ফাহিমা আক্তার সুমি
রাজধানীসহ সারা দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বাড়ছে। এরইমধ্যে আশঙ্কাজনক হারে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরাও। হাসপাতালগুলোতে গত সপ্তাহের চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে। এরমধ্যে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা উদ্বেগজনক। ঢাকা শিশু হাসপাতালে গত দুই সপ্তাহের তুলনায় এই সপ্তাহে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা রেকর্ড সংখ্যক হারে বাড়ছে। গতকাল এ হাসপাতালে রোগী ভর্তি মোট ৬৯ জন। আইসিইউতে ১০ জন। বেডের সংকট থাকায় পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগেই রোগীদের ছুটি দেয়া হচ্ছে।
এইচডিইউ ও আইসিইউতে কিছু রোগী ভর্তি আছে। মো. খলিলুর রহমান এগারো বছরের ডেঙ্গু আক্রান্ত মেয়েকে নিয়ে আছেন শিশু হাসপাতালে। তিনি বলেন, গত পাঁচদিন ধরে মেয়ে উম্মে সাদিয়া (১১)কে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি। প্রথমদিন তিনতলায় ভর্তি ছিলাম। সেখানে একদিনে ৩৩শ’ টাকা খরচ হয়েছে। এখন বিশেষায়িত ডেঙ্গু কর্নারে নিয়ে আসছে। চিকিৎসকরা মেয়েকে এখন আইসিইউতে নিতে চাচ্ছে। ত্রিশ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। গরিব মানুষ এত টাকা পাবো কোথায়? সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। দশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছি তারা নিতে রাজি না। সব টাকা নাকি একসঙ্গে জমা দিতে হবে। এখন আবার বলছে আইসিইউ খালি নেই। গুলশান থেকে এসেছেন মো. আইয়ুব হোসেন। তার বোনের দুই ছেলে ডেঙ্গু আক্রান্ত। তিনি বলেন, ৯ মাস বয়সী সাঈদ সাতদিন ধরে আইসিইউতে ছিল। আজ বেডে নিয়ে আসছে। অপর ভাগ্নে আসাদ ৫ বছর বয়সী। সে সাধারণ বেডে ভর্তি ছিল। এই কয়েকদিনে এক লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। আইসিইউতেই লেগেছে ৭০ হাজারের মতো। লাম রহমান (১২)। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে শিশু হাসপাতালে ভর্তি আছে। তার বোন ঐশী রহমান বলেন, গত রোববার তাকে হাসপাতালে ভর্তি করোনো হয়। শরীরে অনেক জ্বর। এর আগে ইবনে সিনা হাসপাতালে ডাক্তার দেখানো হয়েছিল। সেখান থেকে ডাক্তার শিশু হাসপাতালে নিয়ে আসার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী বাড়ায় ইতোমধ্যে ছয়টি হাসপাতালকে ডেঙ্গু রোগীর জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ শাফি আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, নতুন রোগী আসলে অবস্থা বুঝে আমরা ভর্তি নিয়ে নেই। গুরুতর কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দেয়া হয় না। এজন্য কিছু বেড ফিক্সড করে রেখেছি। ক্রিটিক্যাল রোগী আসলেই ভর্তি করে নেয়া হয়। যাদের একটু ভালো মনে হয় তাদের পরামর্শ দিয়ে বাসায় পাঠানো হয়। রোগীদের প্রচুর পরিমাণে পানি ও ফলমূল খেতে হবে। তিনি আরও বলেন, শিশুরা বেশি আক্রান্ত হওয়ার কারণ হলো ২০১৯ সালে স্ট্রেইন থ্রি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। গত বছর যারা স্ট্রেইন থ্রিতে আক্রান্ত এইবার তারা এডাল্ট হয়ে গেছে। যারা তখন আক্রান্ত হয়নি এখন অনেকে আক্রান্ত হচ্ছে। একটা স্ট্রেইন একজন মানুষ একবারের জায়গা দুইবার করতে পারে না। এইবার লকডাউনের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সবাই বাসায় বন্দি সেজন্য আক্রান্তের সংখ্যাটা রেকর্ড সংখ্যক বাড়ছে। সাধারণত ডেঙ্গু মশাগুলো বাচ্চাদেরই বেশি কামড়াতে সুযোগ পায়। কারণ এরা বেশির ভাগই হাঁটুর নিচে কামড়ায়। ছোট ছোট বাচ্চারা মুখে বলতে পারে না মশায় কামড় দিচ্ছে। যেটা বড়দের পক্ষে বলা সম্ভব। বা তারা কিন্তু মশাগুলো তাড়িয়ে দিতেই বোঝে না। এসব কারণেও কিন্তু বাচ্চারা আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। সারা পৃথিবীতে দশ বছরের নিচে বাচ্চারাই কিন্তু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বেশি হচ্ছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্তের পরবর্তীতে বাচ্চাদের ঝুঁকি সম্পর্কে পরিচালক বলেন, বাচ্চারা জ্বরে আক্রান্তের পাঁচ থেকে সাতদিনের মধ্যে সময়টা কিন্তু বেশি বিপজ্জনক। জ্বর কমে যায় কিন্তু রোগীর শরীরে কমপ্লিকেশনটা থেকে যায়। ডেঙ্গুর চারটি স্ট্রেইন আছে। পরবর্তীতে যদি আবার আরেকটি স্ট্রেইন দ্বারা আক্রান্ত হয়। ভালো হয়ে যাওয়ার পরেও কমপ্লিকেশনটা থেকে যায়। তাদের শরীরে ইমোরাইজ হয়। স্পেনডেড ডেঙ্গু হয়, সিভিয়ার ডেঙ্গু হয়ে যায়। শিশুদের ক্যান্সার ও হার্টের সমস্যা থাকা অবস্থায় ডেঙ্গু হলে ঝুঁকিটা বেশি থেকে যায়। শুধু বাচ্চারা না বড়রাও দ্বিতীয় টাইমে আক্রান্ত বেশি হয়। আরেকটি স্ট্রেইন হলে তখন কমপ্লিকেশনটা বেশি হবে। হাসপাতালে যারা ভর্তি হচ্ছে তাদের বয়স এক বছরের নিচেও আছে। পাঁচ থেকে দশ বছরও আছে। তবে এক বছরের নিচে বাচ্চারা একটু কম। বৃষ্টি হলে রোগীর সংখ্যা এর চেয়ে আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ তখন ডেঙ্গু মশার লার্ভাগুলো বেশি সৃষ্টি হয়। শিশুদের ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে হলে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। দিনের বেলা ও রাতে মশা মারার জন্য স্প্রে দিতে হবে। ঘুমালে মশারি ব্যবহারসহ বাড়ির আশেপাশে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। জমে থাকা পানিগুলোকে সরিয়ে ফেলতে হবে। তাহলে ডেঙ্গু থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাওয়া যাবে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত আরও ২৭৬ জন হাসপাতালে ভর্তি, এ পর্যন্ত ৩৭ জনের মৃত্যু: দেশে ডেঙ্গু রোগী বেড়েই চলছে। গত মাসের চেয়ে চলতি মাসে প্রায় তিনগুণ বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ২৭৬ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে রাজধানীতেই রয়েছেন গত ২৪ ঘণ্টায় ২৪৩ জন। আগস্ট মাসের ২৩ দিনে ৫ হাজার ৬৫৯ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে আগস্টের এই কয়েকদিনেই মারা গেছেন ২৫ জন আর জুলাইতে ১২ জন। গত জুলাই মাসেই ভর্তি হয়েছিলেন ২ হাজার ২৮৬ জন ডেঙ্গু রোগী। তার আগের মাসে এই সংখ্যা ছিল ২৭২ জন। সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এই তথ্য জানানো হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার বাইরে নতুন ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩৩ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ১৪৬ জন। ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে মোট ভর্তি রোগী আছেন ১ হাজার ৫৯ জন। অন্যান্য বিভাগে ভর্তি আছেন ৮৭ জন। চলতি বছরে এ পর্যন্ত মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৮ হাজার ৩১৭ জন। সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ৭ হাজার ১৩৪ জন।
রাজধানীর ৬ হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ঘোষণা: রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ ৬টি হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল সোমবার অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে। হাসপাতালগুলো হলো- স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড-ঢাকা, শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল-টঙ্গী গাজীপুর, রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল-কমলাপুর, আমিনবাজার ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল, লালকুঠি হাসপাতাল-মিরপুর, কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে সোমবার ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ২৯১ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের অধিকাংশই রাজধানীর বাসিন্দা। এরমধ্যে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ২৫৯ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩২ জন। বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৩৬ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ১লা জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে সর্বমোট রোগী ভর্তি হয়েছেন আট হাজার ৭৫০ জন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ছয় হাজার ৭৮৭ জন। ডেঙ্গুতে এ সময়ে মৃত্যু হয়েছে ৩৬ জনের।