“খুন, সহিংসতা, দুর্ঘটনা ও অপমৃত্যুতে
প্রতিনিধি
দরজায় কড়া নাড়ছে একটি নতুন বছর। সবেমাত্র বিদায় নিলো ফরিদগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য একটি সহিংস বছর ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ। স্বাধীনতার ৪২ বছরে এ দেশে রাজনৈতিক অনেক উত্থান-পতনে রাজনৈতিক দলগুলো নানা কর্মসূিচ দিয়েছে। শান্তিপূর্ণভাবে সেসব কর্মসূচি পালনও করেছে দলগুলো। তবে গেলো বছরটি ছিলো ফরিদগঞ্জের রাজনীতির জন্য সবচে� সহিংস একটি বছর। পুরো উপজেলায় আইনশৃঙ্খলারও ঘটেছে চরম অবনতি। তেমনি বেশ ক�টি রহস্যজনক মৃত্যুও ঘটেছে। সেই রহস্যগুলোর জট আজও খোলেনি। নানা তথ্য-উপাত্ত থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা গেলো, খুন, সহিংসতা, দুর্ঘটনা ও অপমৃত্যুতে ফরিদগঞ্জে গত এক বছরে ৩১জনের প্রাণহানি ঘটেছে। যতগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার প্রায় সবগুলোর ব্যাপারেই থানায় মামালা দায়ের করা হয়েছে। অনেক মামলারই তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। বলতে গেলে থানা প্রশাসনের এক রকম উদাসীনতায় সেই মামলাগুলো আজও ফাইলবন্দি হয়ে আছে।
বছরের প্রথম অপমৃত্যুটি ঘটে ১৬ জানুয়ারি। এ দিন ধানুয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় এক প্রতিবন্ধী। এ ঘটনায় তখন সড়ক অবরোধ করে এলাকাবাসী বিক্ষোভ করলেও ঘাতক চালক আজও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এ দুর্ঘটনার ২২ দিন পর ৭ ফেব্র�য়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতে হলো এক বিজিবি সদস্যকে। ফরিদগঞ্জের কেরায়া এলাকায় একটি নসিমনের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান তিনি। ২২ ফেব্র�য়ারি ফরিদগঞ্জের বালিথুবায় মাদ্রাসা ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ঘটনার প্রতিবাদে মাদ্রাসার ছাত্ররা সাময়িক প্রতিবাদ জানালেও সুষ্ঠু বিচারের আশায় আজও নীরবে কাঁদছে নিহতের স্বজনরা। ৯ মার্চ ঢাকার উত্তরায় প্রাণ হারায় ফরিদগঞ্জের এক ব্যবসায়ী। এ ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করা হলে ঘটনার ২৩ দিন পর ময়না তদন্তের জন্য কবর থেকে লাশ উত্তোলন করে ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশ। লাশ উঠানো পর্যন্তই থমকে যায় মামলাটির কার্যক্রম। ২৫ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে প্রাণ হারায় ফরিদগঞ্জের শরিফুল ও সেলিনা নামের ২ গার্মেন্টস্ কর্মী। স্বজনরা শরিফুলের লাশের সন্ধান পেলেও সেলিনার লাশ আজও খুঁজে পায়নি। ২৭ এপ্রিল জান্নাতুল ফেরদাউস নামে ২ সন্তানের জননীর রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনায় ফরিদগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করা হলে জান্নাতের শাশুড়ি ও দেবরকে আটক করা হয়। পরবর্তীতে তাদেরকে ছেড়েও দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়। ১৬ এপ্রিল সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় মোঃ ইসমাইল হোসেন নামে এক যুবক। একই মাসের ৩ এপ্রিল মোবারক হোসেন নামে আরও এক জনের লাশ পায় ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশ। ২ মে ফরিদগঞ্জ বাজারস্থ একটি সমবায় সমিতির কম্পিউটার অপারেটর নাসরিন আক্তারের রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনায় মেয়ের বাবা বাদী হয়ে ফরিদগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করলেও আজও কোনো কুল কিনারা হয়নি মামলাটির। ৫ মে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের ডাকা সমাবেশে যোগ দিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান মোঃ আব্দুল গফুর ক্বারী নামে এক ব্যক্তি। পরবর্তীতে তার লাশ গ্রামের বাড়িতে এনে দাফন করা হয়। ২৯ জুন ফরিদগঞ্জ শোভান এলাকায় একটি জলাশয়ে এক শিশুর লাশ ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়। তার এ মৃত্যুকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করেছিলো অনেকেই। ১৬ জুন, দিনটি ছিলো ফরিদগঞ্জবাসীর জন্য অত্যন্ত হৃদয় বিদারক একটি দিন। একই দিনে পানিতে ডুবে ৩ শিশু এবং গাছ থেকে পড়ে এক বৃদ্ধের করুণ মৃত্যু ঘটে। ৩১ মে ফরিদগঞ্জ চির্কা চাঁদপুর গ্রাম থেকে অজ্ঞাত এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। ঐ নারীর ঠিকানা আজও জানা যায়নি বলে জানা যায়। ঘটনার মাত্র ২৭ দিনের মাথায় ফরিদগঞ্জ গৃদকালিন্দিয়া বাজার থেকে উদ্ধার করা হয় আরও এক অজ্ঞাত যুবকের লাশ। তার পরিচয়ও আজও বের করতে পারেনি ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশ। ১৮ জুলাই ফরিদগঞ্জ পৌর এলাকাস্থ কেরোয়া গ্রামে আত্মহত্যা করে এক সন্তানের জননী। ১৩ আগস্ট ফরিদগঞ্জ সুবিদপুরে বড় ভাইয়ের হাতে ছোট ভাই খুন হয়। ১৭ আগস্ট তানজিনা (১৯) নামে আরও এক গৃহবধূর রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। ৩০ আগস্ট পৃথক স্থান থেকে ২ গৃহবধূর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। একই দিনে চাঁদপুর আল আমিন হাসপাতালে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় প্রাণ হারান ফরিদগঞ্জের তাসলিমা আক্তার (২২)। ২ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ রূপসায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক দিনমজুরের করুণ মৃত্যু ঘটে। ৪ অক্টোবর উদ্ধার করা হয় অপহৃত শিশু ইমনের বস্তাবন্দি অর্ধ গলিত লাশ। ২০ অক্টোবর ফরিদগঞ্জ লাড়�য়া গ্রাম থেকে উদ্ধার করা হয় ওসমান গণি আখন্দ নামে এক যুবকের ঝুলন্ত লাশ। এ ঘটনাটি হত্যা না আত্মহত্যা তা আজও পরিষ্কার হয়নি লাড়�য়া গ্রামবাসীর কাছে। ২৫ অক্টোবরটি ফরিদগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য এক কালো অধ্যায়। ফরিদগঞ্জে এই প্রথম রাজনৈতিক সহিংসতায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারালো ৩ জন। যুবদলের ৩ পদবিধারী নেতা আরিফ, জাহাঙ্গীর ও বাবুল প্রাণ হারান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এ দিন ১৪৪ ধারা জারি করেছিল উপজেলা প্রশাসন। এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পরদিন সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকে ফরিদগঞ্জ উপজেলা বিএনপি। সর্বশেষ গত ১৩ নভেম্বর ৮ বছর বয়সী এক শিশুর চাঞ্চল্যকর আত্মহননের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ২০১৩ সালের ফরিদগঞ্জের লাশের মিছিল। অপমৃত্যু বা হত্যাকাণ্ড ছাড়াও সারা বছর ধর্ষণের শিকার হয়েছে বহু নারী। যাদের অনেকেই আজও ন্যায্য বিচার পাননি। গেলো বছরের রহস্যজনক মৃত্যুগুলোর রহস্যজট খোলার পাশাপাশি যতগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেগুলো ফাইলবন্দি না থেকে অচিরেই স্বজনরা তাদের দায়ের করা মামলার সুষ্ঠু বিচার পাবে সেই প্রত্যাশা সকলের। নতুন বছরে আর যেনো কোনো লাশের সংখ্যা গুণতে না হয়, আর যেনো কোনো নারী ধর্ষণের শিকার না হন, আর যেনো কোনো রহস্যজনক মৃত্যুর নাটকীয়তা দেখতে না হয় ফরিদগঞ্জবাসীকে সে বিষয়ে আরও সোচ্চার হওয়া উচিত উপজেলা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। এমনটাই দাবি বিশিষ্টজনদের।