জিয়াদুল ইসলাম
দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় আমদানি বৃদ্ধিসহ অর্থনীতিতে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোতে দেখা দিয়েছে ডলার ও নগদ টাকার সংকট। ফলে ডলারের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্ত ব্যাংক কলমানি বাজারের সুদহার বেড়ে গেছে। অন্যদিকে, আমানতের সুদে সর্বনিম্ন সীমা আরোপ ও বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বৃদ্ধিতে ঋণের সুদহারও বাড়ছে। এতে আমদানি ব্যয় ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়তির দিকে রয়েছে। আগামী দিনে পণ্যের দাম আরো বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির পারদও চড়েছে।
২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার আঘাত আসার পর টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুুটিতে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। ওই সময় কলকারখানা বন্ধ থাকায় আমদানি-রপ্তানিও আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। চলতি বছরের মে-জুন থেকে করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ফলে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গণে সব ধরনের পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। এতে ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা বিদ্যমান বিনিয়োগের পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগেও আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এ কারণেই জ্বালানি তেল, শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ সব ধরনের পণ্য আমদানি বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) দুই হাজার ৩৩৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এই অঙ্ক ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫১.৩৩ শতাংশ বেশি। একই সময়ে দুই হাজার ৭৩২ কোটি ডলারের বিভিন্ন পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। এই অঙ্ক ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫২.২৬ শতাংশ বেশি। ব্যাংকগুলো বলছে, প্রবাসী আয়ের পতনের মধ্যে অস্বাভাবিক গতিতে আমদানি বৃদ্ধির কারণেই ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। এতে বাড়ছে ডলারের দাম। অন্যদিকে, দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংকগুলোর নগদ তহবিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে চলে যাচ্ছে।
গত সাড়ে তিন মাসের ব্যবধানে আন্ত ব্যাংকে ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় এক টাকা। ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে সাম্প্রতিক বাজারে ডলার বিক্রি বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, গত আগস্ট থেকে নভেম্বর—এই চার মাসে প্রায় ২০৩ কোটি ২০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামস-উল ইসলাম বলেন, ‘বাজারে সংকট ও দাম বৃদ্ধির কারণেই এই সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকার ডলার কিনতে হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। এর মাধ্যমে সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকার তহবিল বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে চলে গেছে। আন্ত ব্যাংক মুদ্রাবাজারে নগদ টাকার টানাটানি হওয়ার জন্য এটিও একটি কারণ। অন্যদিকে করোনার কারণে বেসরকারি ঋণের চাহিদা ব্যাপক কমায় সুদ কমিয়ে আমানতকারীদের নিরুৎসাহ করেছিল কিছু কিছু ব্যাংক, যারা এখন সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এই ব্যাংকগুলো আমানত নিরুৎসাহ করে অপেক্ষাকৃত কম সুদের কলমানি থেকে টাকা ধার করে ব্যবসা করে আসছিল। অল্প সময়ে মুনাফা অর্জনের মানসিকতার কারণে তারা এখন বিপদে পড়েছে। বাজারে চাহিদা তৈরি হওয়ায় এখন আন্ত ব্যাংকে কলমানি ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের সুদও বেড়ে গেছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দীর্ঘদিন পর গত ১৮ নভেম্বর আন্ত ব্যাংক কলমানিতে গড় সুদহার সাড়ে ৪ শতাংশে উঠেছে। এর আগে কলমানিতে ৩ শতাংশের বেশি সুদ উঠেছিল সর্বশেষ গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর। এদিকে, সর্বশেষ গত ১৮ নভেম্বর ৩০ দিন মেয়াদি বাংলাদেশ ব্যাংক বিলে ২.৬৫ শতাংশ সুদে লেনদেন হয়, যা গত জুনে ছিল ১.২৫ শতাংশ। গত আগস্টে ১৪ দিন মেয়াদি বাংলাদেশ ব্যাংক বিল ০. ৭৫ শতাংশ সুদে লেনদেন হলেও সর্বশেষ গত ১০ নভেম্বরের নিলামে তার সুদ বেড়ে হয় ২.৪৬ শতাংশ। আন্ত ব্যাংকে নগদ টাকার টানাটানি পরিস্থিতিতে সরকারের ব্যাংক ঋণ নেওয়ার ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হারও বেড়ে গেছে। সর্বশেষ গত ৬ ডিসেম্বর নিলামে ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদের হার ওঠে ৩.৪৯ শতাংশ। করোনার কারণে বেসরকারি খাতে অনেক ব্যাংকের ঋণের গড় সুদহার ৬ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে নেমে এলেও এখন আবার তা ৮ থেকে ৯ শতাংশে উঠেছে।
এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘করোনার কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ মন্দায় ব্যাংকিং খাতে প্রচুর উদ্বৃত্ত তারল্য জমে যায়। এ কারণে অনেক ব্যাংক সুদ (মুনাফা) কমিয়ে আমানতকারীদের নিরুৎসাহ করে আসছিল। এ পরিস্থিতিতে গত ৮ আগস্ট ব্যক্তি আমানতে মূল্যস্ফীতির কম সুদ না দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর থেকে আমানতের সুদ বাড়াতে হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। আমানতের খরচ বৃদ্ধির কারণে বেসরকারি ঋণসহ সব ধরনের ধারের সুদই বাড়ছে।’