ফরিদগঞ্জ প্রতিনিধি
ফরিদগঞ্জ উপজেলার চান্দ্রা শিশু-কিশোর একাডেমীর প্লে-গ্রুপের ছাত্র নাবিল রহমান ইমন (৬) অপহরণের পর হত্যার ঘটনার মামলাটি আদালতে চলমান থাকলেও ইমনের পিতা মিজান মুন্সী মামলার অগ্রগতি নিয়ে জানেন না। মামলাটি এখন কোন্ অবস্থায় রয়েছে তাও তিনি খোঁজ খবর নিচ্ছেন না মনের ক্ষোভে এমনটিই জানালেন ফোনে। তিনি বলেন, মামলাটির চার্জশীট এবং পরবর্তী সিআইডির কাছ থেকে অধিকতর তদন্তের জন্য আবেদনটি প্রত্যাহারে তদন্তকারী কর্মকর্তার কৌশলী আচরণের কাছে তিনি পরাজিত হন।
শুক্রবার ঢাকা থেকে ফোনে ইমনের বাবা মিজান মুন্সী জানান, ঘটনার মূল হোতা খাড়খাদিয়া গ্রামের ও ইমনদের ভাড়াটিয়া বাড়ির মালিক মোঃ শাহাজাহান মেকারের ছেলে শাহাজালাল হোসেন সোহাগকে আটকের পর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক চার্জশীট তৈরি করে। তিনি বলেন, তার ধারণা এই ঘটনাটি সোহাগ একা করেনি। তার সাথে আরো কেউ জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু পুলিশ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন না করেই তদন্ত শেষ করেন। সে সময়ে সিআইডি পুলিশের কাছে করা আবেদন প্রত্যাহারের কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, সোহাগ আটক এবং স্বীকারোক্তি দেয়ার ১৫/২০দিন পর মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য আবেদন করার পর হত্যার ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আক্তার হোসেন তাকে কুট কৌশলের মাধ্যমে এবং তাকে ভুল ব্যাখা দিয়ে প্রত্যাহার করাতে বাধ্য করিয়েছেন। তিনি জানান, এটি সিআইডি তদন্ত করলে আরো অনেক তথ্য বের হতো। মামলার গতি প্রকৃতি কি? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইমনের অপহরণ, হত্যার ঘটনার কারণে আমি তখন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলাম। সে সময় যে যে ভাবে বলেছে সে ভাবে কাজ করেছি। পরে সময় পেরোনোর সাথে সাথে বুঝতে পারি কোথায় কোথায় ভুল হয়েছে। তিনি বলেন, আমি আমার এক পরিচিত হোটেল ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পাওনা দশ লাথ টাকাসহ আরো বেশ কিছু মানুষের কাছ থেকে টাকা পাওয়ার কথা ছিল সে কথা অনেকেই জানতো। সোহাগ ইমনকে অপহরণের পর কেন ১০ লাখ টাকাই মুক্তিপণ চাইলো, কম বেশি নয় কেন? এ প্রশ্ন আজো তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। মামলার বিষয় নিয়ে মিজান মুন্সী জানান, মামলাটি পরিচালনা করতে একজন আইনজীবী নিয়োগ করলেও দু এক তারিখের পর মামলাটি নিয়ে আশাবাদী না হওয়ায় আর খোঁজ নেইনি।
মামলা নিয়ে সমঝোতার প্রস্তাব পেয়েছি কিনা এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, মুখে মুখে ক’ জন এ নিয়ে আলোচনা করলেও তাদের সাথে কঠোর আচরণে আর কেউ সাহস পায়নি।
এদিকে গত ১ অক্টোবর স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে অপহৃত হয় ইমন। অপহরণের পর পরেই অপহরণকারী সোহাগ (সেই সময় অজ্ঞাত) ইমনের মা রাশিদা বেগমের মোবাইলে ফোন করে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে এবং টাকা না পেলে ইমনকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।
অপহৃত ইমনের বিদেশ ফেরৎ বাবা মিজানুর রহমান বাদী হয়ে ২ অক্টোবর ফরিদগঞ্জ থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করে। থানা পুলিশের চারটি বিশেষ টিম ওই এলাকায় অভিযানে নামে। রাতেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বরকত পাটওয়ারী (৩৫) নামে একজনকে আটক করে নিয়ে আনলেও পরবর্তীতে তাকে ছেড়ে দেয়। এ বিষয়ে বরকত পাটওয়ারী জানান, তিনি দৈনিক আলোকিত চাঁদপুর পত্রিকার ফরিদগঞ্জ উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি হিসেবে ক’ দিন পুর্বে নিয়োগ পেয়েছিলেন। অপহরণের কথা শুনে তিনি খোঁজ খবর নিতে গিয়েছিলেন ইমনদের বাড়িতে। কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু এ ঘটনাকে পুঁজি করে গড়ে ওঠা একটি চক্র তাকেসহ আরো কয়েকজনকে ধরিয়ে দিয়ে ফায়দা লুটার চেষ্টা করে। যদিও শেষ পর্যন্ত প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসে। তিনি বলেন, ইমন হত্যার বিষয়টি অধিকতর তদন্ত হলে অপহরণের কারণসহ আরো অনেক তথ্য বেরিয়ে আসতো। তিনি আরো জানান, তাকে শুধুমাত্র হয়রানির উদ্দেশ্যে আটকের কারণে তার মোটা অঙ্কের আর্থিক ও মানসিক ভাবে যে ক্ষতি হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ দিবে কে? মাঝখানে পুলিশ সুবিধা নিয়েছে।
অন্যদিকে মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানা গেছে, ইমন হত্যার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আক্তার হোসেন একমাত্র আসামী হিসেবে শাহজালাল হোসেন সোহাগকে অভিযুক্ত করে গত ২ ডিসেম্বর’১৩ মামলার চার্জশীট (নং-১৮৫) প্রদান করে (মামলা নং-৩। তাং-২/১০/২০১৩, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২০০০/সংশোধিত ২০০৩-এর ৭/৮/৩০)। চার্জশীটে এজাহারে অভিযুক্ত অপর তিনজন মানিক খান, হারুন পাটওয়ারী ও মফিজুল ইসলাম শেখকে অব্যাহতি প্রদানের সুপারিশ করা হয়। চার্জশীটে সোহাগ তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে তথ্যই উল্লেখ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৪ অক্টোবর বেলা ১১টায় চাঁদপুর পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এক জনাকীর্ণ প্রেস ব্রিফিংয়ে স্কুল ছাত্র নাবিল রহমান ইমনের প্রকৃত খুনি সোহাগকে উপস্থাপন করা হয়। সোহাগের স্বীকারেক্তি মোতাবেক জানানো হয়, গত ১ অক্টোবর চান্দ্রা বাজারে বসবাসকারী মোঃ মিজানুর রহমানের শিশু পুত্র নাবিল রহমান ইমন এলাকার একটি কিন্ডারগার্টেনের শিশু শ্রেণীর ছাত্র। সে স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে সোহাগ তাকে অপহরণ করে তার ইলেক্ট্রনিক্স দোকানের ভিতর আটকে রাখে। ইমনকে যদি ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে সোহাগের কু-কর্মের কথা প্রকাশ পেয়ে যাবে ভেবে সোহাগ তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পরে মোবাইল সিম ও কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করে সোহাগ ইমনের মায়ের কাছে মুক্তিপণ হিসেবে ১০ লাখ টাকা দাবি করে। দাবিকৃত টাকা না দেয়া হলে ইমনকে হত্যা করা হবে বলে সোহাগ মোবাইল ফোনে ইমনের মাকে বলে। পরদিন ২ অক্টোবর অপহৃত শিশু ইমনের পিতা মিজানুর রহমান বাদী হয়ে ফরিদগঞ্জ থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ২০০০/সংশোধিত ২০০৩ এর ৭/৮/৩০ ধারায় মামলা দায়ের করে। ফরিদগঞ্জ থানার মামলা নং-৩০। এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ কামরুল ইসলামকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি ফরিদগঞ্জ থানার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক মোঃ আক্তার হোসেন ও জেলা গোয়েন্দা শাখার অফিসারদের সমন্বয়ে মামলার রহস্য উদ্ঘাটনে কাজ করেন। গোয়েন্দা কার্যক্রম গোপন সূত্র ও তথ্য প্রযুক্তি বিশ্লেষণসহ সব ধরনের ট্র্যাকিং শেষে ১৩ অক্টোবর রোববার চান্দ্রা বাজারের সোলায়মানের ছেলে ঘাতক সোহাগকে বাজার থেকে আটক করে। আটকের পর সোহাগকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে ইমন হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত ঘটনা পুলিশের কাছে স্বীকার করে। নিহত ইমনের পরিবার দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ঘাতক সোহাগদের বাসায় ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করে আসছে। সে জন্য সোহাগের সাথে ইমনের একটি সম্পর্ক ছিলো। খুনি সোহাগ স্বীকার করে বলে, নিহত ইমন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে সোহাগ তাকে ডেকে তার দোকোনে নিয়ে যায়। সেখানে ইমনকে একটি চিপসের প্যাকেট কিনে বসিয়ে রাখা হয়। তারপর সোহাগ তার মোবাইলের সিমকার্ড পরিবর্তন করে ও কন্ঠস্বর বিকৃত করে তার মায়ের কাছে ইমনের মুক্তিপণ হিসেবে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এর পূর্বে সোহাগ শিশু ইমনকে দোকানের ভিতর বলাৎকার করলে ইমন জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারপর ইমনকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে একটি কাগজের বাক্সের মধ্যে ভরে রেখে দেয়। এরপর সে দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যায়। বাড়িতে গিয়ে ইমনের মায়ের কাছ থেকে তার ছেলের অপহরণের ঘটনা জানতে পারলে সোহাগ অভিনয়ের মাধ্যমে ইমনের মায়ের সাথে ইমনকে খোঁজতে বেরিয়ে পরে। তখনও তার মধ্যে ইমনকে হত্যা করেছে বলে কোনো লক্ষণ ইমনের পরিবার বুঝতে পারেনি। ঐদিন রাতে চান্দ্রা এলাকার বিদ্যুতের লোডশেডিং দেখা দিলে রাত ১০টায় সোহাগ ইমনের মৃতদেহ একটি প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে চান্দ্রা বাজারের একটি ময়লার স্তূপের মধ্যে ফেলে দেয়। গত ৪ অক্টোবর চান্দ্রা বাজারের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ময়লার স্তূপটি পরিষ্কার করতে গেলে বস্তাবন্দী অবস্থায় শিশু ইমনের গলিত লাশ দেখতে পায়। ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশকে খবর দেয়া হলে তারা এসে ময়লার স্তূপ থেকে বস্তাবন্দী অবস্থায় লাশটি উদ্ধার করে। মৃত ইমনের পরিবার তাদের সন্তানের লাশ হিসেবে শনাক্ত করে। গত ১৩ অক্টোবর ঘাতক সোহাগকে আটক করা হলে সোহাগের স্বীকারোক্তি মতে তার দোকানের পেছনের একটি গাছের নিচ থেকে মৃত ইমনের স্কুল ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। এমনকি তার দোকান থেকে ইমনের লাশ রাখা কাগজের বাক্স, যে সীমে চাঁদা চাওয়া হয়েছে সে সীম কার্ড ও যে মোবাইলের মাধ্যমে কথা বলা হয়েছিলো তাও উদ্ধার করা হয়।