স্টাফ রিপোর্টার : চাঁদপুর জেলা শহরের ঐতিহ্যবাহী মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বন্ধ হচ্ছে না ভর্তি জালিয়াতি। প্রতিষ্ঠানটির অর্থলোভী প্রধান শিক্ষক উত্তম কুমার সাহার বিরুদ্ধে অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে একের পর এক শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগ উঠছে। সর্বশেষ প্রধান শিক্ষক জালিয়াতি করেছেন চলিত শিক্ষা বর্ষের চতুর্থ শ্রেণীর ভর্তিতে। বিষয়টি চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের দৃষ্টিতে আসলে তিনি ঘটনা তদন্তে সদর উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) দায়িত্ব প্রদান করেছেন।
জানা গেছে, অনৈতিক সুবিধা নিয়ে প্রধান শিক্ষক উত্তম সাহা সুস্থ্য সবল এক শিক্ষার্থীকে প্রতিবন্ধী দেখিয়ে নিয়ম বর্হি:ভূতভাবে বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি করেন। যা নিয়ে এখন সর্বমহলে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। ফলে প্রশাসনিকভাকে এমন অনিয়মের সত্যতা যাছাই করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সহকারী কমিশনার (ভূমি) সহসাই তার প্রতিবেদন জমা দিবেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
গত ২০১২ সালে প্রধান শিক্ষক উত্তম কুমার সাহা মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই তার বিরুদ্ধে বছরব্যাপী আর্থিক সুবিধা নিয়ে ছাত্রী ভর্তি, প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক অর্থ আত্মসাৎ, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, অতিরিক্ত ফি আদায়, কোচিং বাণিজ্যসহ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের সীমাহীন অভিযোগ উঠতে থাকে।
এসব অভিযোগের সত্যতাও মিলে এক তদন্ত প্রতিবেদনে। চাঁদপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা উদয়ন দেওয়ান গত ২০ মার্চ জেলা প্রশাসক বরাবরে প্রেরিত তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ‘প্রধান শিক্ষকের লিখিত এবং মৌখিক বক্তব্য ও তথ্য প্রমানাদি পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, প্রধান শিক্ষক ভর্তি কমিটি/যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা না থাকা সত্ত্বেও মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪র্থ ও ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে বিভিন্ন শাখায় অতিরিক্ত ছাত্রী ভর্তি করিয়েছেন। ইহা অনিয়নম ও স্বেচ্ছাচারিতা’।
প্রতিবেদনে সার্বিক মন্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক কর্তৃক টাকার বিনিময় ছাত্রী ভর্তির বিষয়টি প্রমানিত। এছাড়া টিফিন খাতের হিসাবটিতে বিপুল সংখ্যক টাকা থাকার অধিক স্বচ্ছতার জন্য যৌথভাবে হিসাব পরিচালনা ও প্রয়োজনে টেন্ডারের মাধ্যমে টিফিন সরবরাহ করা যেতে পারে’।
যখন ব্যাপক অনিয়মের বিষয়টি তদন্ত চলছে, ঠিক তখনই ফের অর্থলোভী প্রধান শিক্ষক জাল জালিয়াতি ও নগদ অর্থে নিয়ে অহনা দাস নামের এক ছাত্রীকে প্রতিবন্ধী দেখিয়ে ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি করান গত জানুয়ারি মাসে। এমন অভিযোগ করেন বিদ্যালয়ের এক অভিভাবক। ফলে জেলা প্রশাসক এক সদস্যর তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তদন্তের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে সদর উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি)। তিনি তার তদন্তের প্রতিবেদন চলিত সপ্তাহে জমা দিবেন বলে সাংবাদিকদের জানান।
অপরদিকে ব্যপক অনিয়মের তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর উপজেলা নির্র্বাহী অফিসারকে লিখিতভাবে অপরাধের কথা স্বীকার করেন প্রধান শিক্ষক উত্তম কুমার সাহা। তিনি লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন, ২০১৫ সালে ৪র্থ শ্রেণীতে ১শ’ ২২জন ও ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ১শ’ ২২ জন মেধা তালিকানুযায়ী ভর্তি হয়। পরবর্তী ফেব্রুয়ারি মাসে ২৭ জন এপ্রিল মাসে ১৪ জনসহ আরো ২৫ জন ছাত্রী ভর্তি হয়। গত বছর এসব ভতিতে ক্রটি ও বিচ্যুতি ছিল যা আমি স্বীকার করছি। ভবিষ্যতে এ ধরনের ক্রটি হবেনা বলে অঙ্গিকার করছি’।
উত্তম নামের অধম শিক্ষকের অঙ্গীকার প্রদান করার পরও কিভাবে একই ভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি হয় তা নিয়ে সর্ব মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এছাড়া সরাসরি দোষ স্বীকার করার পর স্বপদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে বলে অনেকেই অভিমত দিয়েছে। শহরের শিক্ষাবিদসহ সচেতন মহলের দাবি, যেখানে শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড সেখানে শিক্ষক নামের এ অর্থলোভী ব্যক্তি শিক্ষার মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিচ্ছেন। ফলে মাতৃপীঠ উচ্চ বিদ্যালয়ের ও শত শত শিক্ষার্থীদের ভবিষৎ নিশ্চিত করতে এ শিক্ষক নামের অধমের অপসারনের দাবি করছেন তারা।
তারা আরো বলছেন আর কত অপরাধ করলে উত্তম কুমারকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। বিদ্যালয়টির শিক্ষার পরিবেশ ধরে রাখতে ও অনিয়ম- দুর্নীতি দূরীকরনে অভিলম্বে দুর্নীতিবাজ এ প্রধান শিক্ষককে অপসারণ করতে সচেতন মহল জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মর্কতার তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে উত্তম কুমারের অনিয়মের চিত্র হলো : ভর্তি কমিটি গত ২২ ডিসেম্বর ২০১৪ স্বাক্ষরে ৪র্থ শ্রেণীতে দিবা ও প্রভাতী শাখায় ১শ’ ২২ জন ও ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে আরো ১৫ জন মোট ১শ’ ৩৭ জনকে ভর্তির সুপারিশ করেন। একই সময় ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ১শ’ ২২ জন ও পরবর্তীতে আরো ১২ জন মোট ১শ’ ৩৪ জন ছাত্রীকে ভর্তির সুপারিশ করেন। এ দুই শ্রেণীরতে মোট ২শ’ ৭১ জন ভর্তির সুপারিশ থাকলেও তদন্তে দেখা যায় বিদ্যালয়ের হাজিরা খাতায় কেবল ৪র্থ শ্রেণীতে ১শ’ ৫৯ জন ও ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ১শ’ ৪৪ জন ছাত্রী ভর্তি হয়েছে।
ভর্তি কমিটি সুপারিশ করেছে মোট ২শ’ ৭১ জন। এ দুই শ্রেণীতে ২০১৫ সালে অতিরিক্তসহ ছাত্রী ভর্তি হয় ৩শ’ ৩ জন। অথাৎ ৩২ জন ছাত্রী নিয়ম বহিভূত ভর্তি হয়। এছাড়া ভর্তি কমিটির সুপারিশ ছাড়া প্রধান শিক্ষক উভয় শ্রেণীর প্রভাতি ও দিবা শখায় আরো ২৫ জন করে মোট ৫০ জন ছাত্রী ভর্তি করেন বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে।
এছাড়া ২০১৪ সালে ৪র্থ শ্রেণীতে ৪৩ জন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ৮৫ জন ছাত্রী অতিরিক্ত ভর্তি হয়। ২০১৩ সালে ৪র্থ শ্রেণীতে অতিরিক্ত ৩৪ জন ও ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ৬৯ জন অতিরিক্ত ছাত্রী ভর্তি হয়।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উত্তম কুমার সাহার সাথে যোগযোগ করা হলে তিনি বলেন, ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের জেলা প্রশাসকের অনুমতিতে ভর্তি করা হয়। অতিরিক্ত ছাত্রী ভর্তির যে প্রতিবেদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উদয়ন দেওয়ান দিয়েছেন তা’ সঠিক নয় বলে দাবি করেন তিনি । চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে কোন অতিরিক্ত ছাত্রী ভর্তি করা হয়নি। অহনা দাস নামক চতুর্থ শ্রেনীর ১জন ছাত্রীকে প্রভাতী শিফটে প্রতিবন্ধী কোঠায় ভর্তি করা হয়নি দাবি করে প্রধান শিক্ষক জানান, প্রতিবন্ধী কোঠায় কোন ছাত্রীকে ভর্তি করানো হয়নি। জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে অহনা দাসকে ভর্তি করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সবুর মন্ডলের সাথে যোগযোগ করা হলে তিনি জানান, অহনা দাস নামের কোন ছাত্রী ভর্তির বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে প্রধান শিক্ষক আমাকে জানিয়েছেন পৌরসভার প্রত্যয়নপত্রে প্রতিবন্ধী কোঠায় এক ছাত্রীকে ভর্তি করেছিলেন। প্রকৃত ঘটনার জানান পর তিনি ভর্তি বাতিল করেছেন। কিন্তু এখনো যে ঐ ছাত্রীর বাতিল বাতিল হয়নি তা আমার জানা নেই। জেলা প্রশাসক আরো বলেন, অনিয়ম পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এব্যাপারে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের অবৈধ ভর্তি বাণিজ্যের তদন্ত প্রতিবেদন সর্ম্পকে জেলা প্রশাসক বলেন, জেলা প্রশাসক কার্যলয়ের শিক্ষা শাখায় প্রতিবেদন জমা হয়েছে। পর্যালোচনা করে সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
শিরোনাম:
বুধবার , ২৬ মার্চ, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ১২ চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।