স্টাফ রিপোর্টার:
চাঁদপুর শহরের সর্বত্র সরকারের দায়িত্বে থাকা শিক্ষা বিভাগের নিয়ন্ত্রণহীন কোচিং ও প্রাইভেট বাণিজ্য বন্ধ হয়নি। আনাচে-কানাছে গড়ে উঠা কোচিং সেন্টার এবং ব্যাচ পড়ানোর নামে প্রাইভেট বাণিজ্য রমরমা। নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে প্রতারিত হচ্ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। সরকার হারাচ্ছে মোটা অঙ্কের রাজস্ব। সবকিছুতে নিয়ন্ত্রণ থাকলেও নিয়ন্ত্রণ নেই শুধুমাত্র কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট পড়ানোর ক্ষেত্রে। সপ্তাহের প্রতিদিনই এ সকল কোমলমতি শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান এবং বাসা-বাড়িতে নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি কতিপয় অসাধু অর্থলোভী শিক্ষক এবং কোচিং সেন্টারের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ক্রমশঃ তাদের শিক্ষা জীবন শেষ করে দিচ্ছে। সপ্তাহের শুক্রবার সরকারি বন্ধ থাকা সত্ত্বেও কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট পড়া থেকে রেহাই পায়নি।
কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট বাণিজ্যে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও চাঁদপুরের অলিতে-গলিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য কোচিং সেন্টার। এসব কোচিং সেন্টারের লোভনীয় লিফলেট (এ প্লাস পাওয়ার নিশ্চয়তা সম্বলিত সাইনবোর্ড) পড়ে শিক্ষার্থীরা সহজেই তাদের সরণাপন্ন হচ্ছে। কোচিং সেন্টারে যাওয়া-আসা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জন কতোটা সুফল বয়ে আনে তা প্রকাশ পায় পরীক্ষার ফলাফলে। কোচিং সেন্টারে শিক্ষা নেয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় অসন্তোষজনক ফলাফল। এতে করে অভিভাবকরা পড়েন বেকায়দায়। অভিভাবকরা সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে এক কোচিং সেন্টার থেকে অন্য কোচিং সেন্টারের লোভনীয় লিফলেট পড়ে সরণাপন্ন হন সন্তানের ভালো ফলাফলের আশায়। কিন্তু বাস্তবে পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে উল্লেখযোগ্য তেমন ভালো ফলাফল দেখাতে পারেনি।
অন্যদিকে কোচিং সেন্টার এবং শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোর পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা বাসা-বাড়িতে গৃহ শিক্ষক-শিক্ষিকা রেখে নিয়মিত পড়ালেখা করছে। এরপর রয়েছে তাদের নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান। এতো টাকা-পয়সা ব্যয় করে লেখাপড়া করার পরও শিক্ষার্থীরা উল্লেখযোগ্য ফলাফল পাচ্ছে না। অথচ গ্রামাঞ্চলে সাধারণ পরিবারের শিক্ষার্থীরা শহরের শিক্ষার্থীর চেয়েও ভালো ফলাফল করছে।
এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, চাঁদপুর শহরে সাইনবোর্ডধারী অধিকাংশ কোচিং সেন্টারে যুব বয়সী যুবকরা কোচিংয়ে আসা শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাচ্ছে তারা অনেকেই ছাত্র। অন্যদিকে চাঁদপুর শহরের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগ শিক্ষকরাই তাদের বাসা-বাড়িতে ভিন্নতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে প্রাইভেট পড়াচ্ছে। তিনটি কক্ষ বা দুটি কক্ষ নিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করলেও ওই সকল শিক্ষকরা তাদের বাসা-বাড়ির প্রধান কক্ষটিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ন্যায় টেবিল তৈরি করে প্রতিদিন ৩/৪ ব্যাচে প্রাইভেট বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ইংরেজি, অঙ্ক বা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হলে তো কথাই নেই। তাদের প্রাইভেট বাণিজ্য সবচে’ বেশি রমরমা থাকে। প্রাইভেট পড়াচ্ছে এমন বেশ ক’টি বাসা-বাড়িতে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, শিক্ষক না থাকলেও তার গৃহিণী ওই শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এতে করে প্রতারিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সপ্তাহের এমন কোনো দিন বাদ নেই যে, কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ রয়েছে। জাতীয় অনুষ্ঠান ঃ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস, ১৪ এপ্রিল বাঙালির পহেলা বৈশাখ, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসসহ অন্যান্য সরকারি ছুটিগুলোতেও এতের কোচিং বাণিজ্য ও প্রাইভেট বাণিজ্য বন্ধ থাকে না। এ সকল কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট টিউটরদের মাঝে দেশপ্রেম বলতে বুঝায় শুধু অর্থ। সামাজিক, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এদের বিচরণ নেই বললেই চলে। সে কারণে এরা কোনোভাবেই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেম, দেশের মুক্তিযুদ্ধ, দেশের জাতীয় দিবসগুলো এবং জাতীয় শোক দিবস সম্পর্কে কোনো জ্ঞান বা ধারণা এদের নেই।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এ সকল কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষে বাসা-বাড়িতে ফিরে যে সময়টুকু অবসর পায় সে সময়টুকু খেলার মাঠে বা নিজেদের আনন্দ- বিনোদন করার কথা থাকলেও কোচিং ও প্রাইভেটের কারণে দৌড়াতে হয় অভিভাবকসহ শিক্ষার্থীদের। বর্তমান ক্ষমতাসীন মুক্তিযুদ্ধের সরকার কোচিং ও প্রাইভেট পড়া নিষিদ্ধ করলেও অর্থলোভী চাঁদপুরের এ সকল শিক্ষকরা তা মানছে না। এমনও দেখা গেছে, মুসলমানদের সবচে’ ধর্মীয় দিবস পবিত্র শবেবরাত। অথচ এ সকল কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট শিক্ষকরা সেদিনও সন্ধ্যা পর্যন্ত এ সকল কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ধরে রাখছে তাদের বাণিজ্যের কারণে।
চাঁদপুরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে কোচিং ও প্রাইভেট পড়ানোর কারণে শিশু-কিশোররা এখন সাংস্কৃতিক কর্মকা- থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার আবু সালেহ মোঃ আবদুল্লাহ চাঁদপুর বার্তাকে জানান, জেলা শিল্পকলা একাডেমির প্রশিক্ষণ বিভাগে বছরের শুরুতে অনেক শিশু-কিশোর সঙ্গীত, নৃত্য, তবল ও ছবি আঁকায় ভর্তি হয়েছে। কিন্তু সপ্তাহে শুক্রবার মাত্র একদিনের প্রশিক্ষণে ওই সকল প্রশিক্ষণার্থীদের পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি অনুসন্ধান এবং অভিভাবকদের সাথে আলাপ করে জানতে পেরেছেন, শুক্রবার সকাল থেকে শিল্পকলা একাডেমিতে প্রশিক্ষণ বিভাগে ভর্তি হওয়া ওই সকল শিশুরা কোচিং ও প্রাইভেট নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সে কারণে তারা (কোমলমতি শিশুরা শিল্পকলায় ভর্তি হওয়া সত্ত্বেও) আসতে পারেনি। কারণ, প্রতি শুক্রবারই কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট পড়ানোর শিক্ষকরা তাদের সাপ্তাহিক পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। যদিও এটি একটি লোক দেখানো শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এসব কারণেই শিক্ষার্থীরা দিন দিন তাদের মন-মানসিকতা পরিবর্তন হয়ে অপকর্ম ও ভুল পথে ধাবিত হচ্ছে এবং অপরাধের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে।
চাঁদপুরের অনেক সচেতন অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গড়ে উঠা এ সকল কোচিং বাণিজ্য এবং পাড়া-মহল্লার বসবাসকারী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের গড়া প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করা কি যাবে না? তাদের মতে, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসন ও চাঁদপুরের পুলিশ প্রশাসন সমাজের মাদক ও সন্ত্রাসী এবং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গণসচেতনতামূলক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। অভিভাবকদের দাবি, এ সকল আন্দোলনের সাথে কোচিং ও প্রাইভেট পড়ানো বিষয়টি আমলে নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।