংলাদশের সব অনুষ্ঠান পহেলা বৈশাখ সহ সকল বাঙ্গালী উৎসব আমরা পালন করে থাকি। বাংলার সংস্কৃতিতে আমরা মিশে থাকতে চাই। তাই এ বছর পহেলা বৈশাখ পালন করেছি পান্তা ইলিশ ও গনেষ পূজার মাধ্যমে। এছাড়া আমাদের শিশুদেরকে বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে জড়িয়ে রাখতে শিশুদের জন্য খেলাধুলা, চিত্রাঙ্কন, সাঁতার, দাবা খেলা, ক্রিকেট খেলা সহ সব ধরনের আয়োজন রেখেছিলাম।
এ ব্যাপারে পুরাণ বাজার হরিজন যুব ক্লাবের সভাপতি শ্যামল দাস হরিজন জানান, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আমাদের পুরান বাজার হরিজন কলোনিতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। কলোনিটি পৌরসভার জায়গায় স্থাপিত হলেও সেখানে পৌরসভার সাইবোর্ড সাটানো নেই। সাইবোর্ড না থাকার কারণে স্থানীয় ও বহিরাগত লোকেরা কলোনিতে তাদের ইচ্ছামতো প্রবেশ করে। এতে আমাদের নিরাপত্তার বিঘœ সৃষ্টি হয়। এ সমস্ত বহিরাগত সন্ত্রাসী প্রকৃতির লোকেরা আমাদের ক্ষতি করার চেষ্ঠা করে। মাঝেমধ্যে এরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আমাদের কলোনিতে প্রবেশ করে মাস্তানি দেখান এবং আমাদেরকে হুমকি ধমকি দিয়ে থাকে। হরিজন কলোনির প্রবেশের গেইটটি নিরাপত্তার জন্য বন্ধ করার চেষ্ঠা করলেও স্থানীয়দের অবাদ বিচরনে গেইটটি দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা খোলা রাখতে হয়। চাঁদপুর পৌরসভা তাদের নিজস্ব স্থাপনা হিসেবে কলোনিতে সাইনবোর্ড স্থাপন করে দিলে হরিজনদের জীবনের নিরাপত্তা ব্যাবস্থা জোড়দার করা হবে বলে আমরা মনে করি। কলোনির গেইটটি খোলা থাকার করণে বহিরাগতরা প্রবেশ করে আমাদের মা বোনদের প্রতি তাদের কু-দৃষ্টি দিয়ে উত্যক্ত করে ও তাদের ক্ষতির চিন্তা করে। বন্ধ করে রাখলেও তা বহিরাগতদের কারনে বন্ধ রাখা যায় না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বহিরাগত সন্ত্রাসীদের কার্যকলাপ জানলেও তারা কোন ব্যাবস্থা গ্রহণ করে না। তাই আমাদের দাবী চাঁদপুর পৌরসভা আমাদের এখানে বসবাসরত মহিলা, যুবক, যুবতি, শিশু ও বৃদ্ধদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য সাইনবোর্ড সাটিয়ে পৌরসভার নিয়ন্ত্রনে রাখা একান্ত প্রয়োজন।
বাঙ্গালীর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তিনি বলেন, আমরা আমাদের নিজস্ব ক্লাব এবং মন্দিরে পহেলা বৈশাখ সহ বাঙ্গালীর সকল উৎসব পালন করেছি নিজেদের উদ্যেগে অর্থ ব্যায় করে। প্রশাসনিক, দলীয় ও বিভিন্ন সংগঠন বাঙ্গালীর সংস্কৃতি উৎসবে আমাদেরকে ডাকেন না এবং অংশগ্রহনের সুযোগও দেয় না। সামাজিক কালচার থেকে আমারা বঞ্চিত। আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতি গোষ্ঠি রয়েছে। যারা প্রশাসনিক বাংলার সংস্কৃতি উৎসবে অংশগ্রহণ করলে তাদের নিজস্ব কৃতিত্ত ফুটিয়ে তুলতে পারতো।
পৌরসভা আমাদেরকে প্রতি মাসে বিগত বছরগুলোতে ৩শ’ টাকা করে বেতন দিতো। বর্তমানে তা বাড়িয়ে ৬শ’ টাকা করেছে। এ সামান্য টাকা দিয়ে বতর্মান দ্রব্য মূল্যের বাজারে চলা অনেক কষ্টকর। পৌরসভা পূর্বে আমাদেরকে বৈদ্যুতিক সুবিধা দিলেও বর্তমানে মিটার স্থাপন করে দিয়েছে। আমাদেরকেও বিদ্যুৎ বিল দিতে হবে। আমরা পৌরসভার বিভিন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি দিন দিন। গ্যাস সংযোগ রয়েছে যার বিল আমরা নিজেরাই বহন করছি। এ কলোনিতে ৫০টি পরিবারের ৩শ’ লোকের বসবাস। এখানে একই ঘরে পরিবারের সকলকে গাদা গাদা করে বসবাস করতে হচ্ছে। যা একটি স্বাধীন জাতির জন্য অমানবিক। গাদা গাদা করে বসবাস করার করনে আমাদের স্বাস্থ্য ঠিক থাকছেনা। আমরা স্বাস্থ্য হিনতায় ভোগছি। আমাদের সন্তানদের রোগ বালাই লেগেই থাকে।
বড় স্টেশন রেলওয়ে হরিজন কলোনির রতন চন্দ্র দাস হরিজন, বিজয় দাস হরিজন, কানাই লাল হরিজন এর সাথে আলাপ কালে তারা জানান, এদেশে আমরা বসবাস করছি ভগমানের বিশেষ দৃষ্টিতে। এদেশের সরকার আমাদের স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে যে অধিকার তা আমাদেরকে দিচ্ছেনা। সংবিধান অনুযায়ী আমরা যে ৫টি সুবিধা রাষ্ট্র থেকে পাওয়ার কথা তার ১টিও পাচ্ছিনা। বর্তমানে আমরা সংখ্যালঘু হওয়ায় আমাদের জান মাল ও পরিবার পরিজনের নিরাপত্তা নেই। যে কোন মহুর্তে দুর্বৃত্তরা আমাদেরকে হত্য করে পালিয়ে গেলে তাকে সনাক্ত করা যাবেনা ও বিচার কার্য করা সম্ভব হবে না। তাই আমরা সার্বক্ষনিক নিরাপত্তা হীনতায় ও আতংকের মধ্যে দিনাতিপাত করছি। আমরা বাঙ্গালীর সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী। তাই বাঙ্গালীর সকল উৎসব আমাদের উৎসব মনে করে আনন্দের সাথে পালন করে থকি।