ডলার সংকটে ব্যাহত হতে পারে জ্বালানি আমদানি
জ্বালালানি তেল আমদানি করতে গিয়ে ডলার সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ডলার সংকটের যুক্তিতে দুই বছর ধরে এলসি খুলছে না বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এলসি খুলতে নানা প্রতিবন্ধকতা সরকারি ব্যাংকগুলোতে। এমন অবস্থায় ডলার সংকট না কাটলে জ্বালালানি তেলের আমদানি বাধাগ্রস্ত হবে। এসব আশঙ্কার কথা ইতোমধ্যে জ্বালালানি বিভাগকে অবহিত করেছে বিপিসি।
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বিপিসির প্রায় ৩৫ কোটি ডলার বকেয়া রয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। এ অর্থ পরিশোধের ব্যাপারে পাওনাদারদের চাপ রয়েছে। পরিশোধ করতে না পারলে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বিপিসি সাধারণত ডিজেল, বিমানের জ্বালালানি জেট এ-১, অকটেন, ফার্নেস অয়েল এবং মেরিন ফুয়েল আমদানি করে থাকে। আমদানি ছাড়াও স্থানীয় উৎস থেকে উৎপাদিত জ্বালালানি তেল দিয়ে চাহিদা পুরণ করে থাকে সংস্থাটি। বিপিসি বলছে, দেশে ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি, শিল্পায়ন, বিদ্যুৎকেন্দ্র বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিনিয়ত জ্বালালানি তেলের চাহিদাও বাড়ছে। ফলে জ্বালালানি তেলের আমদানি ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালালানি তেলের উচ্চমূল্য বা অস্থিতিশীলতা সংস্থাটিকে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছিুক বিপিসির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, বিপিসি প্রতিমাসে প্রায় ১৫টি কার্গো আমদানির মাধ্যমে সাড়ে চার লাখ মেট্রিক টন পরিশোধিত এবং এক লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত জ্বালালানি তেল আমদানি করে। বর্তমানে ডলার সংকটের কারণ দেখিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বিপিসির চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলছে না। ফলে সামগ্রিক জ্বালালানি তেল আমদানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এ কর্মকর্তা বলেন, গত দুবছর ধরে কোনো বেসরকারি ব্যাংক এলসি খুলছে না। সরকারি ব্যাংকগুলোও যদি না খুলে, তাহলে সরবরাহকারীরা তেল সরবরাহ করবে না। তিনি বলেন, ‘আমরা
মন্ত্রণালয়কে সামগ্রিক পরিস্থিতি অবহিত করে অনুরোধ করেছি, যেন জ্বালালানি তেল আমদানি ও সরবরাহকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোও এলসি খোলে। আমরা সুপারিশ করেছি যেন বিলাসী পণ্য আমদানি বন্ধ করে হলেও জরুরি জ্বালালানি পণ্য আমদানি নিশ্চিত করা হয়।’
বিপিসির হিসাব বলছে, প্রতিবছর জ্বালালানি তেলের আমদানি ও ব্যবহার বাড়ছে। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে জ্বালালানি তেল আমদানির পরিমাণ ছিল ৫৯ লাখ মেট্রিক টন। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ লাখ মেট্রিক টনে।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর দেশে যে পরিমাণ জ্বালালানি তেল আমদানি হয়, তার ৫০ শতাংশ আসে দ্ইু দেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়, অর্থাৎ ‘জিটুজি’ ভিত্তিতে। আর বাকি ৫০ শতাংশ আসে বিভিন্ন সরবরাহকারীর মাধ্যমে। উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক দরপত্র বা কোটেশন আহ্বান করে পরিশোধিত জ্বালালানি তেল আমদানি করা হয়। প্রতিবছর দুবার তেল আমদানির লক্ষ্যে টেন্ডার হয়। জানুয়ারি থেকে জুন এবং জুলাই থেকে ডিসেম্বর। বেসরকারি পর্যায়ে জ্বালালানি তেল আমদানি ও সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউনিপেক, ভিটল, ইকন, আইওসিএল, বিএসপি ও পিটিএলসিএল।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত তারা ক্রুড অয়েল আমদানি করেছে ১০ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, ডিজেল প্রায় ২৬ লাখ মেট্রিক টন, অকটেন এক লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন, জেট ফুয়েল দুই লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন, ফার্নেস অয়েল চার লাখ ২৮ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ও মেরিন ফুয়েল আমদানি করেছে ১৫ হাজার ৫০ মেট্রিক টন। এ ছাড়া সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানির প্রক্রিয়ায় আছেÑ ক্রুড অয়েল তিন লাখ ৮৬ হাজার মেট্রিক টন, ডিজেল ১৪ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন, জেট ফুয়েল এক লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন, অকটেন ৭৫ হাজার মেট্রিক টন, ফার্নেস অয়েল তিন লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন এবং মেরিন ফুয়েল ১৫ হাজার মেট্রিক টন। তিন মাসের জ্বালালানি তেল আমদানি করতে লাগে ২২ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা (প্রায় ২০৪ কোটি ডলার)।
এ বিষয়ে জ্বালালানি বিভাগের একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ডলার সংকট শুধু বিপিসির নয়, জ্বালালানি খাতের প্রায় সংস্থারই আছে। জ্বালালানি বিভাগ প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্থছাড় করার।
এ কর্মকর্তা বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে জেট ফুয়েলের ব্যারেল ১১০ ডলারের ওপরে ছিল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালালানি তেলও ৯০ থেকে ৯৪ ডলারের কাছাকাছি। সেটা মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত কিছুটা কমে। আবার জুলাই থেকে বাড়তে থাকে। এ কর্মকর্তা বলেন, আগস্টে সব ধরনের জ্বালালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। ফলে একই পরিমাণ জ্বালালানি আমদানি করতে বাংলাদেশকে খরচ করতে হচ্ছে বেশি টাকা। এর মধ্যে আছে ডলার সংকট।