আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে ডিজিটাল হুন্ডি। এ কারণে দেশে কাঙ্খিত বৈদেশিক মুদ্রা আসছে না। আসছে কেবল অর্থ পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশনা সংবলিত ম্যাসেজ। বিদেশ থেকে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা প্রবাসীদের পরিবার-পরিজনের কাছে অর্থ পাঠানোর জন্য স্থানীয় এজেন্টের কাছে ইমেইল, মোবাইলে এসএমএস, মেসেঞ্জার, ইমো কিংবা হোয়াটস্যঅ্যাপে তাৎক্ষণিক বার্তা (মেসেজ) পাঠান। ওই বার্তা ধরে স্থানীয় এজেন্টরা সুবিধাভোগীর কাছে বৈধ চ্যানেলেই অর্থ পৌঁছে দেন। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকিং চ্যানেল ও মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান- এমএফএস সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন অ্যাপের সহায়তায় এজেন্ট ছাড়াই দেশে টাকা পাঠানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে ডিজিটাল হুন্ডির হাত ধরে দেশ থেকে অর্থ পাচারও বাড়ছে। কারণ একই পন্থায় স্থানীয় হুন্ডি ব্যবসায়ীরা তাদের বিদেশি এজেন্টদের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারে সহায়তা করছেন। মূলত করোনার পর সবকিছু খুলে যাওয়ায় হুন্ডি ব্যবসায়ীরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এ অবস্থায় বিদেশ থেকে অর্থ পাঠাতে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা কী ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করছে, তা খতিয়ে দেখতে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগ থেকে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার ওপর মতামত দেওয়া হয়েছে। এর পরই নড়েচড়ে বসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। অভিযান পরিচালনায় মাঠে নামানো হয়েছে প্রায় ১০টি টিম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, শুধু ডিজিটাল হুন্ডিই নয়, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে সব ধরনের অনিয়ম ও কারসাজি বন্ধে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কয়েকটি টিম মাঠে নেমেছে। ওইসব টিম ব্যাংক ও মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট পয়েন্টেও ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করছে।
সূত্রগুলো বলছে, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার পর এক ধরনের হুন্ডির ফাঁদে পড়ে রেমিট্যান্স। এর ফলে কয়েক মাস ধরে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। এমনকি নগদ সহায়তা বাড়ানোর পরও বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্সে তেমন উন্নতি হয়নি। মূলত ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারের রেট বেশি হওয়া এবং খরচ কম হওয়ায় প্রবাসীদের অনেকেই হুন্ডি পথে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন। এমন প্রেক্ষাপটে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে ব্যাংকিং চ্যানেলের সঙ্গে খোলাবাজারের ডলারের দামের পার্থক্য কমিয়ে আনা এবং প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা।
দেশে চার মাসের বেশি সময় ধরে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। আমদানি ব্যয়ের অস্বাভাবিক উল্লম্ফন ও প্রবাসী আয়ের নিম্নমুখী প্রবণতার কারণে ডলারের সংকটকে কেন্দ্র করেই এ অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে ডলারের বিপরীতে ক্রমশ মান হারাচ্ছে বাংলাদেশি টাকা। এ ছাড়া ডলারের সংকটে খোলাবাজারে ডলারের দাম রেকর্ড পর্যায়ে উঠেছে। বর্তমানে আন্তঃব্যাংকের সঙ্গে খোলাবাজারে ডলারের দামের পার্থক্য প্রায় ১২ টাকা। আর ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজার রেট অনেক বেশি হওয়ায় হুন্ডিতে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণেও ডিজিটাল হুন্ডি চাঙ্গা হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সর্ভিসেস বিভাগের ওই পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী পেমেন্ট সিস্টেমসের আধুনিকায়নের ফলে অর্থ স্থানান্তর অনেক সহজ হয়েছে। পেমেন্ট সিস্টেমস আধুনিকায়নের ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে ইন্টারনেট ব্যাংকিং ফান্ড ট্রান্সফার (আইবিএফটি), ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) এবং মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেসের (এমএফএস) মতো বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে তাৎক্ষণিক অর্থ স্থানান্তর করা যাচ্ছে। পেমেন্ট সিস্টেমসের আধুনিকায়নে একদিকে লেনেদেনে গতিশীলতা ও সুবিধা নিয়ে এলেও একই সঙ্গে অসাধু ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক অপব্যবহারের মাধ্যমে অনাকাক্সিক্ষত লেনদেনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে অনেক মানি চেঞ্জার ব্যবসায়ী হুন্ডি ব্যবসা করেন। এ ছাড়া অনেক মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টও এ ব্যবসায় জড়িত। রাজধানীসহ সারাদেশেই বৈধ লেনদেনের আড়ালে চলছে হুন্ডির কারবার। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীদের মেসেজ অনুযায়ী সুবিধাভোগীদের কাছে অর্থ পৌঁছানোর কাজটি করছেন মানি চেঞ্জারের কর্মীরাই। গত সপ্তাহে রাজধানীর দিলকুশায় কথা হয় এমন এক মানি চেঞ্জারের কর্মীর সঙ্গে, যিনি ৫ বছর ধরে প্রবাসীদের পরিবারের লোকজনের কাছে অর্থ পাঠানোর কাজ করছেন।
মানি চেঞ্জার ব্যবসায়ীর ওই এজেন্ট আমাদের সময়কে বলেন, ‘মোবাইলে অর্থ পাঠানোর পুরো মেসেজই পাঠানো হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুবিধাভোগীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টেই অর্থ পাঠানোর নির্দেশনা আসে। এ ছাড়া কম টাকার ক্ষেত্রে এমএফএসেও অর্থ পাঠানোর নির্দেশনা আসে। কারণ এমএফএসে অর্থ পাঠাতে চার্জ বেশি, কিন্তু ব্যাংকে সেটি নেই। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করলে সুবিধাভোগী চেক বই বা কার্ডে টাকা তুলে নিতে পারেন। এ ছাড়া সরাসরি অর্থ পাঠানোর নির্দেশনাও আসে। এ ক্ষেত্রে সুবিধাভোগীর ঠিকানা, মোবাইল নাম্বারসহ বিশেষ টোকেন নাম্বার পাঠানো হয়। একই টোকেন নাম্বার সুবিধাভোগীর মোবাইলেও দেওয়া হয়। এর পর ওই ঠিকানায় সরাসরি গিয়ে টোকেন নাম্বার মিলিয়ে টাকা পৌঁছে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ইউক্রেন-রাশিয়ার চলমান যুদ্ধসহ বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি এবং বৈদেশিক প্রবাসী আয় প্রভাবিত হওয়ায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে অস্থিতিশীলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ২০২০ সালে করোনা অতিমারীর প্রাদুর্ভাবে প্রবাসীদের চাকরি হারানো, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, কার্ব মার্কেটে ডলারের ঊর্ধ্বমুখী বিনিময় হার, প্রবাসীদের কর্তৃক ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ ইত্যাদি বিভিন্ন বাহ্যিক কারণে বর্তমানে রেমিট্যান্সের প্রবাহে ঋণাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। কাজেই আন্তর্জাতিক এ সংকটময় অবস্থা এবং বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের চলমান অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ সচল রাখা জরুরি। তাই রেমিট্যান্স কমার পেছনে কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা, তা অনুসন্ধান এবং হুন্ডি ব্যবসায়ীরা কী ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করছে, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার ওপর মতামত দেওয়া হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই পর্যবেক্ষণ বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগে পাঠানো হয়।
পর্যবেক্ষণে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০১৬ সালে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থা, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি এবং ডিজিটাল হুন্ডির ঘটনা, ইত্যাদি পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেমিট্যান্স ও পেমেন্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। তদন্ত পরবর্তী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো সম্ভব হয়।
জিয়াদুল ইসলাম