শরীফুল আলম সুমন ও রফিকুল ইসলাম
উচ্চ মাধ্যমিকে চলতি বছরে পাসের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, পাশাপাশি বেড়েছে জিপিএ ৫ প্রাপ্তিও। এবার জিপিএ ৫ পেয়েছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। তাদের সঙ্গে জিপিএ ৪ পাওয়া শিক্ষার্থীদেরও প্রথম পছন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ভর্তি হওয়া। অথচ দেশসেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা মাত্র ছয় হাজার ৫৮২। তবে চলতি বছরের ভর্তি পরীক্ষায় এসব মেধাবী শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই ফেল করেছে। পরিস্থিতি এমন যে কোনো কোনো বিভাগের আসনসংখ্যার তুলনায় পাস করেছে কম শিক্ষার্থী। এতে শিক্ষাবিদরাও অবাক এবং তাঁরাও বিভক্ত হয়ে পড়েছেন দুই শিবিরে। এক পক্ষের অভিযোগ ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি নিয়ে, অন্য পক্ষ প্রশ্ন তুলেছে পড়ালেখার মান নিয়ে। আর চলমান এই বিতর্কের মধ্যে সবচেয়ে বিপদে ভর্তীচ্ছুরা। নানা ধরনের বিভ্রান্তি ভর করেছে তাদের মনে।
ঢাবির ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজি বিভাগে মাত্র দুজন উত্তীর্ণ হওয়ায় বিস্মিত সবাই।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, ফল খারাপের কারণ না খুঁজে পরস্পরকে দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আসলে সার্টিফিকেটের জন্য পড়া আর ভর্তি পরীক্ষা এক ব্যাপার নয়। তাই জিপিএ ৫ পেলেই যে ভর্তি পরীক্ষাতেও তারা ভালো করবে তা ঠিক নয়। দুই পরীক্ষার মধ্যে সমন্বয় জরুরি। তা না হলে এই সংকট চলতেই থাকবে।
ভর্তি পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ : চলতি বছরের ঢাবির ভর্তি পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ‘ক’ ইউনিটে পাস করেছে ২১.৫০ শতাংশ, ‘খ’ ইউনিটে ৯.৫৫ শতাংশ, ‘গ’ ইউনিটে ২০.৬১ শতাংশ, ‘ঘ’ ইউনিটে ১৬.৫৫ শতাংশ ও ‘চ’ ইউনিটে মাত্র ৩.১০ শতাংশ।। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি ইউনিটে পাসের গড় হার ১৪.২৬ শতাংশ। মোট তিন লাখ এক হাজার ১৩৮ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৫৫ হাজার ২৭৮ জন। অথচ এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে ৭০ হাজার ৬০২ জন। অর্থাৎ তাদের অনেকেই ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পাঁচটি ইউনিটে অংশগ্রহণ করেছিল দুই লাখ ১৭ হাজার শিক্ষার্থী। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয় ৪১ হাজার ৮৯১ জন। পাসের হার ছিল ১৯.৩০ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কম পাস করেছে।
চলতি বছর ঢাবির ভর্তি পরীক্ষায় ‘ক’ ইউনিটে এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পাওয়া ৩৭ হাজার ৩৪ জন আবেদন করেছিল। এর মধ্যে পাস করেছে ১২ হাজার ৮৫৪ জন। ‘খ’ ইউনিটে পাঁচ হাজার ২০০-এর মধ্যে এক হাজার ৩০৭ জন, ‘গ’ ইউনিটে ৯ হাজার ৬৯৭ জনের মধ্যে চার হাজার ৪৪৭ জন, ‘ঘ’ ইউনিটে ৩১ হাজার ৭৪০ জনের মধ্যে ছয় হাজার ৮১৪ জন ও ‘চ’ ইউনিটে ৮৮২ জনের মধ্যে ৬৪ জন পাস করেছে। সেই হিসাবে এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পাওয়া ৮৪ হাজার ৫৫৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় বসে পাস করেছে ২৫ হাজার ৪৮৬ জন। সেই হিসাবে উভয় পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া ৩০.১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী এবারের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ ফেল করেছে প্রায় ৭০ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করতে বাংলা ও ইংরেজিতে বাধ্যতামূলক আট নম্বর পেতে হবে। ১২০ নম্বরের ভর্তি পরীক্ষায় পাসের নম্বর ৪৮। প্রতিটি প্রশ্নের মান ১.২০। তবে ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বেশির ভাগই ফেল করেছে বাংলা ও ইংরেজিতে। যদিও শিক্ষার্থীদের উচ্চ মাধ্যমিকে বাংলা ও ইংরেজিতে ৪০০ নম্বরে পড়ে পাস করতে হয়েছে।
গত রবিবার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের বক্তব্যও ছিল পরস্পরবিরোধী। শিক্ষামন্ত্রী সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপ্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ, এ জন্য শিক্ষার্থীরা ফেল করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা পরিপূর্ণ না, এটা কোনো পরীক্ষাই না। এটা পাস ফেলের না, বাছাই পরীক্ষা। ছেলেমেয়েদের হেস্তনেস্ত করতে ফেল বলে প্রচার করেছেন? শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলার জন্য এটা করল? ছেলেমেয়েদের সর্বনাশ, হতাশাগ্রস্ত, নিরুৎসাহিত ও বিদেশে তাদের অগ্রহণযোগ্য করার জন্য ওই ধরনের বাছাই পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে।’ অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য গত রবিবার শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা মনে করি, আমাদের বাছাইপ্রক্রিয়া ঠিক আছে। কারণ সবাই পাস করলে তাদের আমরা ভর্তি নিতে পারব না। আমাদের কাজ শিক্ষার্থীদের জীবন গড়ে তোলা, ধ্বংস করা নয়।’
অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য অযৌক্তিক ও অনভিপ্রেত। ঢাবির এই ভর্তি পরীক্ষা আশির দশক থেকে চলে আসছে। এবার কেন এমন হলো? আমার মনে হয় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার মানে ধস নামার প্রতিফলন এটি। ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন করা হয় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাস থেকেই। এখন শিক্ষার্থীরা যদি মেধার প্রতিফলন ঘটাতে না পারে তাহলে তো এমন অবস্থা হবেই।’
তবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় ভিন্ন তথ্য। তাঁরা জানান, ছাত্রছাত্রীরা যা পড়ে আসে তার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের খুব কমই মিল থাকে। সে জন্যই দারস্ত হতে হয় কোচিং সেন্টারগুলোর। কিন্তু এখন ঢাবির ভর্তি পরীক্ষায় যে ধরনের প্রশ্ন হচ্ছে, তা যেকোনো সময়ের চেয়েও কঠিন। এ বছরের ফলাফল অনুযায়ী আগামী দিনে কোচিং সেন্টারগুলোর ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল হতে হবে। খুব কমসংখ্যক শিক্ষার্থী ঢাবিতে ভর্তির সুযোগ পেলেও ইচ্ছা করেই টাকা আয়ের জন্য অনেক বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীকে ভর্তি পরীক্ষায় বসার সুযোগ দেওয়া হয়। এবার প্রায় তিন লাখ এক হাজার ১৩৮ শিক্ষার্থী ঢাবির ভর্তি ফরম কিনেছে। ফরমের মূল্য নেওয়া হয়েছে ৩০০ টাকা। সেই হিসাবে এই খাত থেকেই আয় হয়েছে ৯ কোটি তিন লাখ ৪১ হাজার ৪০০ টাকা। কিন্তু আয়ের তুলনায় পরীক্ষার খরচ তেমন নয়।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘গত দু-তিন বছর ধরেই ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা ফলাফল খারাপ করছে। মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা আর ভর্তি পরীক্ষার মধ্যে তফাৎ আছে। যে পদ্ধতিতে তারা লেখাপড়া করে, সে পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হয় না। মানের ঘাটতি তো রয়েছেই। তবে রাতারাতি মান বাড়ানোও সম্ভব নয়। আর ঢালাওভাবে সবার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলাও ঠিক নয়। পরস্পরবিরোধী দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে কেন শিক্ষার্থীরা খারাপ ফল করছে তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। গত সাত-আট বছর আগে ব্রিটেনে একটি সংস্থার জরিপে বেরিয়ে আসে প্রতি পাঁচজন শিক্ষার্থীর একজন ভালোভাবে শিখছে না। সরকার কিন্তু পরস্পরকে দোষারোপ না করে আরেকটি সংস্থাকে দিয়ে জরিপ করাল। দেখল তথ্য ঠিক আছে। তখন কেন ভালোভাবে শিখছে না সেই কারণ খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হলো। আমাদেরও সেভাবে এগোতে হবে।’
প্রশ্ন ও পরীক্ষা পদ্ধতি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খ’ ইউনিটের প্রকাশিত ফলে দেখা গেছে, ২ হাজার ২২১ আসনের বিপরীতে পাস করেছে ৩ হাজার ৮৭৪ জন। পাসের হার ৯.৫৫ শতাংশ। এ ইউনিটের পরীক্ষায় ৪০ হাজার ৫৬৫ জন অংশগ্রহণ করলেও ফেল করেছে ৩৫ হাজার ২৮০ জন। উত্তরপত্র বাতিল করা হয়েছে এক হাজার ৪১১ জনের। বেশির ভাগই ফেল করেছে বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে। যদিও ভর্তি পরীক্ষায় বাংলা ও ইংরেজির প্রশ্ন তৈরি করা হয় উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের বই ও ব্যাকরণের ওপর ভিত্তি করে।
‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সাধারণ ইংরেজি, বাংলা, সাধারণ জ্ঞান-১ (বাংলাদেশ), সাধারণ জ্ঞান-২ (আন্তর্জাতিক) ও ঐচ্ছিক ইংরেজি বিষয়ে প্রশ্ন ছিল। এই ৫টি অংশের মধ্যে চারটির উত্তর বাধ্যতামূলক। ইংরেজি অংশের ২৫টি প্রশ্নের মধ্যে মূল বইয়ের বাইরে থেকে দেওয়া একটি অনুচ্ছেদ থেকে ৬টি প্রশ্ন, ইংরেজি ব্যাকরণ থেকে ১৪টি, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ইংরেজি বই থেকে ২টি, বঙ্গানুবাদ ১টি, সমার্থক শব্দ নির্ণয় ১টি, ফ্রেজ অ্যান্ড ইডিয়মস ১টি। বাংলা অংশে উচ্চমাধ্যমিকের মূল বই থেকে প্রশ্ন এসেছে ১১টি ও ব্যাকরণ থেকে ১৪টি। তবে উচ্চমাধ্যমিকে দুই বছরে ২০০ মার্কসের বাংলা ও বাংলা ব্যাকরণ পড়েও পাস মার্ক ৮ তুলতে পারেনি বেশির ভাগ পরীক্ষার্থী। ঐচ্ছিক ইংরেজি অংশে ২৫টি প্রশ্নের ৩টি ইংরেজি ব্যাকরণ থেকে, প্রশ্নে প্রদত্ত অনুচ্ছেদ থেকে ৬টি, বিপরীত শব্দ নির্ণয় ১টি, ইংরেজি সাহিত্যবিষয়ক ২টি এবং ১৩টি ছিল যথার্থ বা সমার্থক শব্দ নির্ণয়।
তবে চলতি বছর কলা অনুষদের অধীন ইংরেজি বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় নতুন একটি নিয়ম চালু করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নতুন নিয়ম অনুযায়ী কোনো শিক্ষার্থী ইংরেজি পড়তে ইচ্ছুক হলে প্রশ্নপত্রের ৫টি অংশের ঐচ্ছিক ইংরেজিসহ চারটি উত্তর বাধ্যতামূলক। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে আসা শিক্ষার্থীরাও ঐচ্ছিক ইংরেজির উত্তর দিতে পারবে। ইংরেজিতে পড়তে হলে ঐচ্ছিক ইংরেজিতে ১৫ নম্বর পেতে হবে। অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজিতে ভর্তি হতে হলে একজন শিক্ষার্থীকে ৬০ নম্বরের মধ্যে ৩৫ পেতে হবে। কিন্তু প্রকাশিত ফলে দেখা গেছে, এ শর্ত পূরণ করেছে মাত্র দুজন। ইংরেজিতে পড়তে ইচ্ছুক এমন ১৭ জন ঐচ্ছিক ইংরেজিতে পাস করেছে, কিন্তু বাধ্যতামূলক ইংরেজিতে ২০ মার্কসের শর্ত পূরণ করতে
পারেনি ১৫ জনই। যদিও ‘খ’ ইউনিট থেকে ১২৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার কথা।
বিভাগীয় শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত ইংরেজি বা ইংরেজি সাহিত্যে পারদর্শী শিক্ষার্থীদের বেছে নিতেই এ নিয়ম চালু করা হয়। কিন্তু সেটি এখন বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই এই বিভাগের শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়ে ঝামেলা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ঐচ্ছিক ইংরেজি পরীক্ষায় ক্রটিপূর্ণ সেট ও নিয়মবহির্ভূত উত্তরের কারণে ১ হাজার ৪১১ জনের প্রশ্নপত্র বাতিল করা হয়েছে। এ কারণেও কমসংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করেছে।