চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট
বিদ্যুৎ কেনায় বিপিডিবির ব্যয় বাড়ছে ২৪ হাজার কোটি টাকা
মেহেদী হাসান রাহাত ও আবু তাহের
বিদ্যুৎ কেনার ব্যয় সংকুলান নিয়ে চাপে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। একদিকে জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যয়, অন্যদিকে বিপুল অংকের ক্যাপাসিটি চার্জ। সব মিলিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে প্রস্তাবিত অর্থ দিয়ে বিদ্যুৎ ক্রয়ের ব্যয় সংকুলান অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে নতুন করে সংশোধন করতে হয়েছে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিপিডিবির জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ কেনা বাবদ বিপিডিবিকে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ৬০ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। মার্চে তা বাড়িয়ে এ বাবদ মোট ৮৪ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ের অনুমোদন দিয়েছে অর্থ বিভাগ। সে অনুযায়ী এবার বিপিডিবির বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় বাড়ছে প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ২৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা।
সংস্থাটির অন্যান্য খাতের ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে বাড়তি এ খরচ সমন্বয় করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। বরাদ্দ সংশোধনের সময়ে এর মধ্যেই বিদ্যুৎ ক্রয়ের ব্যয় সীমিত রাখার নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ বিভাগ। তবে জরুরি পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত বরাদ্দের প্রয়োজন হলে অর্থ মন্ত্রণালয় সেটিও বিবেচনা করে দেখবে বলে জানিয়েছে।
বিপিডিবির সংশোধিত বরাদ্দ পর্যালোচনায় দেখা যায়, শুধু আমদানি বাদে বাকি সব খাতেই বিদ্যুৎ ক্রয়ে সংস্থাটির ব্যয় বাড়তে যাচ্ছে। এবারো সংস্থাটির সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদক (আইপিপি) ও ছোট আকারের আইপিপি (এসআইপিপি) থেকে বিদ্যুৎ কেনায়। অনুমোদিত বাজেটে আইপিপি ও এসআইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কেনায় বরাদ্দ ছিল ২৯ হাজার ৪৩৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৫ কোটি টাকায়। সে অনুযায়ী এ খাতে ব্যয় বাড়তে যাচ্ছে ১২ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা।
এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরেও বিপিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ ব্যয় বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল আইপিপি ও এসআইপিপিগুলো। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাবদ গত অর্থবছর ২০২০-২১-এর তুলনায় ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছিল বিপিডিবির। বাড়তি এ ব্যয়ের ৯৬ শতাংশই খরচ হয়েছিল আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কেনায়। অতিরিক্ত দামে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে এরই মধ্যে বিপিডিবির মোট পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকার বেশিতে।
রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের অনুমোদিত বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৪৭৬ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮০১ কোটি টাকায়। অর্থাৎ এবার শুধু রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কেনায় বিপিডিবির ব্যয় বাড়ছে ৩ হাজার ৩২৪ কোটি ৮১ লাখ টাকা। রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) থেকে বিদ্যুৎ কেনায় বিপিডিবির চলতি অর্থবছরে প্রায় ১ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা ব্যয় বাড়বে। অনুমোদিত বাজেটে এ বাবদ বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ২৬৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে ২ হাজার ৮০৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অনুমোদিত বাজেটে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বাবদ ১০ হাজার ৮৪১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। সংশোধিত বাজেটে এটি ১ হাজার ৭১১ কোটি টাকা কমে ৯ হাজার ১৩০ কোটি ৫৯ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
বিপিডিবির স্ট্র্যাটেজিক বিজনেস ইউনিটে (এসবিইউ) বা বিপিডিবির স্বায়ত্তশাসিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অর্থবছরের অনুমোদিত বাজেটে তেমন কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। তবে সংশোধিত বাজেটে ৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে অনুমোদিত বাজেটে ২ হাজার ৩৪৭ কোটি ৫০ লাখ টাকার বিদ্যুৎ কেনার কথা থাকলেও সংশোধিত বাজেটে এটি ১১৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৪৬০ কোটি ৯৮ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইজিসিবি) থেকে বিদ্যুৎ কেনায় ১ হাজার ১৮০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। সংশোধিত বাজেটে এটি প্রায় ৭৫ কোটি টাকা বেড়ে ১ হাজার ২৫৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা হয়েছে।
নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (এনডব্লিউপিজিসিএল), বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) ও বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) থেকে বিদ্যুৎ কেনায় বিপিডিবির ৭ হাজার ৯১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় বাড়বে। অনুমোদিত বাজেটে এ বাবদ সংস্থাটির ব্যয় বরাদ্দ ছিল ১৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। সংশোধনের পর বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৩০৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকায়। এনডব্লিউপিজিসিএল ও চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) যৌথ উদ্যোগে গঠিত কোম্পানি বিসিপিসিএল পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করছে। এর বাইরে এনডব্লিউপিজিসিএলের অধীনে ১ হাজার ৭৬৩ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। আর বাগেরহাটের রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করছে বিআইএফপিসিএল।
বিদ্যুৎ কেনায় বিপিডিবির ব্যয় বাড়লেও অনুমোদিত বাজেটের তুলনায় সংশোধিত বাজেটে বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ কমবে। এক্ষেত্রে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ইজিসিবি, এনডব্লিউপিজিসিএল, বিসিপিসিএল, বিআইএফসিএল এবং আমদানি বাবদ বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ কমবে। অন্যদিকে আইপিপি ও এসআইপিপি, রেন্টাল এবং আরপিসিএলের কাছ থেকে চলতি অর্থবছরে বিপিডিবির বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ বাড়বে।
বিপিডিবির সদস্য (অর্থ) সেখ আকতার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ বিপিডিবির ব্যয় বাড়ার অন্যতম কারণ জ্বালানি খরচ। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি আমদানিতে খরচ বেড়েছে। এছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বড় অংকের ঘাটতিও তৈরি হয়েছে। বিপিডিবির নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণে বিদেশ থেকে মালামাল কেনায় আগের চেয়ে কয়েক গুণ খরচ বেড়েছে। এসব কারণেই সংশোধিত বাজেটে খরচ বেড়ে যায়।’
অতিরিক্ত দামে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে বিপিডিবির পুঞ্জীভূত লোকসান বেড়ে ৬৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। খাতটিকে লোকসান থেকে ধীরে ধীরে বের করে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এজন্য তিন দফায় বিদ্যুতের ৫ শতাংশ হারে মোট ১৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। আরো কয়েক দফা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পক্ষ থেকেও বিদ্যুতে ভর্তুকি কমানোর চাপ রয়েছে।
বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতে সরকারের এখন পরিকল্পনা ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসা। কারণ ভর্তুকি দিলে এ খাতে ধনিক শ্রেণীই লাভবান হয়। ফলে পর্যায়ক্রমে এ থেকে বেরিয়ে এসে সব শ্রেণীর গ্রাহকের বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।’