বিমান বাংলাদেশ, সৌদি এয়ারলাইনস ও ফ্লাইনাস এয়ারলাইনস—এই তিনটি সংস্থা এবার বাংলাদেশের এক লাখ ২২ হাজার ২২১ জন হাজযাত্রী পরিবহন করছে।
ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সাল থেকে শুধু বিমান ও সৌদি এয়ারলাইনস বাংলাদেশের হজযাত্রীদের পরিবহন করে আসছিল।
ফ্লাইনাস এয়ারলাইনস অনুমতি পাওয়ার পর হাব সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেছিলেন, এর মাধ্যমে হজযাত্রীরা আরো ভালো সেবা পাবেন এবং তাদের খরচ কমবে। প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে টিকিট বিক্রি হবে। অথচ ফ্লাইনাস এয়ারলাইনস অনুমতি পাওয়ার পর দুই বছরই হজযাত্রীদের টিকিটের মূল্য বেড়েছে। এই দাম কমানোর জন্য হাব থেকে বড় কোনো চাপও আসেনি। মহাসচিব ও সভাপতি পদ মিলিয়ে শাহাদাত হোসাইন তসলিম ১০ বছর ধরে হাবের নেতৃত্বে আছেন।
ভারতে দরপত্রের মাধ্যমে এয়ারলাইনস নিয়োগ : ভারতে দরপত্রের মাধ্যমে নিয়োগ করা হয় হজযাত্রী পরিবহনের এয়ারলাইনস। বাংলাদেশে বিমান যে ভাড়া ঠিক করে দেয় তা মেনে নেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়। ফলে বাংলাদেশের হজযাত্রীদের ভারতের চেয়ে বেশি টাকায় হজ করতে হয়। এ বছর বাংলাদেশ থেকে হজের খরচ ধরা হয়েছে ছয় লাখ ৮৩ হাজার টাকা।
হজযাত্রী পরিবহনে ফ্লাইনাসকে অগ্রাধিকার : ফ্লাইনাস ২০২২ সালে পাঁচ হাজার হজযাত্রী পরিবহন করেছিল। এ বছর পরিবহন করছে ২০ হাজার হজযাত্রী। শুরুতে সৌদি আরবে যাওয়ার কথা ছিল এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন বাংলাদেশির। সে হিসাবে বিমানকে ৬৩ হাজার ৫৯৯ জন, সৌদি এয়ারলাইনসকে ৪৩ হাজার ৫৯৯ ও ফ্লাইনাসকে ২০ হাজার যাত্রী পরিবহনের অনুমতি দিয়েছিল ধর্ম মন্ত্রণালয়। কিন্তু হজের খরচ বেড়ে যাওয়ায় চার হাজার ৯৭৭ জনের কোটা পূরণ হয়নি। পরে বিমান ও সৌদি এয়ারলাইনসের যাত্রী কমানো হয়। কিন্তু ফ্লাইনাসকে ২০ হাজার যাত্রী পরিবহনের অনুমতি দেওয়া হয়।
ফ্লাইনাসের যাত্রীর টিকিটের টাকা হাব সভাপতির ডাইনেস্টি ট্রাভেলস লিমিটেডের অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার জন্য হজসংশ্লিষ্ট সব ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হজযাত্রী পরিবহনে এয়ারলাইনসভিত্তিক বিভাজনের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। ফ্লাইনাসের জিএসএকে তাও আমার জানা নেই।’ তিনি বলেন, ‘সব হজযাত্রীকে ভালোভাবে পাঠানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এজন্য জরুরি সভা করে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
হাব সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম কালের কণ্ঠকে বলেন, হজযাত্রীদের ভাড়া বিমান ঠিক করে। সৌদি এয়ারলাইনস ও ফ্লাইনাস তা অনুসরণ করে থাকে।
হাবের দাবি ছিল, এয়ারলাইনস বাড়লে ভাড়া কমবে। সে অনুযায়ী গত বছর থেকে ফ্লাইনাস হজযাত্রী পরিবহনে যুক্ত হলো। কিন্তু ভাড়া না কমে বিপুল পরিমাণে বেড়েছে এবং আপনি ফ্লাইনাসের জিএসএ। তাহলে হজযাত্রীরা কী উপকার পেল? জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা দাবি করতে পারি, কিন্তু ভাড়া কমাতে পারি না। কমানোর এখতিয়ার আমাদের নেই।’
ফ্লাইনাসের বিরুদ্ধে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার অভিযোগের বিষয়ে হাব সভাপতি বলেন, ‘যেহেতু বিদেশি এয়ারলাইনসের একজন জিএসএ আইনত থাকে। তাই আমি এই সুবিধা পাচ্ছি। অন্য কেউ এই জিএসএ নিলে তিনিও এই সুবিধা পেতেন।’ হাবের কার্যক্রমের সঙ্গে এই ব্যবসা সাংঘর্ষিক কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাবের কেউ ভাড়া কমানোর চেষ্টা করে না। আমিই এককভাবে চেষ্টা করেছি।’
বিমানের টিকিট না পাওয়া নিয়ে নানা অভিযোগ হজ এজেন্সিগুলোর : বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী হজযাত্রীদের অর্ধেক পরিবহন করবে বিমান। কিন্তু যাত্রীরা অভিযোগ করছেন, তাঁরা হজ এজেন্সির মাধ্যমে পে-অর্ডার জমা দিয়েও টিকিট পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় অনেক হজ এজেন্সি প্রভাবশালীদের মাধ্যমে তদবির করে বিমানের টিকিট সংগ্রহ করছে। হজ প্যাকেজ অনুযায়ী, তিন এয়ারলাইনসেরই টিকিটের মূল্য এক লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা। ভুক্তভোগী অনেকের অভিযোগ, ফ্লাইনাসের টিকিট আগে বিক্রির জন্য বিমান বাংলাদেশের ঢাকা জেলা সেলস অফিস হজ এজেন্সিগুলোকে টিকিট দিতে দেরি করছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিমান বাংলাদেশের ঢাকা জেলা সেলস অফিসের জিএম আশরাফুল আলম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টিকিটের জন্য অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়েও আমার জানা নেই।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস লিমিটেডের পরিচালক, বিপণন ও বিক্রয় কামরুল হাসান খান বলেন, ‘বিমানের টিকিট বিক্রির বিষয়ে আমার ভালো জানা নেই। এ বিষয়ে জেলা সেলস অফিস ভালো বলতে পারবে।’
বিমানের ভাড়া বাড়ছে কেন : এ বছর শুরুতে বিমানের পক্ষ থেকে দুই লাখ ১০ হাজার টাকা ভাড়া নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। পরে জাতীয় কমিটি সেটি কিছুটা কমিয়ে এক লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা ঠিক করে। বিমান বলছে, জেট ফুয়েল ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এবার হজযাত্রী পরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। এর আগে ২০১৭ সালে বিমানে ভাড়া ছিল এক লাখ ১৮ হাজার টাকা, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ছিল এক লাখ ২৮ হাজার টাকা, ২০২০ সালে ছিল এক লাখ ৩৮ হাজার টাকা, ২০২২ সালে ছিল এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। করোনা মহামারির কারণে ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে কেউ হজে যাননি।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সভাপতি এস এন মঞ্জুর মোর্শেদ মাহবুব কালের কণ্ঠকে বলেন, হজের সময় যাত্রী বহন করা বিমান, সৌদি ও ফ্লাইনাস এয়ারলাইনসের জন্য মনোপলি ব্যবসা। অন্য কোনো এয়ারলাইনসকে হজযাত্রী পরিবহনের সুযোগ দেওয়া হয় না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিমান নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে এবং অন্য দুই এয়ারলাইনসকে ব্যবসার সুযোগ করে দেয়। তিনি বলেন, একটি টেকনিক্যাল কমিটি দিয়ে সব পর্যালোচনা করে ভাড়া ঠিক করা উচিত।
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২৭ জুন পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হবে। গত ২১ মে থেকে শুরু হয়েছে হজ ফ্লাইট। ফ্লাইট শেষ হবে আগামী ২২ জুন। কিন্তু কিছু ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় ২২ জুনের মধ্যে সব হজযাত্রী নেওয়া সম্ভব হবে না। ফলে প্রায় ১০ হাজার হজযাত্রী সৌদি আরবে পৌঁছানো নিয়ে এখনো সংশয় রয়ে গেছে।