জ্বালানি তেল-কয়লা-গ্যাস
বিলম্বিত হচ্ছে সব ধরনের জ্বালানির অর্থ পরিশোধ
সরকারি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান-সংস্থাগুলোর বকেয়া ৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে
দেশের পরিবহন ও বিদ্যুৎ খাতের জ্বালানির সংস্থান হয় আমদানির মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সরকারি কয়েকটি সংস্থার মাধ্যমে এসব জ্বালানি আমদানি করা হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে এ আমদানি অব্যাহত রাখা নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জ্বালানি তেল, কয়লা ও গ্যাস—প্রাথমিক এ তিন জ্বালানি আমদানি বাবদ বিপুল পরিমাণ বকেয়া জমেছে জোগানদাতাদের কাছে। এ দেনা শোধ করা যাচ্ছে না ডলার সংকটের কারণে। রক্ষণশীলভাবে হিসাব করলেও দেখা যায়, জ্বালানির সংস্থান বাবদ দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সরকারি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান-সংস্থাগুলোর দেনা অনেক আগেই ৫০০ মিলিয়ন (৫০ কোটি) ডলারের বেঞ্চমার্ক অতিক্রম করেছে।
দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। প্রধানত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মাধ্যমে এ জ্বালানি আমদানি হয়ে থাকে। বৈশ্বিক আর্থিক ও পণ্যবাজার সংক্রান্ত মার্কিন তথ্যসেবা প্রতিষ্ঠান এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের বরাত দিয়ে ডয়চে ভেলে জানিয়েছে, ডলার সংকটের কারণে বিদেশী জ্বালানি তেল সরবরাহকারীদের পাওনা শোধ করতে পারছে না বিপিসি। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে। ১৬ মে পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, জ্বালানি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপিসির কাছে বকেয়ার পরিমাণ ২৯৭ দশমিক ৪৯ মিলিয়ন (প্রায় ২৯ কোটি ৭৫ লাখ) ডলার৷। এর প্রায় পুরোটাই পাবে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ভিটল এশিয়া এবং চীনা প্রতিষ্ঠান ইউনিপেক।
দেশের বাজারে টাকায় বিক্রি করলেও বিপিসিকে জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধ করতে হয় ডলারে। এজন্য হাতে অর্থ থাকলেও আমদানির মূল্য পরিশোধের জন্য ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ডলার সংস্থান করতে পারছে না সংস্থাটি। ফলে সক্ষমতা থাকলেও দেনা জমছে বিপিসির। এ মুহূর্তে প্রতিষ্ঠানটির জন্য বিড়ম্বনার বিষয় হলো পাওনা পরিশোধ করতে না পারলে বিদেশী সরবরাহকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে।
জ্বালানি তেল আমদানিতে মূল্য পরিশোধের সর্বোচ্চ সময়সীমা ৩০ দিন। আগে আমদানীকৃত জ্বালানি তেল জাহাজীকরণের ৮-১০ দিনের মধ্যেই মূল্য পরিশোধ করে দিত বিপিসি। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এভাবেই আমদানি অব্যাহত রাখতে পেরেছে সংস্থাটি। কিন্তু বিপিসির আমদানীকৃত জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধ নিয়ে বিপত্তি দেখা দেয় মার্চ থেকে।
ডলার সংকটে বকেয়া জমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বিপিসি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গেও কথা বলেছে সংস্থাটি। যদিও এতে সংকটের কোনো সমাধান হয়নি।
বিপিসির পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড প্ল্যানিং) খালিদ আহম্মেদ এ বিষয় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘কিছু সরবরাহকারী তাদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, দ্রুত বকেয়া পরিশোধ না করলে তারা সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। বিপিসি আগে কখনো এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। আমরা আগে সব সময়ই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাওনা পরিশোধ করতাম।’
বিপিসির বাইরে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো (আইপিপি) কিছু পরিমাণে জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে। কিন্তু ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত ডলার না পাওয়ায় তাদের পক্ষেও আমদানি অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশে গত মাসে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি কমেছে মার্চের তুলনায় সাড়ে ১২ শতাংশ।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক এবং অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা জানি, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জ্বালানি তেল সরবরাহ করবে না বলে জানিয়েছে। আবার নতুন করে তেল আনার জন্য বিপিসি এলসিও খুলতে পারছে না। এটা একটা সংকট। ডলার সংকট তো অনেক দিন ধরেই চলছে। ফলে আমাদের আগে থেকেই পরিকল্পনা থাকা উচিত ছিল। আমাদের রফতানি আয় বাড়ছে না। তবে এর বাইরেও সংকট মোকাবেলায় আরো অনেক পদক্ষেপ নেয়া যেত। হয়তো জ্বালানি তেলের এ সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে। সৌদি আরব ও কাতারের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ডলার সংকটে কয়লাও তো আমদানি করা যাচ্ছে না। তেলচালিত পাওয়ার প্লান্টগুলো বন্ধ আছে। কয়লারগুলোও বন্ধ হচ্ছে। তাহলে বিদ্যুতের অবস্থা কী হবে?’
কয়লা আমদানি বাবদও বিপুল পরিমাণ বিল বকেয়া পড়েছে সরকারের। মার্চ পর্যন্ত পটুয়াখালীর পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানির মূল্য বাবদ বকেয়া ছিল ২৯৮ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে চলতি মাসে দুই কিস্তিতে পরিশোধ হয়েছে ২০ মিলিয়ন ডলার। সে অনুযায়ী, শুধু পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রেই বকেয়া আছে ২৭৮ মিলিয়ন ডলার। সামনের দিনগুলোয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু রাখতে প্রয়োজনীয় কয়লার সংস্থান হওয়া নিয়েই অনিশ্চয়তায় রয়েছে বলে জানিয়েছে পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) এ মূল্য পরিশোধ করার কথা। পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় কয়লা আমদানি ও বকেয়ার বিষয়টি নিয়ে ১০ মে বিপিডিবিকে একটি চিঠি দেয় বিসিপিসিএল। ওই চিঠিতে বলা হয়, ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা আমদানি বাবদ বকেয়ার পরিমাণ মার্চ পর্যন্ত ২৯৮ মিলিয়ন ডলার হয়েছে। বিপুল পরিমাণ বকেয়ার কারণে বিসিপিসিএল ৫০ শতাংশ শেয়ারহোল্ডার ও ডেফার্ড পেমেন্টের সুবিধা প্রদানকারী সিএমসি কয়লা আমদানির ক্ষেত্রে অর্থায়নে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কারণ চীনের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ইন্দোনেশিয়ার পিটি বায়ান রিসোর্সেস টিবিকে থেকে কয়লা সরবরাহের জন্য ঋণপত্র খুলতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে বিসিপিসিএলের এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে জানান, কয়লা আমদানিতে ডেফার্ড পেমেন্টের অর্থায়ন করে বিপাকে পড়েছে সিএমসি। বিপিডিবিকে পাঠানো সর্বশেষ চিঠিটি আসলে আগেরটিরই পুনরাবৃত্তি। আগের চিঠি অনুযায়ী যদি অর্থ পাওয়া যেত, তাহলে হয়তো সিএমসি বিষয়টি বিবেচনা করত। কিন্তু এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই।
১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য দৈনিক কয়লা প্রয়োজন এক হাজার টন। সে হিসেবে মাসে প্রয়োজন তিন লাখ টন। দেশে বিদ্যুতের তীব্র চাহিদার মৌসুমে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বিপিডিবিকে পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে। এটি বন্ধ হয়ে গেলে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ কমার পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলসহ গোটা দেশে লোডশেডিং আরো তীব্রতা পাবে।
প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা পূরণের জন্য গত কয়েক বছরে আমদানীকৃত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নির্ভরতা বেড়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু এখন এ এলএনজি আমদানি নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। স্পট মার্কেট থেকে চলতি বছরের শুরু থেকে জুন পর্যন্ত ১০-১২ কার্গো এলএনজি কেনার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের জ্বালানি বিভাগের। বর্তমানে প্রতি কার্গো এলএনজি ৬০০-৬৫০ কোটি টাকায় কিনছে পেট্রোবাংলা। প্রতিষ্ঠানটিকে এ অর্থ ডলারে পরিশোধ করতে হচ্ছে। জুন পর্যন্ত ১২ কার্গো এলএনজি কেনা হলে এবং দামের তারতম্য ঘটলে অর্থের প্রয়োজন পড়বে ৮ থেকে ৯ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ এ অর্থ পরিশোধের সক্ষমতা দেশের ব্যাংকগুলোর নেই বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
আন্তর্জাতিক বাজারে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম এখন কমছে। এর সঙ্গে সঙ্গে কিছু দেশ বাড়তি এলএনজি সরবরাহেরও আশ্বাস দিয়েছে। এর মধ্যে ওমান থেকে বর্তমানে বছরে ১০ লাখ টন এলএনজি আমদানি করছে পেট্রোবাংলা। যদিও চুক্তি অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টন এলএনজি দেয়ার কথা। চুক্তি সম্প্রসারিত হলে চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে ওমান থেকে চুক্তির বাকি পাঁচ লাখ টন এলএনজি পাওয়া যাবে।
তবে পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এলএনজি সরবরাহের নিশ্চয়তা মিললেও বিল পরিশোধ নিয়ে জটিলতা রয়েছে। এ ডলার সংকটের কারণে এখন স্থানীয় গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত আইওসিগুলোর (বিদেশী কোম্পানি) গ্যাসের বিল পরিশোধ নিয়েও বিড়ম্বনা দেখা দিয়েছে।
দেশে গ্যাসের স্থানীয় উত্তোলনের ৬০ শতাংশেরও বেশি আসছে মার্কিন বহুজাতিক শেভরন পরিচালিত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বহুজাতিকটির কাছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) দেনা ছিল অন্তত ১৫০ মিলিয়ন ডলার।
বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গ্যাস সরবরাহ বাবদ প্রতি মাসে শেভরনকে প্রায় ৫ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হয় পেট্রোবাংলাকে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে সেটিও পরিশোধ করা যাচ্ছে না। শেভরনের পক্ষ থেকে মাসিক বিলের অন্তত অর্ধেক পরিশোধের কথা বলা হলেও সেটিও সম্ভব হচ্ছে না পেট্রোবাংলার পক্ষে। ফলে মার্কিন প্রতিষ্ঠানটির কাছে পেট্রোবাংলার দেনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। শেভরনের সঙ্গে পেট্রোবাংলার চুক্তি অনুযায়ী বকেয়া পরিশোধে ৩০ দিনের বেশি বিলম্বে জরিমানাও দিতে হয়।