নদীটি গ্রীষ্মে শুকিয়ে যায় আবার বর্ষার আগমনে যৌবন ফিরে পায় তাই লোকে তাঁর নাম দিয়েছে মরা গাঙ। এ গাঙের বুকেই ভাসমান বেদের বহর। মরাগাঙটি চাঁদপুর এবং মতলব থানাকে পৃথক করেছে। যার বুকে গড়ে ্উঠেছে মুক্তিপলস্নী গ্রাম। যাদের মুখের বানী খা-খা-বখখিলারে খা—–। কাঁচা ধইরা খা এরূপ সুর রচিয়তার নামই বেদে।এ সম্প্রদায়ের প্রধান সম্পদ ৬ থেকে ৮ হাতের ভাসমান ডিঙ্গা।
আধুনিক যুগে বেদেনীদের “এই সিঙ্গা লাগাই—–দাঁতের পোঁকা ফালাই” এরম্নপ জোরালো আবেদন এখন আর কারো মনে নাড়া দেয় না। ঠিক তেমনি আগের মতো কেউ আর চাল, ডাল, শাক-সবজির বিনিময়ে মাছ আনতে নদীর ঘাটে যান না। পরিতাপের বিষয় সরকারের আদমশুমারিতে যাদের নাম নেই।তারা নিজ মাটিতে বসবাস করেও পরবাসী। সাপ খেলা যাদের অন্যতম পেশা। এ পেশাতে এখন আর পেট চলে না তাই পুরম্নষরাও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরম্ন করেছেন এ অভাব ুঅনটনের যুগে।
বেদের মাঝে রয়েছে অনেক উপ-সম্প্রদায়। যেমন- মালবৈদ্য, বাজিকর, শালদার, সওদাগর, গড়ালি। শালদার নদী থেকে মাছ ধরে, ঝিনুক তোলে ও চুরিমালা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। গড়ালিদের একমাএ পেশা সাপধরা। সওদাগর চুড়িমালা, শাড়ি-কাপড় বিক্রি করেন। বেদে
সম্প্রদায়ের সওদাগর জাতির একজন ছিলেন আমাদের ভাসমান প্রতিবেশী। নাম তার ছনা সওদাগর। বর্তমানে তার উত্তরসূরিদের স্থায়ীভাবে বসতি নিবাস মতলব থানার জনতাবাজারের নিকট।
আর কিছু বসবাস করে ধনাগোদা নদীর পাড়ঘেঁশে মহেশমাড়ির ঘাটে। ভাসমান ছইওয়ালা ডিঙ্গাই বসবাস করত ছনার গোটা পরিবার। শীতকালে চাঁদপুর থানার মনোহরখাদী গ্রামের প্রধানীয়া বাড়ি সংলগ্ন মসজিদ ঘাটে ডিঙ্গা ভিড়ায় চুড়ি-মালার ডালা মাথায় টই টই করে সাড়া পাড়া ঘুরে বেড়াতেন। শীতকালের চাইতে বর্ষাকালে তার আনন্দ একটু বেশী।আনন্দকে বাড়িয়ে তোলার জন্য ডিঙ্গায় বাজানো হতো নানা রকম রহিম-রম্নববান, কমলার-বনবাস, বেহুলা-লখিন্দারের গানসহ ফাতেমা, কুলছুমা, বিলস্নালের জারি বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য।এছাড়া বর্ষায় ডিঙ্গি করে প্রতি বাড়ির ঘাটে যেতে পারতেন ছনা সওদাগর।
ছনা সওদাগর চুড়ি-মালা, চীনামাটির জিনিস, ঝাড়-ফুকরের সাথে তাবিজ-কবজও বিক্রি করতেন।
ছোট-খাট বিয়ের গয়না-ঘাটি ছনা সওদাগর হতে খরিদ করা হতো। আমার মনে আছে ঈদের আগে আমরা কিছু চাইলে বাবা-মা সমবেত স্বরে বলতেন ছনা আসুক কিনে দিবনি। ঠিকই আসলে পড়ে বোনের জন্য লালফিতা, আমার জন্য পুটকা, বাশিঁ। কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে লালফিতা, পুটকা, বাশিঁ। দু:খের বিষয় এর মাঝে আমরাও হারিয়েছি বাবা,মাকে। বেচেঁ নেই ছনা সওদাগরও।
এ সম্প্রদায়ের ব্যতিক্রম অনুষ্ঠান হলো বিয়ে। বিয়েতে বর নির্ধারিত গাছের ডালে অথবা ঘরের চালে বসে মৃত্যু ঝঁকি নেয়। কনে গাছের নীচে এসে বরকে নামাতে নানা আকুতি ুমিনতি করে আজীবন কনে বরকে আয়-রোজগার করে খাওয়াবে বলে প্রতিশ্রম্নতি দিলে বর নেমে আসে। তারা জাতে মুসলমান যৌতুকবিহীন বিয়ে বলে কোনো কাজী বা রেজিস্ট্রারের প্রয়োজন হয় না।
তবে তাদের নীতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে এখন মৃত্যু হলে আগেরদিনের মতো কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হয় না। সময়ের পরিপ্রেÿিতে লাশটি জায়গা হয় সাড়ে তিনহাত মাটির। শত দু:খ বেদনার পরও সর্বশেষ পলস্নীকবি জসিম্্্্্্্উদ্দীনের একটি গানের ভাষা দিয়ে শেষ করতে চাই – “মোরা এক ঘাটেতে রান্ধি বারি আরেক ঘাটে খাই সুখের সীমা নাই”।
লেখক:
এম.এইচ.মাহিন