শফিউল আলম দোলন: সাংবাদিকতাকে যিনি ইবাদতের মতো মনে করতেন, সেই নাজিমউদ্দিন মোস্তান লোকান্তর হলেন গত ১৮ আগস্ট, ২০১৩। কিন্তু তার রেখে যাওয়া নীতি-আদর্শ ও প্রার্থনাসম ধ্রুপদ ধারার সাংবাদিকতা অমর হয়ে থাকবে। কারণ সততা, আদর্শ, নৈতিকতা, মননশীলতা, ভাষাশৈলীর কারিগর এই সাংবাদিক সবার অলক্ষ্যেই দেশে বিকল্প সাংবাদিকতার এক নতুন ধারা সৃষ্টি করে গেছেন।
পরিশ্রমী, দূরদর্শী ও অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে তুলনাহীন নাজিমউদ্দিন মোস্তান তার পেশায় রেখে গেছেন অনন্য এক দৃষ্টান্ত। বয়সে ছোট কিংবা বড় যা-ই হোক না কেন, একবার তার সঙ্গে যার কথা হয়েছে, কিছু না কিছু জানতে বা শিখতে পেরেছেন তিনি। ২০০৩ সালে জোট সরকারের আমলে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করার পর যারা ব্যক্তিগতভাবে তাকে কম পছন্দ করতেন, কিংবা তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করতেন, তাদেরও বলতে শুনেছি, এই ব্যক্তিটিকে পদকের জন্য মনোনীত করে একটি ভালো কাজ করেছে সরকার।
৬৫ বছরের জীবনে নাজিমউদ্দিন মোস্তান ‘দৈনিক ইত্তেফাক’সহ বিভিন্ন পত্রিকায় সাড়া জাগানো অনেক রিপোর্ট করেছেন, যা শুধু অনবদ্যই নয়, দেশ-জাতির জন্য ছিল প্রকৃত অর্থেই মঙ্গলজনক।
‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর কাজের ফাঁকে তিনি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতেন। মাত্র আধা যুগ সময়ে এই সাপ্তাহিককে একেবারে শূন্য থেকে যে জায়গায় উন্নীত করেছিলেন তিনি, তা ‘আলগা’ টাকা-পয়সা বিনিয়োগ ছাড়া অন্য কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। গুণগত মানে সেই ‘সাপ্তাহিক রাষ্ট্র’ ছিল অনন্য। বিকল্প সংবাদপত্র হিসেবে ব্রড সাইজের সেই কাগজটি ছিল মূলত সাংবাদিকদের খোরাক। সপ্তাহের যেদিন ‘রাষ্ট্র’ বের হতো, সত্যিকার অর্থে যারা তখন রিপোর্টিংয়ে কাজ করতেন, তাদের বেশির ভাগই এই কাগজটি সংগ্রহ করার চেষ্টা করতেন। কারণ, সেখান থেকে সপ্তাহের বিশেষ রিপোর্টের অনেক বড় বড় ধারণা পাওয়া যেত। আর অর্থনৈতিক বিটের সাংবাদিকদের অনেকের কাছেই ‘সাপ্তাহিক রাষ্ট্র’ পাঠ ছিল অপরিহার্য।
নাজিমউদ্দিন মোস্তানকে ‘একজন ভালো মানুষ এবং একজন ভালো সাংবাদিক’ হিসেবেই মনে করে বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ। কিন্তু তিনি নিজের আন্তরিক চেষ্টায় কত প্রক্রিয়ায় কত লোককে যে সাংবাদিক, আইনজীবী আর রাজনীতিবিদ বানিয়েছেন, সেসব প্রক্রিয়া বা কর্মকাণ্ডের কথা যারা জানেন, তারা নাজিমউদ্দিন মোস্তানের স্মৃতি আজীবন ধারণ করবেন।
ইত্তেফাকের দায়িত্ব পালন শেষে রাতে বাসায় ফিরে আর ঘুমাতেন না নাজিমউদ্দিন মোস্তান। রাতভর হয় অনুবাদ করতেন, না হয় সেই আমলে (১৯৯৬-৯৮) ইন্টারনেট ঘেঁটে বিদেশি সংবাদ বের করতেন। ‘সাপ্তাহিক রাষ্ট্র’-এর জন্য তিনি এভাবেই শ্রম দিতেন।mostan
সব পর্যায়ে পেশাগত নৈতিকতা ধারণ করতে চেষ্টা করতেন নাজিমউদ্দিন মোস্তান। তিনি একসময় প্রচুর সিগারেট পান করতেন। কিন্তু দৈনিক ইত্তেফাকের চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব পাওয়ার পর হঠাৎ করে একদিন সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিলেন তিনি। এতে তার সহকর্মীরা অবাক হলেন! তারা জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, চিফ রিপোর্টার হওয়ার পরদিন থেকে তার কাছে আসা বাইরের লোকজনের অনেকে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে আসতেন। কিন্তু তিনি বলতেও পারছিলেন না যে তিনি অন্যের টাকায় কেনা সিগারেট খান না। কাজেই শেষ পর্যন্ত সিগারেট খাওয়াই ছেড়ে দিলেন নাজিমউদ্দিন মোস্তান।
এই অনন্য সাংবাদিকের সঙ্গে দুই বছরের কিছু বেশি সময় ‘সাপ্তাহিক রাষ্ট্র’-এ কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। প্রায় প্রতিদিনই গড়ে এক ঘণ্টা করে আমাকে সাংবাদিকতার নানা কৌশল শিক্ষা দিতেন তিনি। কোথায় কী প্রক্রিয়ায় তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হবে, কার সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করতে হবে- সবকিছুই বাতলে দিতেন সাংবাদিকদের এই শিক্ষক। তার প্রতিটি বাক্যেই থাকত নৈতিকতার শিক্ষা। তার মতে, শিক্ষিত একটি ছেলে কিংবা মেয়ের জন্য ভালো সাংবাদিক হওয়ার অন্যতম উপাধান হলো একান্ত আগ্রহ, কমনসেন্স আর কঠোর পরিশ্রম।
নাজিমউদ্দিন মোস্তান ছিলেন উঁচু নৈতিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, “সারা দিন কাজ শেষে আপনি বাসায় ফিরেও সারা রাত জেগে কাজ করেন। বিশ্রাম করেন কখন?” জবাবে তিনি বলেছিলেন, “দিনে করি ইত্তেফাকের চাকরি। আর রাতে করি সাপ্তাহিক রাষ্ট্রের কাজ।” তার দৃষ্টিতে ঘুমটা বিশ্রামের জন্য আলাদা কোনো প্রক্রিয়া নয়; বরং সেটাও একটা কাজ। মানুষ একটা কাজ থেকে আরেকটা কাজে নিজেকে ডাইভার্ট করলে তার মাধ্যমেই বিশ্রাম হয়ে যায়। জানি না, তার এই দার্শনিক উপলব্ধি সত্য কি না। কিন্তু ১৯৯৮ সালে মাত্র সোয়া দুই বছরের মাথায় দেখলাম, তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন। তার শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে যায়। তার পর তিনি ‘সাপ্তাহিক রাষ্ট্র’ বন্ধ করার পাশাপাশি দৈনিক ইত্তেফাকের চাকরিটাও ছেড়ে দেন। তবে ইত্তেফাক কর্তৃপক্ষ তাকে একজন অ্যাসিসস্ট্যান্ট বা টাইপিস্ট রেখে অফিসে বসে কাজ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল।
রাজধানীর শুক্রাবাদে যখন ‘সাপ্তাহিক রাষ্ট্র’-এর অফিস ছিল, তখন দেখেছি কত রথী-মহারথীর আনাগোনা। সবাই তার সঙ্গে অগ্রহভরে আলাপ-আলোচনা করতে আসতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অফিসে বসে থাকতেন, কখন তিনি বাইরে থেকে ‘রাষ্ট্র’ অফিসে ফিরবেন। আর মোস্তান ভাইও তাদের যথাসাধ্য বুদ্ধি-পরামর্শ দিতেন। অনেককে পরে মন্ত্রী-এমপি হতেও দেখেছি। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর তার সঙ্গে সেসব রথী-মহারথীদের খুব কমই দেখা করতে গিয়েছেন।
সত্যিকার অর্থে মোস্তান ভাইয়ের কর্মজীবনের কাহিনী লিখতে গেলে এক মহাকাব্যই হয়ে যাবে।
‘সাপ্তাহিক রাষ্ট্র’ প্রকাশের কাজে তার বড় মেয়ে নাজমুন্নাহার মিলি ও সহধর্মিণী অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সহযোগিতা করতেন। আমরা যারা কাজ করতাম, তারা তার সহধর্মিণীর নাম দিয়েছিলাম ‘রাষ্ট্রমাতা’। আর এই রাষ্ট্রমাতা আমাদের কত দিন দুপুরে নিজের হাতে রান্না করে খাইয়েছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বিশেষ করে আমার পছন্দের ইলিশ মাছের সঙ্গে বেগুনের তরকারির স্বাদ এখনো ভুলতে পারি না।
নাজিমউদ্দিন মোস্তানের কিছু স্মৃতি ও কর্মতৎপরতার কথা না বললেই নয়। রাস্তার ছিনতাইকারীকে লেখাপড়া শিখিয়ে আইনজীবী বানানোর মতো চমকে দেয়া ঘটনাও আছে এর মধ্যে। সেই ব্যক্তি এখন সুপ্রিম কোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবী। সম্ভবত, তখন সংবাদে কাজ করতেন সাংবাদিক নাজিমউদ্দিন মোস্তান। পত্রিকার কাজ শেষে রাতের বেলায় যেতেন বাংলাবাজারে। সেখান থেকে বই এনে বাসায় বসে অনুবাদ/সম্পাদনার কাজ করতেন। তাই তার ঘাড়ে একটি কাপড়ের ব্যাগ (ঝোলা) রাখতেন। একদিন গভীর রাতে বাড়ি ফেরার সময় পুরান ঢাকার রাস্তায় ছুরি নিয়ে একদল ছিনতাইকারী তার গতিরোধ করে। তারা ব্যাগটি ছিনিয়ে নিতে চাইলে তিনি তা বুকে আগলে রেখে ছিনতাইকারী দলের নেতার উদ্দেশে বললেন, “ব্যাগটি দিতে পারি, কিন্তু এর ভেতরে যা আছে তা আপনাকে গ্রহণ করতে হবে।” দলনেতা উত্তর দিল, “আচ্ছা নেব। তাড়াতাড়ি দিয়ে দে।” তিনি ঝোলার ভেতর থেকে বই বের করে দিলেন। তখন ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা অনাগ্রহ দেখিয়ে চলে যেতে চাইলে তিনি তাদের গতিরোধ করে দলনেতাকে বললেন, “আপনি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছেন।”
পরদিন আসার সময় আবারও কথা হলো ওই দলনেতার সঙ্গে। তারপর একদিন মোস্তান ভাই তাকে বই কিনে ও নিজে ফরম ফিলাপ করে এসএসসি, এইচএসসি এবং পরে বিএ পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দেন। এরপর এলএলবি পাস করিয়ে আইনজীবীতে পরিণত করেন।
ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার একদিন দেখা এবং কথাও হয়েছিল। মোস্তান ভাইয়ের প্রতি তার কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না। শত কৌতূহল থাকার পরও মোস্তান ভাইয়ের অনুরোধে পরে ওই ব্যক্তির সঙ্গে আর কখনো যোগযোগ করিনি। পাছে নাম-ঠিকানা প্রকাশ হয়ে গেলে ওই ব্যক্তি সমাজে হেয়প্রতিপন্ন হন, সে জন্যই মূলত মোস্তান ভাই আমার ওপর এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন।
কেউ স্বীকার করুন বা না করুন, বাংলাদেশের ইনফরমেশন ও টেকনোলজি (আইসিটি) সেক্টর, বিশেষ করে ইন্টারনেট ব্যবস্থা প্রসারের ক্ষেত্রে সাংবাদিক নাজিমউদ্দিন মোস্তানের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আইসিটি রিপোর্টিংয়ের ওপর রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন তিনি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অকপটে স্বীকার করেন তা এই অবদান। আর তাই অর্থনীতির ছাত্র হয়েও তিনি ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স পুরস্কার’ পান ১৯৮৫ সালে। কারিগরি পদক পান ১৯৯০ সালে। এ ছাড়া Special contribution to the ICT sector Journalist Award, BCS, জাতীয় প্রেস ক্লাব ও বিজ্ঞান ফোরাম থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয় তাকে।
নাজিমউদ্দিন মোস্তানের সাংবাদিকতার ধরনই ছিল অন্য রকম। আমার মনে আছে, ’৯৬ সালের শেষ দিকে একবার তাকে বলেছিলাম, “ভাই, একজন পলিটিশিয়ানের ইন্টারভিউ ছাপতে চাই সাপ্তাহিক রাষ্ট্রে।” প্রথমে তিনি বললেন, “আপনি কি রাজনীতিবিদদের দিয়ে বাঁদরনাচ নাচাতে চান? সাপ্তাহিক রাষ্ট্রকে একটি অলটারনেটিভ নিউজপেপার হিসেবেই পাঠকরা জানেন। কাজেই এখানে গতানুগতিক ‘তিনি বলেন, বা তিনি বলেছেন, কিংবা তিনি কেঁদেছেন/ হেসেছেন’ ধরনের রিপোর্ট ছাপাটা কতটুকু প্রয়োজন তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন।” এরপর একদিন তিনি আমাকে শাহবাগের আজিজ মার্কেটে নিয়ে আহমদ ছফা সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, “এই ছেলেটি আপনার কাছে এখন থেকে মাঝেমধ্যে আসবে। আপনি দয়া করে তাকে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য সুযোগ দেয়ার চেষ্টা করবেন।” ছফা সাহেবও সম্মতি দিয়েছিলেন, যদিও এরপর মাত্র দু-এক দিন ছফা সাহেবের কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। আর সেটাও মোস্তান ভাইয়ের উপস্থিতিতে ছফা ভাইয়ের সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য। এই সাক্ষাৎকার সাপ্তাহিক রাষ্ট্রে ‘আহমদ ছফার বুদ্ধিবৃত্তি’ শিরোনামে ছাপা হয়েছিল। এরপর একদিন মোস্তান ভাই সেই রাজনীতিবিদের (আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল) নাম জানতে চাইলেন। এরপর বলেছিলেন, “পরিচয় কীভাবে? আপনি দল করেন নাকি?” আমি বলেছিলাম, “ঠিক তা না, সাংবাদিকতার সুবাদেই পরিচয়।” তবে মাঝে একদিন দেখা হলে আব্দুল জলিল জিজ্ঞেস করছিলেন, “কোথায় আছো এখন?” রাষ্ট্র পত্রিকার কথা জানালে তিনি বলেছিলেন, ‘ও, মোস্তানের পত্রিকা। কাগজটা ভালো। কিন্তু একটু বেশি হার্ড। আর বিশেষায়িত।” আমি তখন তাকে একটি লেখা দেয়ার কথা বললে আব্দুল জলিল বলেছিলেন, “লেখালেখির সময় কোথায় রে ভাই। তুমি একদিন সময় করে এসো, তোমাকে একটা ইন্টারভিউ দিয়ে দিব নে।” পরে ‘রাষ্ট্রে’ থাকাকালে একমাত্র আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিল সাহেবেরই একটি ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম আমি।
অনেক রাজনীতিবিদকেই কলাম লেখা কিংবা সাংবাদিকতা শিখিয়েছিলেন নাজিমউদ্দিন মোস্তান। সরাসরি তাদের সঙ্গে কথা বলে সেগুলো ইন্টারভিউ আকারে না ছাপিয়ে তাদের ভাষায় লিখে সোর্স হিসেবে তাদের নামে ছাপিয়ে লেখালেখির কাজে রাজনীতিবিদদের উৎসাহ জুগিয়েছিলেন তিনি। কাজী জাফর আহমদসহ অনেক বড় বড় রাজনীতিককে এভাবে লিখতে দেখেছি।
আরেকটি রিপোর্টের স্মৃতির কথা খুব মনে পড়ছে আমার। ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি বানানোর এক বছর পর একটি অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি তার এক বক্তৃতায় দেশের সুশীল সমাজের প্রশংসা করে সবাইকে সুশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার জবাবে নাজিমউদ্দিন মোস্তান ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি আপনি কাদের সুশীল সমাজ বলেন ?’ আমার দেশের দুবেলা খেতে পারা হাঁটুর ওপর কাপড় পরা কৃষককুলই হলো আসল সুশীল সমাজ- এই শিরোনামে একটি কলাম লিখে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। সেই কলামে তিনি লিখেছিলেন, দেশের ভুখা-নাঙ্গা মানুষকে ব্যবহার করে দেশের বড় বড় এনজিও ব্যক্তিত্বরা কীভাবে চাঁদা আর অনুদান এনে নিজেদের ভোগ-বিলাসিতার কাজে ব্যবহার করেন এবং তাদের জীবনে অর্থের চাহিদা কত, আর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন কৃষক যে কিনা প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই মাঠে গিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তথাকথিত এই সুশীল সমাজের মানুষের মুখে অন্নের জোগান দেন- তার চাহিদা কত এবং দেশের জন্য কার অবদান কতটুকু? কাজেই সুশীল সমাজ যদি কাউকে বলতেই হয়, তাহলে আমার দেশের এই হাড়ভাঙা খেটে খাওয়া এবং হাঁটুর ওপর কাপড় পরা কৃষককুলকেই বলতে হবে। দেশের নাম বেচে বিদেশ থেকে ডলার এনে ভোগবিলাসিতাকারী ছদ্মবেশী ব্যক্তিরা আর যাই হোন না কেন, কখনো সুশীল সমাজ হতে পারেন না।
রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তাকে চিঠি দিয়ে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি বঙ্গভবন থেকে লোক পাঠিয়ে সাপ্তাহিক রাষ্ট্রের সেই সংখ্যাটির দশটি কপি সংগ্রহ করেছিলেন, তা এখনো আমার পরিষ্কার মনে আছে।
সম্ভবত, ১৯৯৭ সালে সংসদে বাজেট পেশের পরের ঘটনা। মতিঝিল সোনালী ব্যাংকের পিআরও ছিলেন মুহাম্মদ জাফর ইকবাল নামের এক কর্মকর্তা। তার সঙ্গে রীতিমতো বাগবিতণ্ড শেষে ‘রাষ্ট্র’ অফিসে এসে বিক্ষুব্ধ অবস্থায় মোস্তান ভাইকে বললাম, “ওই ব্যাংকের অনিয়মের তথ্য নিয়ে এসেছি। একটি রিপোর্ট করতে চাই।” তিনি আমার মনের অবস্থা দেখে বললেন, “তাড়াতাড়ি লিখে ফেলুন।” আমি দুপুরের খাবার খাওয়ার আগেই তা লিখে শেষ করে ফেললাম। কিন্তু ওই সপ্তাহে রিপোর্টটি আর ছাপা হলো না। কারণ জানতে চাইলে মোস্তান ভাই বললেন, “এখন তো আর ওই ব্যক্তির প্রতি প্রথম দিনের মতো রাগ-বিরাগ কিংবা বিক্ষুব্ধ অবস্থা আপনার মধ্যে নেই। ওটা প্রশমনের জন্যই সেদিন সঙ্গে সঙ্গে লিখে ফেলতে বলেছিলাম।মনে রাখবেন, রাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে কারো বিরুদ্ধে রিপোর্ট লেখাটা একজন ভালো সাংবাদিকের কাজ নয়।”
নাজিমউদ্দিন মোস্তানের দেশপ্রেম কত অকৃত্রিম ছিল, তারও পরিচয় মিলে বেশ কিছু ঘটনায়। এরই নজির ধারণকারী একটি ঘটনা ছিল সোনারগাঁও হোটেলে একটি ব্রিটিশ প্রতিনিধিদলের সংবাদ সম্মেলনে। হল ভর্তি সাংবাদিক অবস্থান করলেও একজন ব্রিটিশ নাগরিক বাংলাদেশকে অসম্মান করে কথা বলার পরও যখন কেউ কিছু বলছিলেন না, তখন নাজিমউদ্দিন মোস্তান পেছন থেকে উচ্চকণ্ঠে ওই ব্রিটিশ নাগরিকের উদ্দেশে বলে উঠলেন, “ইউ ব্রিটিশিয়ার্স, ইউর পিপল হান্টারিং দ্য ইলিগ্যাল রোলস্ ইন দিস কান্ট্রি টু হান্ড্রেড ইয়ার্স। সো ইউ শুড নট সে লাইক দেট, স্টপ ইউর মাউথ প্লিজ।” মোস্তান ভাইয়ের এই বক্তব্য শোনে থ হয়ে যায় সেই ব্রিটিশ প্রতিনিধিদল। পরে তড়িঘড়ি করে সংবাদ সম্মেলন শেষ করে তারা।
দেশের বেকারত্বের অবস্থা নিয়ে একটি রিপোর্ট করার আগে তিনি আমাকে একদিন পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন, “একদিন হয়তো আমি থাকব না, আপনাকে একটি কথা বলে রাখি। এটা হাদিস বা পবিত্র কোরআনের কোথাও হয়তো পাবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের বেকারত্বের যে অবস্থা, সে অনুসারে আপনার মতো একটা সচেতন ছেলে যদি মৃত্যুর আগে আরো পাঁচটি ছেলেমেয়ের বৈধ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে যান, তাহলে মৃত্যুর পর আপনার জন্য বেহেশত হারামও হয়ে যেতে পারে।”
মোস্তান ভাই বিভিন্নভাবেই চেষ্টা করে গেছেন সেটি পালন করতে এবং করেছেনও। কিন্তু অনেকেরই হয়তো আর নাজিমউদ্দিন মোস্তানের নামটি এখন মনে নেই। কিন্তু তাতে সাংবাদিক নাজিমউদ্দিন মোস্তানের কী আসে-যায়। তিনি তো তার দায়িত্বটুকু ইবাদতের মতোই পালন করে গেছেন।
শফিউল আলম দোলন: সাংবাদিক