নূরে আলম জিকু
রাজধানীর তেজগাঁওয়ের বাসিন্দা হযরত আলী। অসুস্থ ছেলের উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাবেন। এজন্য লাগবে ছেলের পাসপোর্ট। নিয়ম অনুযায়ী আবেদনও করেন। তবে পাসপোর্ট আর মেলে না। এদিকে দিনে দিনে ছেলের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। চোখের সামনে ছেলের এমন দৃশ্য দেখে হযরত আলীর যেন ধৈর্য্য মানছেই না। আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ছেলের জন্মনিবন্ধন অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য প্রস্তুত হচ্ছে না পাসপোর্ট। পরবর্তীতে পূর্বের জন্ম সনদ নিয়ে সিটি করপোরেশনের দ্বারস্থ হন।
নতুন করে জন্মনিবন্ধনের আবেদন করেন। ৬ দিনের মধ্যে হাতে পান ছেলের নতুন জন্ম সনদ। এখানেই শেষ নয়, সনদ হাতে পেয়ে অবাক তিনি। সনদে ছেলের নামের বানান ভুল। এ যেন ভূতের আছর! ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়-৫ এর সামনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মানবজমিনকে তিনি বলেন, মনে হচ্ছে এক জন্ম সনদের জন্যই আমার ছেলে নাঈমকে বাঁচানো যাবে না। কয়েক মাস আগে তার ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর গ্রামের জায়গা জমি বিক্রি করে দিয়েছি ছেলের চিকিৎসার জন্য। ডাক্তার বলছে, তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। এজন্য ভারতের চেন্নাই নিতে হবে। এক মাস ধরে নেয়ার জন্য চেষ্টা করছি। ছেলের জন্ম সনদের জন্য তার পাসপোর্ট পাচ্ছি না। আর পাসপোর্ট না পেলে বিদেশে নিতে পারবো না। একটা মানুষের কতবার জন্মনিবন্ধন সনদ লাগে? ২০১৪ সালে সিটি করপোরেশন থেকে একবার নিয়েছি। সেটা নাকি এখন কাজে লাগবে না। নতুন করে আবার করিয়েছি। সেখানেও ভুলে ভরা। এখন সংশোধন করতে দিয়েছি। প্রতিদিনই আসি, সংশোধন আর হচ্ছে না। শুধু হযরত আলী নন জন্ম সনদ নিয়ে এমন ভোগান্তির শিকার লাখো মানুষ। একজনের জন্ম সনদে ৮টি ভুল করা হয়েছে এমন উদাহরণও আছে।
মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে লাগবে জন্মনিবন্ধন সনদ। এজন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-১ এ আবেদন করেছেন একজন গণমাধ্যমকর্মী। অনলাইনে যথাযথ তথ্য দিয়ে আবেদনপত্র পূরণ করেন। একাধিকবার তিনি সেই তথ্য যাচাইও করেন। তবে কোনো এক অদৃশ্য কারণে মেয়ের নামের বাংলা বানান ভুলভাবে লিপিবদ্ধ হয়। এমন নানা ভোগান্তি নিয়ে প্রতিদিনই সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিস, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী কার্যালয় ও ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে মানুষ ভিড় করছেন। কেউ আসছেন জন্মনিবন্ধন নিতে, কেউ আবেদনের কাগজপত্র জমা দিয়ে ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে, কেউ বা সংশোধনীর জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে ধর্না দিচ্ছেন। সামান্য ভুলের কারণে গ্রাম থেকে যেতে হচ্ছে শহরে কিংবা জেলা প্রশাসকের অফিসে। দিনের পর দিন আসা যাওয়ায়ও সামাধান মিলছে না ভুক্তভোগীদের।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে জন্মনিবন্ধনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন এমন কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, জন্মনিবন্ধনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। তারাই জন্মনিবন্ধন ও সংশোধনী নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের খপ্পরে পরছেন সাধারণ মানুষ। অতি লাভের আশায় অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবে জনসাধারণকে হয়রানি করছেন তারা। আগে যারা জন্ম সদন নিয়েছেন, তারা একটা ফরম পূরণ করেছেন। তারপর সনদ পেয়েছেন। নতুন নিয়ম অনুযায়ী সকল জন্ম সনদের ডাটা অনলাইনে আপলোড করা বাধ্যতামূলক। তবে বিগত ২ বছর ধরে অনলাইনে আবেদন করলে সকল ডাটা সার্ভারে আছে। অন্যদিকে ২ বছর আগে যারা জন্মনিবন্ধন সনদ নিয়েছেন, তাদের ডাটা অনলাইনে সঠিকভাবে আপলোড করা হয়নি। একাজে সংশ্লিষ্টরা শুধু মাত্র ইংরেজি নামগুলো অনলাইনে উঠিয়েছেন। সেখানেও অনেক ভুল করছেন। এছাড়া জন্মনিবন্ধনের নথি ঠিকমতো সংরক্ষণ না করায় বড় সমস্যা তৈরি হচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সাল থেকে গত জুন পর্যন্ত জন্মনিবন্ধন সংশোধনের জন্য প্রায় দেড় কোটি আবেদন পড়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশে বাংলা কিংবা ইংরেজি নামের বানান ভুল। বাকি ১৫ শতাংশের বয়স কিংবা ঠিকানায় ভুল তথ্য রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের দেয়া তথ্যানুসারে, চলতি বছরের ১৬ই জুলাই পর্যন্ত ২৫ লাখ ৯১ হাজার ৫৪৫টি জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন নিয়েছেন নগরবাসী। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সংশোধনের সংখ্যা ৬৪ হাজার ২৫১টি। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ বিভাগ জানায়, ২০২১ সালের ১লা জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩০শে জুন এক বছরে করপোরেশনের বিভিন্ন আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে জন্ম সনদ নিয়েছেন ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯৪ জন এবং মৃত্যু সনদ নিয়েছেন ২ হাজার ৭৮৮ জন।
আইটি বিশেষজ্ঞ ও রেজিস্ট্রারের দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, অনলাইনে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনে রয়েছে নানা জটিলতা। যার কারণে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। জটিল প্রক্রিয়ার কারণে আবেদন ও সংশোধন করতে সময় লাগছে। ছোট ছোট সমস্যারগুলো সমাধানের জন্য সর্বোচ্চ দপ্তরে ঘুরতে হয়। যা সিটি করপোরেশন কিংবা ইউনিয়ন পরিষদেই করা সম্ভব। কর্তৃপক্ষের সিস্টেম গাফিলতি, স্বেচ্ছাচারিতা আর সংশ্লিষ্টদের অনিয়মের কারণে মাসের পর বছরও কেটে যাচ্ছে। তবুও সামাধান মিলছে না। ক্রমেই এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। এছাড়া ভুল থাকার কারণে একই ব্যক্তি একাধিক স্থান থেকে জন্মনিবন্ধন নিচ্ছেন। যেটি অনলাইনে সমাধান করা হচ্ছে না।
ভোটার তালিকা, স্কুলে ভর্তি ও পাসপোর্ট করাসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে জন্মনিবন্ধন অত্যাবশ্যকীয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের দায়িত্বে রয়েছে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে এ কাজ বাস্তবায়ন করছে সংস্থাটি। তবে ভুল সংশোধনের জন্য দায়িত্বে থাকছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়।
এদিকে অনেকের জন্ম সনদের কাগজ থাকলেও অনলাইনে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকার সাত তলা বস্তি এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহিম। ২ বছর আগে মেয়ের জন্মনিবন্ধন করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়-৩ এ। ডকুমেন্ট হিসেবে করপোরেশন থেকে একটি হার্ডকপি দেয়া হয়। গত জুন মাসে গুলশানের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করান মেয়েকে। সে সময় জন্মনিবন্ধন সনদের ফটোকপি দেয়া হয়। পরবর্তীতে স্কুল থেকে জানানো হয়, জন্ম সনদটি সঠিক নয়। এটি অনলাইনে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন করে জন্মনিবন্ধন সনদ জমা দিতে হবে। সিটি করপোরেশনে যোগাযোগ করলে নতুন আরেকটি জন্ম সনদ করতে বলেন কর্মকর্তারা। মহাখালী আঞ্চলিক কার্যালয়ে নাম সংশোধন করতে আসেন ব্যবসায়ী আরিফুর রহমান। সেখানে তাকে জানানো হয়-নাম সংশোধনের জন্য তাকে যেতে হবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। আঞ্চলিক কার্যালয় জন্মনিবন্ধন দিলেও সংশোধনী করতে পারে না। আরিফুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, আমার পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে। ছেলের জন্মনিবন্ধন করতে নাকি আমার জন্ম সনদ লাগবে। ৫০ বছর আগে জন্ম নিয়েছি। পরিচয়পত্রও পেয়েছি। তাহলে নতুন করে জন্মনিবন্ধন করতে হবে কেন? একটা মানুষের কয়টি পরিচয়পত্র লাগবে? এটাতো হয়রানি। জন্মনিবন্ধন করেছি, সেটাও ভুল। কার কারণে ভুল হয়েছে জানি না।
২০০৯ সালের ২৪শে মে কাওরান বাজারের ডিএনসিসি’র কার্যালয়ে মো. আক্কাছ সিকদার নামে এক ব্যক্তি জন্ম সদন নেন। যার জন্মনিবন্ধন নম্বর ১৯৭২৩০৯০৬৩৯১৩২০৯৭। সম্প্রতি জরুরি কাজে সনদের প্রয়োজন হলে অনলাইনে চেক করেন। তার কাছে থাকা সনদে ইংরেজিতে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও অনলাইনে ৮টি ভুল রয়েছে তার সনদে। গত ২৬শে মে সংশোধনীর জন্য আবেদন করলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তিনি সংশোধিত সনদ পাননি। তিনি বলেন, একটা কাগজে ৮টি ভুল কি করে সম্ভব। ১৩ বছর ধরে কর্তৃপক্ষ কি কাজ করেছে। আগে অনলাইন ছিল না, যখন অনলাইনে তথ্য আপডেট করা হয়েছে তখন কি দেখে করেছেন? নাকি মনগড়া তথ্য দিয়ে অনলাইনে থাকা খালিঘরগুলো পূরণ করেছেন। আমি সব কাগজপত্র দিলেও এখন সেসব কিছু তারা দেখাতে পারছে না। সবকিছু উধাও হয়ে গেছে। তাদের ভুলের কারণে আমাকে দিনের পর দিন কাজ রেখে কর্তৃপক্ষের কাছে আসতে হচ্ছে। ২ মাস শেষ, আরও কতদিন লাগবে জানা নেই।
ঢাকার দুই সিটির কয়েকটি আঞ্চলিক কার্যালয় ঘুরে দেখা যায়, প্রতিদিন সহস্রাধিক মানুষ জন্মনিবন্ধন রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে ভিড় করছেন। টেবিলের উপর আবেদনের স্তূপ। এজন্য সার্ভার জটিলতাকে দায়ী করছেন দায়িত্বে থাকা কর্মীরা। তারা বলছেন, দিনের বেশিভাগ সময় সার্ভার ডাউন থাকে। অনেক সময় সারাদিনে একবারও সাইটে প্রবেশ করা যায় না। সন্ধ্যার দিকে সার্ভার জটিলতা কিছুটা কমলেও আবেদনের বিপরীতে নিবন্ধন হয় সামান্যই। এই সমস্যার কারণে রেজিস্ট্রার জেনারেল অফিসগুলোয় তো সবসময় ভিড় জমে থাকবেই। সবচেয়ে বেশি ভিড় করছেন সংশোধনী করতে আসা লোকজন।
ভোগান্তির শিকার বেশিরভাগের অভিযোগ- করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে নিবন্ধনের আবেদন করে ১৫ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এতেও অনেক সময় নিবন্ধন সম্পন্ন হয় না। সিটি করপোরেশনের অসংখ্য কর্মী দ্রুত নিবন্ধন করে দেয়ার নামে দালালি নিচ্ছেন। ৫০ টাকার নিবন্ধন ফির বদলে দালাল চক্র ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে একদিনেই নিবন্ধন সম্পন্ন করে দেন। এতে নাম ও ঠিকানা ভুল হয়।
রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, জন্মনিবন্ধন পদ্ধতি সহজ করার জন্য একাধিকবার সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোগান্তি কমিয়ে আনতে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জন্মনিবন্ধন অফিসের কর্মকর্তাদের নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবুও অদৃশ্য কারণে ভোগান্তি কমানো যাচ্ছে না। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে জন্মনিবন্ধন পাওয়ার কথা। এছাড়া নিয়ম অনুযায়ী ১ মাসের মধ্যে সংশোধনী হওয়ার কথা। তবে যারা দায়িত্বে রয়েছেন তাদের খামখেয়ালিপনার কারণে জনগণের ভোগান্তি হচ্ছে।
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা উপ-রেজিস্ট্রার জেনারেল (উপ-সচিব) মো. ওসমান ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।