মিজানুর রহমান রানা
চাঁদপুর জেলা কারাগারে চলছে নানা স্বার্থন্বেষী বাণিজ্য। জেলা কারাগারে কর্মরতদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১লাখ টাকার মতো অনৈতিক উৎকোচ আদায় করা হয় বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তিরা। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এই কারাগারের অভ্যন্তরে সংগঠিত দুর্নীতির নানা চিত্র।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাঁদপুর জেলা কারাগার এক সময়ের উপ-কারাগার হিসেবে ছিল। পরবর্তীতে এটিকে জেলা কারাগার হিসেবে রূপান্তরিত করা হয়। বর্তমানে চাঁদপুর জেলা কারাগারটি শহরতলীর আশিকাটি ইউনিয়নের বাবুরহাট এলাকায় চাঁদপুর-কুমিল্লা মহাসড়কের উত্তর পাশে অবস্থিত। নবনির্মিত জেলা কারাগারটি ২০১০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কার্যক্রম শুরুর মধ্য দিয়ে ওই স্থানে স্থানান্তিরত হয়। ভেতরে-বাইরে সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৯ একর সম্পত্তিতে এ কারাগারটির অবস্থান। শহর থেকে একটু দূরে অবস্থান হওয়ার কারণে সাধারণত ওই এলাকায় বা ওই স্থানে জনগণের আসা-যাওয়া কম হয়। জেলা কারাগার বিশাল আকারের হওয়ায় কয়েদির ধারন ক্ষমতাও আগের চেয়ে বহুগুন। যার ফলে বর্তমানে এ কারাগারটিতে কর্মরত ব্যক্তিদের অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসলেও কেউই এ বিষয়ে নাক গলাননি।
সরজমিনে কারাগারে উল্লেখিত অভিযোগ, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধানে গেলে দেখা যায় উল্লেখিত বিষয়গুলোর হালচিত্র। জেলা কারাগারের মূল ফটকে ঢোকামাত্রই কারাক্ষীদের কাছে মোবাইলসহ সবকিছু রাখতে হয় ডানদিকের একটি চেকিং রুমে। এগুলো রাখার দায়িত্ব পালন করছেন দু’জন কারারক্ষী। একজন আধুনিক একটি যন্ত্র দিয়ে প্রতিটি মানুষের দেহ তল্লাশী করেন। অন্যজন মোবাইল, ক্যামেরাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র রাখার জন্যে রাবার পেঁচিয়ে ছোট একটি স্লিপে একটি বক্সের ভেতর রেখে দেন। এর জন্যে তাকে দিতে হয় প্রতিবার ১০টাকা। তাদের ভাষায় বিষয়টি কর্তৃপক্ষ নিয়ম করে দিয়েছে। এরপর রিজার্ভ গার্ড নামে কারাগারের মূল ফটকের পশ্চিম পাশে একটি রুম রয়েছে। সেখানে রয়েছেন দু’জন কারারক্ষী। তারা জেলা কারাগারে যেসকল ব্যক্তি বা বিভিন্ন অপরাধের দায়ে বন্দী রয়েছেন তাদের সাথে দেখা করতে চাইলে এই রিজার্ভ গার্ড রুম থেকে অনুমোদন নামক একটি ফরম পূরণ করে ভেতরে পাঠান। সেজন্য দিতে হয় জনপ্রতি ১০ টাকা। এরপর অনুমোদন এলে দেখা করতে যেতে হয় কারাগারের ভেতরের ভবনের মূল ফটকের ডান পাশে নেটের জাল নামে দুটো স্থান রয়েছে। সেটিও ঘরের জানালার মতো। সেখানে সব সময় ২০/৩০ জন ভেতরে এবং বাইরে লোকজন থাকেই। এর মধ্য দিয়ে চলে মানুষের কথা বলার প্রয়াস, যাকে একবাক্যে বলা যায় ‘হাউকাউ’। এতোসবের মধ্য দিয়েও কাক্সিক্ষত ব্যক্তির সাথে অঙ্গভঙ্গি বা ইঙ্গিতে অথবা জোরে চিৎকার দিয়ে কথা বলে শেষ করে আসতে হয়। সেখানেও ১০টি টাকা গুণতে হয়। যদি কোনো ব্যক্তি ভিআইপি বা তার আর্থিক অবস্থান ভালো এমন ব্যক্তিরা তার কাক্সিক্ষত ব্যক্তির সাথে কারাগারে দেখা করতে যান তাহলে সরাসরি বড় রড দিয়ে বা এঙ্গেলের দরজার সামনে কথা বলতে হলে গুণতে হয় ৫/৬শ’ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত। এগুলোতো গেল বাইরের কথা।
ইতোমধ্যে জামিনে মুক্ত অথবা ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজাপ্রাপ্ত যে সকল আসামী ওই কারাগার থেকে বের হয়ে এসেছেন এদের মধ্যে ২/১জন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তি জানান, চাঁদপুর জেলা কারাগারে যেদিন প্রথম ঢোকানো হয়, মূল গেট থেকে ঢোকার পরই ‘ম্যাট’ নামক ব্যক্তিরা পুরো শরীর হাতিয়ে যা অর্থকড়ি পান, তা নিয়ে যান। এরপর রাতে ঘুমাতে গেলে ভালো সিট পেতে হলে, ভালোভাবে খেতে হলে সেখানে গুণতে হয় বেশ মোটা অঙ্কের টাকা। না-হয় খুবই কষ্টে ময়লা পরিত্যক্ত জায়গা কপালে জুটে। এছাড়াও রয়েছে খাদ্যের সমস্যা। সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত ঠিকাদারের মাধ্যমে জেলা কারাগার কর্তৃপক্ষ যে সকল খাদ্য সরবরাহ করে সেগুলো সাধারণত কারাগারে থাকা অধিকাংশ মানুষই খেতে পারে না। তাই ভালো খাবার খেতে হলে তাকে কারাগারের ভেতরেই কেন্টিন রয়েছে, ওই কেন্টিন থেকে উচ্চমূল্যে ক্রয় করে খেতে হয়। কারাগারের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, পানি পর্যাপ্ত না থাকা। সেটা খাওয়ার পানিই হোক, আর গোসল করার পানিই হোক। যে পানি রয়েছে সেটিতে আয়রন থাকায় সাধারণত ওই পানি কেউ খেতে পারেনি। যার কারণে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ পানি ক্রয় করে খেতে হয়। যা ভেতরের ক্যান্টিনে পাওয়া যায়। ভেতরের ক্যান্টিনটিতে কারারক্ষীদের বাসায় এমন কিছু নেই যেটি পাওয়া যায় না। কিন্তু দাম গায়ে লিখা থাকুক আর নাই থাকুক তার চেয়ে বেশি দিতে হয়। এটি তাদের সাফ কথা।
প্রত্যক্ষদর্শী, সদ্য মুক্তিপাওয়া কয়েদী ও কারারক্ষীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন কমপক্ষে ৩শ’ লোক কারাগার সম্মুখে উপস্থিত হয়। সেক্ষেত্রে মোবাইল ১০টাকা করে প্রতিদিন গড়ে আয় ৩হাজার টাকা, অনুমোদিত পত্র ১০টাকা করে গড়ে আয় ৩ হাজার টাকা, নেটের ফাঁকে কথা বলা বাবদ গড়ে আয় ৩ হাজার টাকা, ভিআইপি বা সরাসরি কথা বলা বাবদ প্রতিদিন ২৫/৩০ হাজার টাকা, ক্যান্টিনের উচ্চ মূল্যে পণ্য বিক্রিতে প্রতিদিন গড়ে ২০/২৫ হাজার টাকা আয় হয়। এছাড়াও সিট বিক্রি বাবদ একটু আরামআয়েশের থাকা বাবদ ভেতরে আয়সহ প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ টাকা অনিয়মের মাধ্যমে জেলা কারাগার কর্তৃপক্ষ আয় করেন। মাসে প্রায় ৩০ লাখ টাকা এভাবেই আয় চলে।
এসব বিষয়ে কারাগার কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হলে মোবাইল রাখা বাবদে মূল ফটকে যে ১০টাকা করে রাখা হয়, সেটি যারা ডিউটি পালন করেন তাদের নাস্তা-পানির পয়সা। অনুমোদিত পত্র ১০টাকা করে যে আয় হয়, সেটি নাকি মসজিদের কাজে ব্যয় হয়। আর নেটের মাধ্যমে দেখা ও কথা বলার জন্য যে ১০টাকা, ক্যান্টিন থেকে আয়, ভেতরের বিভিন্ন মাধ্যম আয়, সে বিষয়ে কোনো কথা না বলে বলেন, জেলা কারাগারে এখন কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি নেই এবং যারা এখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রয়েছেন তারা খুব সতর্কভাবে পরিচালনা করছেন এবং তারা সৎ মানুষ হিসেবে তাদের অধিনস্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীরা দাবি করেন। ভিআইপিভাবে দেখার বিষয়টি কথা হলে তারা জানান, গত ৩ মাস যাবৎ এ বিষয়টি বন্ধ রয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে এ কারাগারের ঊর্ধ্বতন ১ম এবং ২য় ব্যক্তি ৩ মাস পূর্বে এখানে আসেনি, কেউবা দেড় বছর, কেউ বা এক বছর। তিন মাস যাবত বন্ধ থাকলে পূর্বের অনিয়মের টাকাগুলো কোথায় গেল বা কাদের মাধ্যমে অনিয়ম হলো এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর দেননি।
চাঁদপুর জেলা কারাগারের উল্লেখিত অনিয়ম ও দুর্নীতি বিষয় সম্পর্কে জেল সুপারের বক্তব্য জানতে চাইলে কারারক্ষীরা জানান, স্যার বাসায় রয়েছেন। এখন আসবেন না। আগামী রোববার দেখা করেন। ঘণ্টাখানেক ভেতরে কারারক্ষীদের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে জেলা কারাগারের দ্বিতীয় ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি জেলার নিজেকে এবং তার বসকে সৎ দাবি করে এ সকল অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়গুলোকে মিথ্যা প্রপাগান্ডা বলে দাবি করেন। তারপরও তিনি রোববার অফিস চলাকালীন সময় আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, এখন আর কারাগারে কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হয়নি। চোখের সামনে কয়েকটি বাস্তব কথা বা উদাহরণ তুলে ধরলে তিনি বলেন, আপনারা আরেকদিন এসে স্যারের সাথে কথা বলুন। এ ব্যাপারে তিনি আর কোনো কথা বা মন্তব্য করতে রাজি হননি।
শিরোনাম:
সোমবার , ১৭ মার্চ, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ৩ চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।