বিশেষ ছাড়ের মধ্যেও ব্যাংক এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে খেলাপি ঋণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকের ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১৭ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হাল নাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, খেলাপি ঋণ কমাতে ঢালাও সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। করোনার কারণে গেল বছরও ঋণ পরিশোধে ছাড় ছিল। এছাড়া ঋণ পুনঃতফশিল, পুনর্গঠনসহ নানা ছাড়ে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আবার অনেক গ্রাহকের আবেদনে উচ্চ আদালত থেকে খেলাপি না দেখানোর ওপর আদেশ দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ আসলে কত, তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। এর বাইরে অবলোপন করা খেলাপি ঋণ রয়েছে আরও প্রায় অর্ধলাখ কোটি টাকা।
এছাড়া উচ্চ আদালতে অনেক ঋণ রিট করে নিয়মিত রাখা হয়েছে। ফলে আসলে কত টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংক খাতের সঠিক হিসাব করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
জানতে চাইলে বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে তথ্য দিয়েছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলে খেলাপি ঋণ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। আসলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কারণ খেলাপি ঋণকে কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই হিসাবে বিপুল অঙ্কের ঋণ অবলোপন দেখানো হয় না। আদালতে দীর্ঘদিন আটকে এবং বিচারাধীন আছে বড় অঙ্কের ঋণ। সেগুলোও এই হিসাবে নেই। এছাড়া বিশেষ সুবিধায় বড় অঙ্কের খেলাপি নিয়মিত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এটা খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে উচ্চ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়। কিন্তু এ মুহূর্তে ব্যাংক খাতে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে খেলাপির এই হার প্রায় ২৫ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৯৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। দ্বিতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে ঋণস্থিতি ছিল ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা।
এর মধ্যে খেলাপি ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ৩ মাসে খেলাপি ঋণ বাড়ল ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সে হিসাবে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩১ হাজার ১২২ কোটি টাকা।
তবে গত বছরের একই সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে খেলাপি ঋণ ৩৩ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা বেড়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ।
ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে গত দুই বছর কোনো টাকা পরিশোধ না করেও খেলাপি হয়নি। এ সুবিধা গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী করে তুলেছে। এ অবস্থায় জুলাইয়ে নতুন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এসে আরও ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণসংক্রান্ত নীতিমালা হালনাগাদ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নতুন নীতিমালায় আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। আগে যেখানে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ডাউন পেমেন্টের অর্থ জমা দিতে হতো।
পাশাপাশি খেলাপি ঋণ ৫ থেকে ৮ বছরে পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ ২ বছর সময় দেওয়া হতো। আবার নতুন করে ঋণও পাওয়া যাবে। এসব কারণে ঋণ শোধ না করে খেলাপিরা বিশেষ ছাড়ের অপেক্ষায় আছে।
দেশের ব্যাংক খাতে লাগামহীন খেলাপি বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে সংস্থাটির প্রতিনিধি দলের সদস্যরা এসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, অনিয়ম, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। ব্যবসার পরিবেশ দিতে হবে। একদিকে যাচাই-বাছাই ছাড়া ঋণ দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে ছোট উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছে না। সবখানে সুশাসনের ঘাটতি। তার মতে, ব্যাংক খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে। এর জন্য একটি শক্তিশালী ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অথনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এটা কিছুই নয়। প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ হবে। কারণ খেলাপি ঋণ বন্ধে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।
এদিকে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতেও খেলাপি ঋণ ১৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যা বিতরণ করা ঋণের প্রায় ২৫ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছরে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। সেসব ঋণই এখন খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। এ তালিকায় আছে অন্তত ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যাদের বিতরণ করা ঋণের ৩০ থেকে ৯৭ শতাংশই খেলাপি।
এর মধ্যে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে পারছে না। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফিন্যান্সের সাবেক এমডি পিকে হালদার নানা জালিয়াতির মাধ্যমে অন্তত ৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেন। তার লোপাটের শিকার প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আর্থিক খাতের গলার কাঁটা। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা ঋণ ৭৬ থেকে ৯৭ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে দেশে ৩৪টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালু আছে।
এর মধ্যে তিনটি সরকারি, ১২টি দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানায় এবং বাকিগুলো দেশীয় ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৭০ হাজার ৪১৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ১৭ হাজার ৩২৭ কোটি ১০ লাখ টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ।
খেলাপি ঋণের এই হারও এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। তিন মাস আগে গত জুনে ৬৯ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণ ছিল ১৫ হাজার ৯৩৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৩৯০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।