বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার শত বছরের পুরোনো আইনে নেই নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ষ শনাক্তকরণে কেনা হচ্ছে ২ হাজার ডিভাইস
আদালতে জাল জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফির ছড়াছড়ি। যে পরিমাণ জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি ব্যবহৃত হচ্ছেÑ ধরা পড়ছে তার সামান্যই। সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে জাল স্ট্যাম্প শনাক্তের অভিযান চলছে। ভুয়া স্ট্যাম্প শনাক্তের অভিযান চলছে দেশের প্রায় সব আদালতে। তবে বিচারালয়ের মতো স্পর্শকাতর অঙ্গনে ভুয়া স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি ব্যবহার এখনই সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবেÑ এমনটি মনে করছেন না এ অঙ্গন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, আইন অনুযায়ী, স্ট্যাম্প মুদ্রণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। এ কারণে ভুয়া স্ট্যাম্পের ব্যবহার, নিয়ন্ত্রণ, শনাক্তকরণ এবং এ সংক্রান্ত অপরাধ বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে সম্প্রতি জাল জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প প্রতিরোধে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও জাল স্ট্যাম্প শনাক্ত করলেও নিজেরা বাদী হয়ে মামলা করতে পারছে না। উদ্ধারকৃত স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফিসহ জালিয়াত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তুলে দিচ্ছে সিআইডি’র হাতে। দেশের বিভিন্ন আদালতে বেশ কিছু জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি ধরা পড়ার পর টনক নড়ে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষের। জাল স্ট্যাম্প শনাক্তকরণে অন্তত : ২ হাজার শনাক্তকরণ ডিভাইস কিনছে। দেশের ৬৪টি আদালতে ভুয়া জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি শনাক্তকরণে কারিগরি সহায়তা দিতে কেনা হচ্ছে এসব ডিভাইস।
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সূত্র জানায়, জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প মামলার আবেদন, মামলা দায়ের, ওকালতনামা, এফিডেভিট প্রদান এবং রায় ও আদেশের প্রত্যায়িত অনুলিপিতে ব্যবহৃত হয়। এটি স্ট্যাম্প ‘কোর্ট ফি’ নামে পরিচিত। দেশের সব আদালতেই জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প অত্যাবশ্যকীয় একটি উপকরণ। এ কারণে সব আদালতে মামলা রুজুর ক্ষেত্রে বহু নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ব্যবহৃত হয়। সাধারণ তথ্য মতে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে ১ হাজার নতুন মামলা রুজু হয়। এ মামলা বা আবেদন করতে জাল জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ব্যবহৃত হয়। সম্প্রতি মামলায় ব্যবহৃত কিছু স্ট্যাম্প ম্যানুয়ালি পরীক্ষা করে দেখা যায়, ব্যবহৃত স্ট্যাম্পগুলোতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য নেই। যাতে প্রমাণিত হয় স্ট্যাম্পগুলো জাল। পরবর্তীতে কিছু ডিভাইস এনে পরীক্ষা করে দেখা যায়, মামলায় ব্যবহৃত প্রতি ১০টি স্ট্যাম্পের মধ্যে অন্তত: ৭টিই জাল। দীর্ঘদিন ধরে এক্ষেত্রে স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ব্যবহৃত জাল স্ট্যাম্পগুলো ২ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা মূল্যমান পর্যন্ত রয়েছে।
জাল জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের ব্যপক ব্যবহারের কারণে সরকার বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে। এটি রোধকল্পে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষ বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার মো: গোলাম রব্বানী। তিনি বলেন, জাল স্ট্যাম্প ব্যবহৃত হচ্ছেÑ এটি হয়তো বিচারপ্রার্থী জানেন না। মামলা দায়ের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের পক্ষেও অনেক সময় বোঝার উপায় নেই যে,্ এটি জাল। সম্প্রতি আমরা জাল স্ট্যাম্প শনাক্তকরণের ডিভাইস পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করছি। সারাদেশের আদালতগুলো জাল স্ট্যাম্প ব্যবহার রোধে এরকম অন্তত : ২ হাজার ডিভাইস কেনা হবে।
হাইকোর্ট রেজিস্ট্রার আরও জানান, সরকারি ছাপাখানা এবং সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রিন্টিং করপোরেশন অফিশিয়ালি কোর্ট ফি মুদ্রণ করে থাকে। যে ব্যক্তি বা সিন্ডিকেট জাল জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প তৈরি ও সরবরাহ করে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যেই আমরা জড়িত বেশ কয়েকজনকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছি। সিআইডি বিষয়গুলো তদন্ত করছে।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, মামলা করার ক্ষেত্রে জাল কোর্ট ফি ব্যবহারের বিষয়টি প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র বিচারপতিদের জানানো হয়। জাল কোর্ট ফির ব্যবহার রোধে প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের অবস্থান কঠোর। রাষ্ট্র বিপুল টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ কারণে এ অপরাধের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির অবস্থান জিরো টলারেন্স। সারা দেশের আদালতে জাল কোর্ট ফির ব্যবহার যেকোনোভাবে রোধ করতে হবেÑ মর্মে প্রধান বিচারপতির কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।
কে নিয়ন্ত্রক কারা জড়িত : প্রায়ই দেশে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প উদ্ধার এবং গ্রেফতারের তথ্য পাওয়া যায়। জুডিশিয়াল কিংবা নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প জালিয়াতি বন্ধ কিংবা ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণও সম্ভব হয়নি। এ জন্য দায়ী একাধিকার কারণ। প্রধান কারণটি আইনগত।
আইনমন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, স্ট্যাম্পের ব্যবহার ব্যাপক বিস্তৃত হলেও শত বছরের পুরোনো আইনে চলছে এটির মুদ্রণ, বিপণন ও নিয়ন্ত্রণ। এটি মূল্যও নির্ধারিত হচ্ছে ১৮৯৯ সালের ‘স্ট্যাম্প আইন’ অনুসারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘অভ্যন্তরণী সম্পদ বিভাগ’ বছর বছর স্ট্যাম্পের পরিমাণ পরিবর্তন করে। চর্চিত প্রথা অনুযায়ী স্ট্যাম্পের মালিক সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। কিন্তু এ বিভাগ এটি মুদ্রণ করে না। বিপণনের সঙ্গেও জড়িত নয়। এ সংক্রান্ত কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ কিংবা এনবিআর কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের চাহিদাক্রমে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ সকল প্রকার স্ট্যাম্প মুদ্রণ করছে। তবে ডাক বিভাগের নিজস্ব ছাপাখানা থাকলেও স্ট্যাম্প ছাপাচ্ছে সরকারেরই আরেক প্রতিষ্ঠান ‘সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস’ থেকে। মদ্রণের পর স্ট্যাম্পগুলো ডাক বিভাগের হেফাজতে থাকে। তবে এখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্কট রয়েছে। ডাক বিভাগের কাছ থেকে জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি (এনডিসি) চাহিদা অনুযায়ী ডাক বিভাগ থেকে স্ট্যাম্পগুলো গ্রহণ করে। নিয়ে রাখে ডিসি অফিসের ‘ট্রেজারি’তে। এখানেও নিরাপত্তার অভাব রয়েছে বলে জানা যায়। স্ট্যাম্প ভেন্ডারগণ খুচরা বিক্রির জন্য ব্যাংকে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে অর্থ জমা দিয়ে স্ট্যাম্প কিনে নেন। ভেন্ডারগণ এ ক্ষেত্র নির্ধারিত হারে কমিশন লাভ করে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে স্ট্যাম্প ব্যবহারকারীরা স্ট্যাম্প কিনছেন স্ট্যাম্পে উল্লেখিত মূল্যমানের চেশে বেশি মূল্যে। এ অর্থ কোথায় যায়Ñ কারও কাছে হিসাব নেই। দ্বিতীয়ত : মুদ্রণ, সংরক্ষণ, পরিবহন, বিপণন এবং খুচরা বিক্রেতাদের একটি ‘চেইন’ রয়েছে। বিদ্যামান এই ‘চেইন’র নির্দিষ্ট কোনো নিয়ন্ত্রক কিংবা জবাবদিহিতার কর্তৃপক্ষ নেই। ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে বিশাল ফাঁক। জমি হাত বদল, ফ্ল্যাট হস্তান্তর, নানা দাফতরিক কাজে প্রয়োজন হয় স্ট্যাম্পের। গুরুত্বপূর্ণ এ উপকরণ মুদ্রণ, কেনাবেচায় কার্যকর কোনো তদারকি নেই। তাৎক্ষণিকভাবে চেনার সুবিধার্থে জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে কিছু নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তবে সুক্ষ্মভাবে পরখ না করলে খালি চোখে সেটি ধরার জো নেই। এছাড়া নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে বিশেষ নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যও থাকে না। এ ক্ষেত্রে আসল আর নকল স্ট্যাম্পের পার্থক্য করা দূরূহ।
জাল স্ট্যাম্পবিরোধী অভিযানে যুক্তরা বলছেন, যারা মুদ্রণ, সংরক্ষণ, পরিবহন, বিতরণ এবং খুচরা বিক্রির সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া জাল স্ট্যাম্পের ব্যাপক ব্যবহার সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত : আইনে স্ট্যাম্প সংক্রান্ত স্বতন্ত্র কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। এই সুযোগে জাল বা নকল স্ট্যাম্প ছড়িয়ে পড়ছে দেদার। ব্যাপকভাবে নকল হওয়ায় স্ট্যাম্পে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
তারা আরও জানান, ২০/২৫ বছরের পুরোনো মামলার নথিতেও জাল স্ট্যাম্প নাক্ত হচ্ছে। এমন কি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে তৎকালিন পূর্বপাকিস্তান হাইকোর্টের অনেক পুরোনো নথিতেও জাল স্ট্যাম্প পাওয়া যাচ্ছে। এতে প্রতীয়মান হয়, জাল স্ট্যাম্পের ব্যবহার চলছে দশকের পর দশক ধরে। ফলে স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে এখন অবধি পর কি পরিমাণ জাল স্ট্যাম্প ব্যবহৃত হয়েছে তা হয়তো কখনোই নিরূপণ করা সম্ভব নয়। এসব ব্যবহৃত হওয়ায় সেসব জাল স্ট্যাম্প বাতিল করা যাচ্ছে না।
উচ্চ আদালতের মতো স্পর্শকাতর দফতরেও কি করে জাল স্ট্যাম্প ব্যবহৃত হয়ে আসছেÑ এ প্রশ্নে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ কর্মকর্তারা জানান, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের নকল উত্তোলনের ক্ষেত্রে জাল স্ট্যাম্প ব্যবহৃত হতে পারেÑ এটি কারও কল্পনায়ও আসেনি। তাছাড়া ব্যবহৃত স্ট্যাম্প ‘জাল’ কি নাÑ সেটি শনাক্তের কোনো প্রযুক্তি আদালত প্রশাসনের হাতে নেই। সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে মুদ্রিত এবং বাংলাদেশ ডাক বিভাগের মাধ্যমে সারা দেশে জুডিশিয়াল-নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পসহ সকল ধরনের স্ট্যাম্প সরবরাহ হয়।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, রাজধানীর জয়কালি মন্দির, আদালত পাড়া, জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে, ভূমি অফিস ও সাব রেজিস্ট্রি অফিসের আশপাশে ছোট টেবিল-চেয়ার পেতে বিক্রি হচ্ছে স্ট্যাম্প। ঢাকার বাইরে জেলা ও উপজেলা শহরের কোর্ট ও সাব রেজিস্ট্রি অফিস এলাকার চিত্রও অভিন্ন। রাজধানীসহ সারাদেশের আদালত পাড়া, ভূমি অফিস এবং সাব রেজিস্ট্রি অফিসকে ঘিরে সক্রিয় জাল স্ট্যাম্প সরবরাহকারী চক্র। তাদের সরবরাহ করা নকল স্ট্যাম্প মিলে যাচ্ছে আসল স্ট্যাম্পের ভিড়ে। ভ্রাম্যমাণ আদালত কিংবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় মাঝেমধ্যে জালিয়াতচক্রের সদস্যরা ধরা পড়লেও অধরা থেকে যাচ্ছেন মূলহোতা। ফলে বন্ধ কিংবা নিয়ন্ত্রণ হয়নি জাল স্ট্যাম্প।
সিআইডি সূত্র বলছে, সম্প্রতি তারা জাল স্ট্যাম্পের সঙ্গে জড়িত ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় একাধিক মামলা হয়েছে। ৬ জনের রিমান্ড শেষে এখন তারা কারাগারে রয়েছেন। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের তথ্য মতে, তারা দীর্ঘদিন ধরে পরস্পর সহযোগিতায় হাইকোর্টে জাল স্ট্যাম্প সরবরাহ করছে। গত কয়েক বছর ধরে তারা এ ধরনের জাল স্ট্যাম্প ব্যবসায় জড়িত-মর্মে স্বীকার করেছে। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে হোতাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিআইডি’র এক কর্মকর্তা বলেন, জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প বা কোর্ট ফি’র আসল-নকল চেনা কঠিন। তবে আসল স্ট্যাম্পে কিছু নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আসল স্ট্যাম্পে ডিভাইস দিয়ে লেজার রশ্মি ফেললে নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যগুলো ভেতর থেকে জ্বলজ্বল করবে। এছাড়া স্ট্যাম্পে টাকার মতো সিরিয়াল নম্বর রয়েছে। তবে সাদা চোখে ধরার ক্ষমতা নেই।
====