সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এক দফা কর্মসূচির অংশ হিসেবে এবার ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে বিএনপি। আগামী ২৭শে জুলাই ঢাকায় এ মহাসমাবেশ করবে দলটি। একই দাবিতে এদিন ঢাকায় পৃথকভাবে মহাসমাবেশ করবে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। গতকাল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তারুণ্যের সমাবেশ থেকে মহাসমাবেশের ডাক দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী বর্তমান ফ্যাসিবাদী এবং কর্তৃত্ববাদী সরকারের পদত্যাগ ও বিদ্যমান অবৈধ সংসদের বিলুপ্তি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে তার অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি, মিথ্যা-গায়েবি মামলা প্রত্যাহার, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলাসহ ফরমায়েশি সাজা বাতিল, সংবিধান ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক দফা দাবিতে আগামী ২৭শে জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। তবে ঢাকায় মহাসমাবেশের স্থান উল্লেখ করেনি তিনি। বিএনপি মহাসচিব বলেন, বিরোধী দলকে দমনে গায়েবি মামলা দেয়া হচ্ছে। ভয় দেখিয়ে তারা বিরোধী দলকে দূরে রেখে নির্বাচন করার অপকৌশল করছে। কিন্তু নির্দলীয় সরকার ছাড়া এবার কোনো নির্বাচন হবে না। রাজপথেই ফায়সালা হবে।
আমাদের দাবি একটাই, সেটা হলো শেখ হাসিনার পদত্যাগ।
দীর্ঘ ৫ বছর পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করেছে বিএনপি। এর আগে ২০১৮ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করলেও পরবর্তীতে নয়াপল্টনেই নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে দলটি। বিএনপি’র তিন অঙ্গ-সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত তারুণ্যের সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সরকার প্রধানকে আবারো পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, এই সরকারের অধীনে বিএনপি কোনোদিনও নির্বাচনে যাবে না। নির্বাচন হবে না। কালবিলম্ব না করে অবিলম্বে দ্রুত আপনি (শেখ হাসিনা) পদত্যাগ করুন। সংসদ বিলুপ্ত করুন। দাসানুদাস নির্বাচন কমিশন বাতিল করে নতুন কমিশন গঠন করুন।
তিনি বলেন, সরকারের পদত্যাগের দাবিতে সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সংসদে থাকা জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, কমিউনিস্ট পার্টি সবাই বলেছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। অর্থাৎ কোনোভাবেই এবার নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া দেশে নির্বাচন হবে না। অতএব, বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান। এবার সেটি হবে না।
মির্জা ফখরুল বলেন, বর্তমান সরকার বৈধ নয়। তারা সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতায় বসে আছে। আর বড় বড় কথা বলে যে, তারা ক্ষমতায় আসলেই নাকি উন্নয়ন হয়। এরাই তো ২০১৪ সালে বিনাভোটে এমপি ঘোষণা করেছে। তাহলে তারা কি বৈধ? এই আওয়ামী লীগ বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনের ব্যবস্থা বহাল রেখেছে। কারণ তারা জানে নিরপেক্ষ নির্বাচনে জয়ী হতে পারবে না। এখন নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ১০টি আসনও পাবে না।
বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রবিরোধী উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এই সরকার অলিখিত একদলীয় শাসন বাকশাল চালু করেছে। তারা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রবিরোধী। মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে। মাথায় হিজাব বেঁধে আর হাতে তসবিহ নিয়ে বলেছিল- ১০ টাকা সের চাল খাওয়াবেন, ঘরে ঘরে চাকরি দেবেন এবং কৃষকদের বিনামূল্যে সার দেবেন। আজকে ঘরে ঘরে চাকরি নেই। টাকা ছাড়া চাকরি হয় না। বিসিএস পাস করলেও ভিন্নমতের কারণে চাকরি হয় না।
জাগপার প্রয়াত সভাপতি শফিউল আলম প্রধানের একটি বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে ফখরুল বলেন, এই সরকার কুত্তা মার্কা নির্বাচন করে। সর্বশেষ ঢাকা-১৭ আসনে নতুন মডেলের নির্বাচন দেখলাম। হিরো আলম বাচ্চা ছেলে বড় আশা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। আওয়ামী লীগ কাউকে সহ্য করতে পারে না। ওরা দেশকে নিজেদের তালুকদারি মনে করে। অথচ দেশের সমস্ত মানুষ মিলে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিলেন।
বিদ্যুৎ খাতে মহালুটপাট চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সরকার বিদ্যুৎ খাতে লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে। শুধু টাকা পাচারে ব্যস্ত। এদিকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অতএব, আর সময় নেই। এখন আমাদের অধিকার আদায় করার সময়।
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, সরকার এখনো আমাদের নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। দুদিন আগে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার একজন নেতা কবির আহমেদকে তুলে নেয়ার ১৬ ঘণ্টা পর বাসার সামনে পাওয়া গেছে। র্যাবের ওপর স্যাংশন রয়েছে তারপরেও তারা এসব কাজ করছে। আসলে তারা নির্বাচনে ভোট কাটতে নিজেদের মতো প্রশাসন সাজাচ্ছে। ভয় পেয়ে এসব করছে। ডিসি, এসপিদের সুবিধামতো জায়গায় বদলি করছে।
যাতে আগামী নির্বাচনে তারা আওয়ামী লীগের পক্ষ হয়ে ভোট চুরি করতে পারে। গত মঙ্গলবার ও বুধবার শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা কর্মসূচিতে লক্ষ্মীপুর, দিনাজপুর, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন স্থানে কাপুরুষোচিত হামলা ও আক্রমণ করেছে। কারণ তারা নির্বাচনে ভয় পায়।
গতকাল বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আনুষ্ঠানিকভাবে তারুণ্যের সমাবেশ শুরু হয়। ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল যৌথভাবে তারুণ্যের সমাবেশের আয়োজন করে। এর আগে দেশের বিভিন্ন শহরে ৫টি তারুণ্যের সমাবেশ করে গতকাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের তারুণ্যের সমাবেশের পর্ব শেষ করেছেন নেতারা। পূর্বঘোষিত এই সমাবেশকে কেন্দ্র করে একদিন আগে থেকেই ঢাকায় অবস্থান করেন নেতাকর্মীরা। গতকাল সকাল থেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও তার আশপাশের এলাকায় ভিড় করেন তারা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারপাশে বিশেষ করে শাহবাগ, রমনাপার্ক, মৎস্য ভবন, কাকরাইল মোড়, শিল্পকলা একাডেমির চারপাশ, প্রেস ক্লাব-হাইকোর্ট মোড়, সেগুনবাগিচাসহ আশপাশের এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। খ- খ- মিছিল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। এ ছাড়া সমাবেশ ঘিরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সতর্ক অবস্থানে ছিলেন পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সমাবেশ শুরুর আগেই জাসাসের শিল্পীবৃন্দ মঞ্চে গান পরিবেশনের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করেন।
যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সভাপতিত্বে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন, স্বেচ্ছাসেবকদলের সভাপতি এসএম জিলানী এবং বিশেষ বক্তা ছিলেন- ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম।
আরও বক্তব্য রাখেন, বিএনপি’র ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি’র আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, দক্ষিণের আহ্বায়ক মো. আবদুস সালাম, ময়মনসিংহ বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, ফরিদপুর বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ, কুমিল্লা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া, ঢাবি’র সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, বিগত আন্দোলনে গুম খুনের শিকার নেতাদের পরিবারের সদস্য, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দীর্ঘদিন জেল খাটা ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল প্রমুখ।
আমানউল্লাহ আমান বলেন, অনির্বাচিত ও ভোট চোর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছেন। এবার ভোট চোরের ক্ষমা নেই। তরুণরা তাদেরকে টেনে-হিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামাবে। ইতিমধ্যে পতনের আন্দোলন শুরু হয়েছে। এবার ফয়সালা হবে রাজপথে।