মিজানুর রহমান রানা এম.এ আকিব
চাঁদপুরে হাসপাতাল, প্যাথলজি ল্যাব তথা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয় দীর্ঘদিন ধরে কোনো অভিযান না হওয়ায় বেড়েই চলেছে নানা অনিয়ম। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ডাক্তারদের একচ্ছত্র ক্ষমতাবলে চলছে অপচিকিৎসা ও রোগী হয়রানি। এমন অভিযোগ ভুক্তভোগী সাধারণ রোগীদের। তাদের অভিযোগের আলোকে এ যাবতকাল চাঁদপুরের স্থানীয় ও জাতীয় প্রিন্ট মিডিয়ায় একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও টনক নড়েনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
সর্বশেষ গত ১৩ জুলাই চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে মাসিক আইন-শৃঙ্খলা সভায় এ বিষয়ে ঈদুল ফিতরের পর হাসপাতালগুলোর নানা অনিয়ম, অপচিকিৎসা ও রোগী হয়রানির ব্যাপারে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যার বাস্তবায়ন এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। ফলে পূর্বের চেয়ে কোনো নিয়ম-নীতির বালাই ছাড়া চাঁদপুরের হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো যে যার মতো করে চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে দালালদের ৫০% কমিশন দিয়ে রোগীদের ভাগিয়ে এনে যাচ্ছেতাইভাবে বিভিন্ন পরীক্ষার নামে রোগীদের পকেট কাটছে নির্দ্ধিধায়। এসব বিষয়ে চাঁদপুরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে এক অরাজকতমায় নানা অনিয়মের চিত্র।
চাঁদপুরের বেশ কিছু সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার সরকারি কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে সেবার নামে অবাধে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। সরেজমিনে চাঁদপুরের বিভিন্ন হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্বাস্থ্য সেবাদানের চিত্র পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এসকল চিত্র ফুটে উঠেছে।
চাঁদপুর সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, চাঁদপুর জেলায় মোট সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ১৫২টি। এর মধ্যে জেলা শহরে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৫২টি, অনুমোদিত ৫০, অননুমোদিত রয়েছে ২টি প্রতিষ্ঠান। অনুমোদনের আবেদন রয়েছে ৮টি প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে লাইসেন্সের জন্য আবেদনবিহীন বেআইনীভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে স্টেডিয়াম রোডস্থ একটি প্রতিষ্ঠান।
এ বিষয়ে চাঁদপুর সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে আরো জানা গেছে, হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদনের জন্যে সরকারি নিয়ম মোতাবেক যে সকল শর্ত পূরণ সাপেক্ষে অনুমোদন দেয়া হয়েছে এমন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে কাগজে কলমে আইন মানা হলেও বাস্তবে তা থাকছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আবেদন ফরম অনুসারে কোনো প্যাথলজি ল্যাবরেটরি/ডেন্টাল ক্লিনিকের জন্যে ৫৮০ বর্গফুট মেঝে প্রয়োজন থাকলেও সরজমিনে অনেক প্রতিষ্ঠানেই তা পাওয়া যায়নি। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের ছাদ রয়েছে টিনের তৈরি, যা রেডিয়েশনের প্রভাব ফেলবে রোগীর শরীরে। অন্যান্য সার্বক্ষণিক কর্মচারীদের মধ্যে একজন ডিপ্লোমা ল্যাব. টেকনিশিয়ান এবং সহকারী ল্যাব. টেকনিশিয়ান থাকার কথা উল্লেখ থাকলেও অনেক প্রতিষ্ঠানেই তা পাওয়া যায়নি। অনেক প্রতিষ্ঠান সহকারী ল্যাব. টেকনিশিয়ান দ্বারাই চালিয়ে যাচ্ছে ডিপ্লোমা ল্যাব. টেকনিশিয়ানের কার্যক্রম। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে সহকারী ডিপ্লোমা ল্যাব. টেকনিশিয়ানও পাওয়া যায়নি। অন্যত্র রয়েছে বলে তারা জানালেও বাস্তবে তাদের কোনো ডিপ্লোমা ল্যাব. টেকনিশিয়ান এবং সহকারী ডিপ্লোমা ল্যাব. টেকনিশিয়ানই নেই। অদক্ষ লোকেরাই প্যাথলজির কার্যক্রম চালিয়ে নিজেরা কোনো ডিপ্লোমা ল্যাব. টেকনিশিয়ান-এর স্বাক্ষর করে দিচ্ছে। এই অনিয়মের ফলে সেবাগ্রহীতা মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।
অন্যদিকে প্রাইভেট হাসপাতালের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের মেঝের পরিমাণ ৭২০০ বর্গফুট এবং প্রতি রোগীর জন্য ৩৮০ বর্গফুটের কথা উল্লেখ থাকলেও অনেক প্রতিষ্ঠানে আদৌ তা পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মধ্যে সার্জারি, গাইনী, শিশু, এনেসথেসিয়া, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কমপক্ষে ৩ জন ডাক্তারের কথা উল্লেখ থাকলেও অনেক প্রতিষ্ঠানেই নামকাওয়াস্তে একজন, দু’জন আনাড়ি ডাক্তার দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালানো হচ্ছে। এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা নার্স ৬ জন ও সহকারী নার্স ৬ জন, ম্যানেজার ২ জন, ওয়ার্ড বয় ৬ জন, আয়া ৬ জন, সুইপার ৬ জন, দারোয়ান ৩ জন এবং ওইসব প্রতিষ্ঠানে পানি সরবরাহ, পয়ঃপ্রণালি, আলো-বাতাস এবং স্বাস্থ্য সম্মত পরিবেশ থাকার কথা থাকলেও এসব নিয়ম-কানুন শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকছে। বাস্তবে অনেক প্রতিষ্ঠানে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।
এ ব্যাপারে চাঁদপুর জেলার সিভিল সার্জন মো. রুস্তম আলীর সাথে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলে জানা গেছে, ঈদুল ফিতরের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার অভিযান পরিচালনার তথ্য আমার কাছে নেই। আমি আমার দৈনন্দিন কাজের অংশ হিসেবে কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে অভিযোগ আসলে সেগুলো দেখভাল করি। এছাড়া মতলবের নারায়ণপুর পল্লীমঙ্গল জেনারেল হাসপাতালের ব্যাপারে নোটিশ দেয়া হয়েছে এবং আমি নিজেও কয়েকবার হাসপাতালটি পরিদর্শনে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কোনো কর্তব্যরত ডাক্তারকে পাইনি। এছাড়াও জেলা শহর ও বিভিন্ন উপজেলায় যে সকল হাসপাতাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে এগুলোতে পরিদর্শন করে দেখা গেছে হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদনের জন্যে সরকারি নিয়ম মোতাবেক যে সকল শর্ত পূরণ ও যেভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করার কথা তা বাস্তবে অনেক অপূর্ণতা রয়েছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য সিদ্ধান্ত নিলে আমাদের পক্ষ থেকে ডাক্তার সহ প্রয়োজনীয় লোকবল দ্বারা সহযোগিতা প্রদান করা হবে।
শিরোনাম:
শনিবার , ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ২৬ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।