সাখাওয়াত হোসেন
জরুরী চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া খুবই প্রয়োজন রাজধানীর সবুজবাগের ব্যবসায়ী নান্নু হাওলাদারের। বাসা থাকা পাসপোর্ট হাতে নিয়ে দেখেন মেয়াদ শেষ। দ্রুত ছুটে যান কেরানীগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে। ৮০৫০টাকা জমা দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট পাওয়ার আবেদন করেন গত ২৭এপ্রিল। সাত কর্ম দিবসের মধ্যেই পাসপোর্ট দেয়া হবে বলে জানান কর্মকর্তারা। কিন্তু এক মাসেও হাতে পাননি কাঙ্খিত পাসপোর্টটি। দ্রুত চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে না পারায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিরাজ করছে এক ধরনের হতাশা ও আতংক। কখন কি হয়ে যায়। পাসপোর্ট পেতে এত যে মানুষের ভোগান্তি, সেটা কবে শেষ হবে? দেশে আর কত উন্নয়ন হলে মানুষ ঝামেলা ছাড়া নিজের পাসপোর্ট নিতে পারবে? এই দুটি প্রশ্নই এখন নান্নু হাওলাদারের।
তিনি আক্ষেপ করে ইনকিলাবকে বলেন, পাসপোর্ট অফিসের লোকজন কেন মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না? কর্মকর্তাদের কাছে গেলে বলে পরে আসেন, এখন ব্যস্ত। আর দালালের কাছে গেলে বলে আরো ৫হাজার টাকা লাগবে, তবেই দ্রুত পাসপোর্ট পাওয়া যাবে।
শুধু নান্নু হাওলাদার নন, এ ধরনের হয়রানি বা সঠিক সময়ে পাসপোর্ট না পাওয়ার অভিযোগ অনেক মানুষের। তারা কোথায় যাবেন, কার কাছে অভিযোগ করবেন তারও তথ্য নেই তাদের কাছে। নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট না পেয়ে অনেকের বিদেশযাত্রাও বাতিল হচ্ছে। চিকিৎসার জন্য রোগী আর ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিক কাজে দেশের বাইরে যেতে পারছেন না। পাসপোর্ট না থাকায় বিপাকে পড়েছেন হজ ও উমরা গমনেচ্ছু মানুষও। নবায়ন থেকে শুরু করে নতুন আবেদনকারী কমবেশি সবাই পাসেপার্ট পেতে বহুমুখী ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সকাল ৮টার আগেই লাইন শুরু হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের মধ্যে সেবাপ্রার্থীদের অপেক্ষাও বাড়তে থাকে। কিন্তু অপেক্ষমাণ সেবাপ্রার্থীদের বসা তো দূরের কথা ঠিকঠাক দাঁড়ানোরও জায়গা নেই। প্রথম ধাপের কাজ শেষ করে অফিসের ভেতর ঢুকলে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। ছবি তোলা, আঙুলের ছাপ, ভুল সংশোধনের, পুলিশ ভেরিফিকেশন সবগুলো রুমের সামনে মানুষের ভিড়। এসব রুমের সমনে থেকে অফিসের সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নামতে থাকে মানুষের দাঁড়িয়ে থাকার লাইন।
সরকারি এবং গুরুত্বপূর্ণ এমন একটি প্রতিষ্ঠানে সেবার মান নিয়ে ক্ষুব্ধ মানুষ। চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাবেন হালিমা খাতুন। তার দরকার জরুরি পাসপোর্ট। কিন্তু পাসপোর্ট অফিসে আসার পর নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বললেন, আমি এখানে পাসপোর্টের জন্য এসেছি, কোনো দুর্যোগের পর ত্রাণ নিতে আসিনি। টাকা দিয়ে আবেদন করেছি। অন্তত একটু বসার জায়গা থাকা উচিত।
ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ূব চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, গ্রাহকেরা পাসপোর্টে এমন ধরনের তথ্যের পরিবর্তন করতে চায়, যা আসলে অনেক কঠিন এবং জটিল সমস্যা। তখন তার পাসপোর্ট পেতে জটিলতা তৈরি হয়। কেউ যদি সঠিক তথ্য দেয়, তাহলে তার ই-পাসপোর্ট পেতে দেরি হচ্ছে না। পাসপোর্ট একটি বিশাল বিষয় এ বিষয়ে বুঝতে হবে।
মন্টু মিয়া নামে এক বেসরকারী চাকরি জীবি বলেন, জানুয়ারি মাসে যখন টাকা জমা দিয়ে ই-পাসপোর্টের আবেদন করি, তার এক মাস পর এল আবেদনপত্র জমা দেয়ার তারিখ। সব কাজ শেষ করার পর ২২ মার্চ ই-পাসপোর্ট ডেলিভারি পাব এমনই বলা হয়েছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট তারিখে এসে পাইনি। কেন হয়নি তার ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়নি। এপ্রিলেও একবার এসেছিলাম কোনো আপডেট পাইনি, বলা হয়েছিল তখনো রেডি হয়নি। প্রায় পাঁচ মাস ঘোরার পর রোববার ২২ মে পাসপোর্ট অফিসে এসে জানতে পারি ছেলের পাসপোর্ট হয়ে গেছে। পাসপোর্ট ডেলিভারি নেয়াও একটা যুদ্ধ। পদে পদে ভোগান্তি।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আগারগাঁও পাসপোর্ট কার্যালয়ের একজন পরিচালক বলেন, সবাই পাসপোর্ট পাচ্ছেন, কেউ পাসপোর্ট পাচ্ছেন না এটা বলা যাবে না। তবে না পাওয়ার সংখ্যা খুবই কম। তা ছাড়া গ্রাহকদের তুলনায় আমাদের জনবল কম, ফলে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়।
ভুক্তভোগীরা জানান, নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট না পাওয়ায় আবেদনকারীদের অনেকেই দ্রুত সময়ে পাসপোর্ট পেতে ঢাকায় আগারগাঁওয়ে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরে শীর্ষ কর্তাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। কেউ কেউ চেষ্টা চালিয়ে সফল হলেও বেশির ভাগই বিফল। তবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেকেই আসছেন ঢাকায় আগারগাঁওয়ে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরে। মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (এমআরপি) বই সঙ্কটের সুযোগে অফিস ঘিরে দৌরাত্ম্য বাড়ছে একশ্রেণীর দালাল সিন্ডিকেটের। দ্রুত পাসপোর্ট পাওয়ার আশায় দালালদের খপ্পরে পড়ছেন সেবাপ্রত্যাশীরা। সম্প্রতি আবেদনকারীরা আরো নতুন ভোগান্তিতে পড়েছেন। এ ছাড়া ওয়েবসাইট থেকে পাসপোর্টের আবেদন ফরম ডাউনলোডের পর হাতে লিখে পূরণ করে জমা দিলে তা গ্রহণ করছে না পাসপোর্ট অধিদফতর। সেখান থেকে বলা হয় অনলাইনে পূরণ করে আবেদনকারীকে ফরম জমা দিতে হবে। নতুন আবেদনকারীর ক্ষেত্রে পুলিশ রিপোর্ট পেতেও বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। তদন্তের জন্য বেশির ভাগ আবেদনকারী সংশ্লিষ্ট তদন্তকারীকে টাকা ঘুষ দিতে হয়। অবশ্য সেবাপ্রত্যাশীদের জন্য অনুসন্ধান ও সহায়তা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। যেখানে শত শত আবেদনকারী ভিড় জমাচ্ছেন।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, নিয়ম অনুযায়ী জরুরি ফি দিলে ১১ এবং সাধারণ ফি দিলে ২১ কার্যদিবসের মধ্যে পাসপোর্ট পাওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে জরুরি বা সাধারণ ফির মাঝে কোনো পার্থক্যই নেই। নির্ধারিত সময়ের পর নিয়মিত পাসপোর্ট অফিসে সকাল-দুপুর ধরনা দিতে হচ্ছে। আর আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে যারা আবেদন করেছেন তাদের ভোগান্তি আরো বেশি। কেননা আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে কাগজপত্র সঠিকভাবে যাচাইয়ে বেশি সময় লাগছে। তারপর ঢাকায় পাঠানো হলেও দিনের পর দিন ঝুলে থাকে পাসপোর্টের আবেদন। ফলে ঢাকা থেকে দ্রুত পাসপোর্ট প্রিন্ট হওয়ায় আঞ্চলিক কার্যালয়ে যথাসময়ে পৌঁছায় না পাসপোর্ট।