একদিকে করোনার মরণ থাবা, অন্যদিকে ডেঙ্গুর ছোবল। দিশেহারা মানুষ। করোনা ভাইরাসের মহামারীতে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বেড়ে চলেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২১৮ জন দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একই সময়ে মারা গেছেন ২ জন। তথ্য বলছে, চলতি বছর ডেঙ্গুতে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের মধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যা বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ডেঙ্গুতে শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। তবে এবার শিশু ও নারীরা বেশি আক্রান্ত হওয়ার পেছনে লকডাউনের প্রভাব রয়েছে।
তথ্য বলছে, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ৮ জন নারী ও ২ জন পুরুষসহ মোট ১০ জনের মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনার জন্য জমা হয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর)। তথ্য বলছে, যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে ৭ জনই শিশু, যাদের বয়স ১ থেকে ১০ বছর। আর ৩ জনের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।
জানা গেছে, রাজধানীতে ডেঙ্গুজ্বর মহামারী আকার ধারণ করেছে। নগরীর শত শত মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্তদের অনেকে ছুটছেন হাসপাতালে। আবার কেউ ছুটছেন চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বারে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হলেও হাসপাতালে ভর্তি হয়নি এমন রোগীর সংখ্যাই বেশি। ডেঙ্গুতে ৮০ শতাংশ রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় না। তারা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বাসায় অবস্থান করে থাকেন।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, চলতি বছর যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে তারা সেরোটাইপ-৩ দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন। এবার সেরোটাইপ ৩-এর সংক্রমণ হচ্ছে। ২০১৯ সালে যখন ডেঙ্গুর ব্যাপক সংক্রমণ হয়েছিল সেটিও সেরোটাইপ-৩ ছিল। একই সেরোটাইপ দিয়ে একজন একবারের বেশি সংক্রমিত হয় না। সে কারণে এবার জটিলতা কম হবে। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, এবার যারা ঘরে বেশি থাকে তারাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। করোনার প্রাদুর্ভাব থাকায় লকডাউন চলছে। এ কারণে নারী ও শিশুরা বাসায় বেশি থাকে। আর তারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। ডেঙ্গু সংক্রমণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমাদের অবহেলা রয়েছে। ডেঙ্গু মশা বাসার ভেতরে থাকে। এখন লকডাউন চলছে, স্কুল বন্ধ। শিশুরা বাসায় অবস্থান। শিশুরা বাসায় থাকছে বলে তারাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, ২০১৯ সালে ডেঙ্গু সংক্রমণ আকার ধারণ করেছিল। তখন সেরোটাইপ-৩ ছিল। এই বছর যেহেতু সেরোটাইপ-৩ দ্বারা সংক্রমণ হচ্ছে, সে কারণে সংক্রমণ ব্যাপক আকার ধারণ করার সম্ভাবনা কম। তারপরও ভাইরাস যেহেতু সব সময়ই তার রূপ পরিবর্তন করে সেহেতু বলা মুশকিল। এবারও সংক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে বাসায় যেন ডেঙ্গুর আবাসস্থল না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ডেঙ্গুর সংক্রমণ প্রতিরোধে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিপিএমপিএ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূইয়া বলেন, ডেঙ্গুতে শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে যে বিষয়টি ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে সেটি হলো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুদের শকসিনড্রোম বেশি পাওয়া যাচ্ছে। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে মশক নিধন করতে হবে। আমাদের বাসা-বাড়ি পরিষ্কার রাখতে হবে। শিশুসহ সবাইকে ফুলহাতা কাপড় পরতে হবে। বাড়ির পানি যেন জমে না থাকে।
জানা গেছে, এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু সংক্রমণের মৌসুম হলেও মে মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুর তেমন কোনো প্রকোপ দেখা যায়নি। তবে জুন থেকেই ডেঙ্গুজ্বরের রোগী বাড়তে শুরু করে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে থাকে তাদের তথ্য সংগ্রহ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম। রাজধানীর সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৪১টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান থেকে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া রাজধানীর বাইরে ৮টি বিভাগ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।
কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, রাজধানীতে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ২১৮ জন। আর গত ১ থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ২৪৩ জন। প্রতিদিন গড়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৫৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে ৩ বছর বয়সী একজন মেয়ে ও চট্টগ্রামে ২০ বছর বয়সী একজন মেয়ে মারা গেছে। ডেঙ্গুতে চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মারা যান ১০ জন। এর মধ্যে জুলাই মাসে ৪ জন মারা গেছেন। আর চলতি মাসের গেল ৫ দিনে মারা গেছেন ৬ জন।
কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত যে ১০ জন মারা গেছেন তাদের মধ্যে ৮ জন নারী ও ২ জন পুরুষ। মৃতের বয়সভিত্তিক তথ্য বলছে, যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে ৭ জনই শিশু। এর মধ্যে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ২ ছেলে ও ২ মেয়েসহ মারা গেছেন ৪ জন। তাদের দুজনের বয়স ২ বছর, একজনের বয়স ১ বছর আর একজনের বয়স ৪ বছর। এ ছাড়া ইবনেসিনা হাসপাতালে মারা গেছেন ৩ জন মেয়ে, যাদের ২ জনের বয়স ১০ বছর ও একজনের বয়স ৩ বছর। চট্টগ্রামে ২ মেয়ে মারা গেছেন, যাদের একজনের বয়স মধ্যে ২৫ জন ও একজনের বয়স ২০ বছর। এ ছাড়া স্কয়ার হাসপাতালে একজন নারী মারা গেছেন, যার বয়স ৩৫ বছর।
কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ৩ হাজার ৯০১ জন ডেঙ্গু রোগী ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ১০ জন মারা গেছেন। অবশিষ্ট রোগীদের মধ্যে ১ হাজার ১২ জন চিকিৎসাধীন আর হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ২ হাজার ৮৩৬ জন বাড়ি ফিরেছেন।
ডেঙ্গুর মাসভিত্তিক তথ্য বলছে- জানুয়ারিতে ৩২, ফেব্রুয়ারিতে ৯, মার্চে ১৩, এপ্রিলে ৩, মে মাসে ৪৩, জুন মাসে ২৭২ এবং জুলাই মাসে ২ হাজার ২৮৬ জন আর আগস্টের গত ৫ দিনে ১ হাজার ২৪৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ডেঙ্গু রোগী শুধু ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ছে তাই নয়। ডেঙ্গুজ্বরের রোগী এখন পাওয়া যাচ্ছে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল বিভাগে। সেখানকার কিছু মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার বাইরে ১০ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে গাজীপুর জেলায় ৪ জন, ময়মনসিংহ জেলায় ১ জন, চট্টগ্রাম জেলায় ২ জন, নড়াইল জেলায় ১ জন, সিরাজগঞ্জ জেলায় ১ জন, বরিশাল জেলায় ১ জন রয়েছে। কন্ট্রোল রুমের তথ্য বলছে, চলতি বছর ঢাকার বাইরের বিভাগীয় পর্যায়ে ১৪৪ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৬৩ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৭ জন, খুলনা বিভাগে ৩৭ জন, রাজশাহী বিভাগে ৫ জন ও বরিশাল বিভাগের ৭ জন রয়েছেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ আমাদের সময়কে বলেন, এপ্রিল থেকে অক্টোবর ডেঙ্গু রোগ ছড়ানো বাহক এডিস মশার উপদ্রব বাড়ে। এডিশ মশা ডেঙ্গু রোগ ছড়ায়। এখন ডেঙ্গুজ্বরের মৌসুম। কারও জ্বর হলে তাকে করোনা ভাইরাসের সঙ্গে ডেঙ্গুজ্বরের বিষয়টি স্মরণে রাখতে হবে। যদি কারও সর্দি, জ্বর, মাথাব্যথা, গলাব্যথার মতো উপসর্গ থাকে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে করোনা ও ডেঙ্গুর পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। এরপর রোগ শনাক্ত হলে চিকিৎসা নিতে হবে। কারও জ্বর থাকলে তিনি নিজে নিজে পরীক্ষা করবেন না, ওষুধ খাবেন না, চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যারা ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় না। যাদের প্লাটিলেট কমে ১ লাখের নিচে নেমে যায় তাদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়। যারা প্রথমবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে তাদের থেকে যারা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছে তাদের জটিলতা বেশি হয়। তাদের মৃত্যু ঝুঁকিও বেশি। এ ছাড়া যাদের উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ ও লিভার রোগ রয়েছে তাদেরও ডেঙ্গুজ্বরে মৃত্যু ঝুঁকি বেশি। এই ধরনের রোগীদের খুবই সর্তক থাকতে হবে। ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে এডিশ মশা যেন বংশবিস্তার করতে না পারে, সেজন্য ঘরে ভেতর ও বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। কোথাও পানি জমতে দেওয়া যাবে না। দিনের বেলায় বাসাবাড়িতে মশানাশক স্প্রে করে দরজা-জানালা কিছুক্ষণ বন্ধ রাখতে হবে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে মশা নিধনে পদক্ষেপ নিতে হবে।
চলতি বছর ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। আগামী দিনগুলোতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক রূপ নিতে পারে বলে মনে করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য বুলেটিনে এমন উদ্বেগের কথা জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম। তিনি বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি আবারও আশঙ্কাজনক রূপ নিতে পারে। বর্ষাকালে আমরা গত কয়েক বছর ধরেই দেখেছি এডিসবাহিত যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি, সেটি সময় সময় অত্যন্ত আশঙ্কাজনক রূপ নিয়েছে। ২০১৯ সালে আমরা দেখেছি ডেঙ্গু মহামারী আমাদের কীভাবে আক্রান্ত করেছিল। ২০২১ সালে এসে একই রকম একটি পরিস্থিতির মুখে আমরা দাঁড়িয়েছি। আমরা মনে করি, দ্রুত ব্যবস্থা নিলে সেটি মোকাবিলা করতে পারব।