আগামীতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমলে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে দেশের অর্থনীতি। কারণ সরকারের ঋণ ও ভর্তুকি ব্যয় বেড়ে যাবে। চাপের মুখে পড়বে আমদানি ব্যয়ও। এতে সরকারের বড় ধরনের আর্থিক বোঝা আরও বড় করে তুলবে। এমন শঙ্কার কথা তুলে ধরে হয়েছে আর্থিক ঝুঁকি ও প্রশমন কৌশলপত্রে। আন্তর্জাতিক তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে অর্থ মন্ত্রণালয় এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। যা মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে প্রকাশ করা হয়। টাকার অবমূল্যায়নে ঝুঁকির কথা তুলে ধরে সেখানে বলা হয়, মার্কিন ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রার মান এক টাকা কমলে আগামী অর্থবছরে বিদ্যুতে অতিরিক্ত ভর্তুকি গুনতে হবে ৪৭৩ কোটি টাকা। আর টাকার মান ১০ শতাংশ হ্রাস পেলে সরকারের মোট ঋণ থেকে অতিরিক্ত বেড়ে যাবে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, যা সরকারের জন্য বড় ধরনের দায় সৃষ্টি করতে পারে।
‘আর্থিক ঝুঁকি ও প্রশমন কৌশল’ নামে প্রতিবেদনে আগামী অর্থবছরে অর্থনীতিতে কোন ধরনের ঝুঁকি আসতে পারে এবং তা নিরসনে কৌশল তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে সরকারের প্রধান আর্থিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেসব ঝুঁকি রয়েছে তার ওপর আলোচনা করা হয়েছে। এই আর্থিক ঝুঁকি শনাক্তের ক্ষেত্রে আইএমএফ কাঠামো (আইএমএফ-২০০৮) অনুসরণ করা হয়।
অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, মুদ্রা বিনিময় হার ওঠানামা করছে। আরও ঝুঁকি হচ্ছে আগামীতে বিনিময় হার বাজারভিত্তিক অর্থাৎ বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে। ওই সময় ডলারের মূল্য কিছুটা বাড়তে পারে। সেটি হলে সরকারের ভর্তুকি ব্যয়, রাজস্ব খাত, আমদানি খাত, ঋণসহ সার্বিক অর্থনীতিকে বড় ধরনের ধাক্কা দেবে।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, অর্থনৈতিক খাতে কী ধরনের ঝুঁকি আসতে পারে সেটি যেমন তুলে ধরা হয়েছে; পাশাপাশি তা নিরসনের কৌশলগুলোও বলা হয়েছে। এটি এক ধরনের আগাম প্রস্তুতি বলা যেতে পারে। আর এটি করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত চলতি অর্থবছরে বাজেট প্রণয়নের (এপিল-মে-২০২২) সময় মার্কিন ডলারের মূল্য ৮৬ টাকা ধরে সব ধরনের হিসাব নিকাশ করা হয়। কিন্তু বৈশ্বিক সংকটের কারণে রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি ডলার সংকট দেখা দেয়। এতে মুদ্রা বিনিময় হারে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ফলে আর্থিক খাতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়।
সূত্র মতে, আর্থিক ঝুঁকি ও প্রশমন কৌশল প্রতিবেদনে বলা হয়, মুদ্রা বিনিময় হার ওঠানামা বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আর্থিক ভারসাম্য ও ঋণের সামগ্রিক পরিমাণকে প্রভাবিত করেছে। শুধু তাই নয়, রাজস্ব আদায় এবং সরকারি ব্যয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে সার আমদানিতে ভর্তুকি পরিশোধ, জ্বালানি তেল আমদানির জন্য বিপিসিকে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বৈদেশিক অর্থায়নের অংশ (মূলধনী ব্যয়) এবং বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, কোভিড-১৯, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স হ্রাস এবং টাকার মূল্যমান কমে যাওয়ায় (অবচিতি) আমদানি ও ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধি পায়।
কৌশলপত্রে আশঙ্কা করা হয় ভর্তুকি ব্যয় নিয়ে। সেখানে বলা হয় মুদ্রা বিনিময় হার যে কোনো সময় ভর্তুকি ব্যয়ে উসকে দিতে পারে। টাকার অবমূল্যায়ন ও বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের শুরুতে ভর্তুকি বাড়িয়ে ৪০ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু দেখা গেছে, ডলারের মূল্য ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১১৫ টাকা পর্যন্ত ওঠে। এতে ভর্তুকি ব্যয় আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে ভর্তুকিতে দেওয়া হয় ৫০ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা। এভাবে বেড়ে প্রস্তাবিত বাজেটে ভর্তুকিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৬ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। এ ছাড়া মেগা প্রকল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে মুদ্রা বিনিময় হার। কারণ এই প্রকল্পগুলো আমদানি করা পণ্যের ওপর ব্যাপক হারে নির্ভরশীল। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এভাবে ব্যয় বেড়ে প্রকল্পগুলোতে অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা তৈরি করতে পারে।
মুদ্রা বিনিময় হার ওঠানামা করলে সরকারি ও সরকারি গ্যারান্টি যুক্ত ঋণে নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে একটি সমীক্ষা করছে অর্থ বিভাগ। সেখানে দেখানো হয়, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারি ও সরকারি গ্যারান্টি যুক্ত ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ৩৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এছাড়া ২০২৪-২৫ এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩৬ হাজার ৬০০ কোটি এবং ৩৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা। সমীক্ষায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ঋণ হিসাব দেখানো হয়েছে। সেখানে বলা হয় আগামী অর্থবছরে ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রার মান টাকা ১০ শতাংশ কমে তাহলে সরকারের ঋণ লক্ষ্যমাত্রা ৩৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৪০ হাজার ২০০ কোটি টাকায় উঠে যাবে। এতে অতিরিক্ত ঋণ বেড়ে যাবে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বিপরীত দিকে অর্থাৎ একই সময়ে টাকার মান ১০ শতাংশ কমলে সরকারের ঋণ ব্যয় কমবে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা। সেখানে বলা হয়, এই অনিয়মিত মুদ্রা বিনিময় হার মধ্যমেয়াদে আর্থিক বোঝা বাড়াতে পারে।