জান্নাতুল ও মারিয়াম দুই বোন। জান্নাতুল পরিবারের বড় মেয়ে। ছয় বছর আগে তাদের বাবা মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর দুই মেয়েকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন তার মা। বড় কষ্ট করেই মানুষ করেছেন দুই মেয়েকে। হঠাৎ বিয়ে হয়ে যায় বড় মেয়ে জান্নাতুলের। বিয়ের পর ছোট বোনকেও নিজের কাছে নিয়ে আসে জান্নাতুল। তাদের মা হয়ে পড়েন আরও একা। কিন্তু মায়ের একাকী গল্পের অবসান ঘটাতে এগিয়ে আসে মেয়ে জান্নাতুল। এ বিয়েতে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন জান্নাতুল ফেরদৌসের স্বামী মাহমুদুল ইসলাম। কেবল তা–ই নয়, তিনি শাশুড়ির বিয়েতে উকিল বাবার ভূমিকায় ছিলেন।
মাকে বিয়ে দেওয়ার সেইসব গল্প জান্নাতুল ফেসবুকে পোস্ট করেন। স্যোসাল মিডিয়ায় চলতে থাকে আলোচনা-সমালোচনা। পাঠকের জন্য জান্নাতুল ফেরদৌস লিজার পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হল-
‘আজ আমাদের মায়ের বিয়ে। আমরা ২ বোন, আমার হাজবেন্ড এবং পরিবারের কয়েকজন সদস্য মিলে হাসিমুখে আমার মায়ের বিয়ে দিয়েছি।
কিছুদিন আগে আমার বিয়ের এক বছর পূর্ণ হলো। আমার মা একা হাতে যতটুকু সম্ভব ছিল ততটুকু করেই আমাকে নতুন সংসারে পাঠিয়ে নিজে সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েছিলেন। কারণ তার স্বামীও নেই, ছেলেও নেই, বড় ভাই নেই, এবং বাবাও নেই। মোটকথা, তাকে নিরাপত্তা দেয়ার অথবা একান্তে কিছু কষ্ট ভাগ করে নেওয়ার তেমন কোনো মানুষ ছিল না। তাই আজ আমরা আমার মাকে নতুন একটা সংসার দিলাম।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কথাটা শুনতে খুবই খারাপ শোনায় তাই না? বয়স হয়ে গেছে। এই বয়সে বিয়ে এটা কি ধরনের কথা। মহিলাটা মনে হয় ভালো না। স্বামীকে মনে হয় ভালোইবাসতো না তাই বিয়ে করলো ইত্যাদি ইত্যাদি! তাই আমাদের মনে হয়েছে একা থেকে লোকের আজেবাজে কথা শুনে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে বিয়ের মত পবিত্র ব্যাপার আর কিছু হতেই পারে না। কারণ আমি দেখেছি আমার বিধবা অসহায় মাকে কত বিশ্রিভাবে অপদস্থ করেছে অনেকেই! কিছু ক্ষেত্রে প্রতিবাদও করতে পারিনি! হয়তো অলরেডি আমার মা এবং আমাদের নিয়ে মনে মনে খারাপ মন্তব্য করা শুরু করে দিয়েছেন।
সত্যি বলছি, তাতে আমার মোটেও দুঃখ, বা হতাশা বোধ করব না। কোনোদিন হবেও না ইনশাআল্লাহ।
আমার আব্বু মারা যাওয়ার পর আম্মুর সহায় সম্বল বলতে ছিলাম আমরা ২টা বোন। আর কিচ্ছু না। না ছিল অর্থনৈতিক জোর, না মানসিক জোর!
আম্মু প্রায়ই হাসতে হাসতে বলতো, ‘আমার তো ছেলে নাই। মেয়ে ২টা বিয়ে দিয়ে আমি বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাব। ওখানে আরও যত আমার মত একা মায়েরা থাকবে তাদের সাথে আমি থাকবো। গল্প করবো। আমি রাগে কটমট করে বলতাম, ‘মারিয়ামকে বিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিব। আর তুমি আমার কাছে থাকবা যতদিন বাঁচবা। আমিই তোমার বৃদ্ধাশ্রম! আম্মু হাসতো! হয়তো সে মনে মনে জানতো এটা সম্ভব হবে না! আমি আমার কথা রাখতে পারি নাই। তার পাশে থাকার চেষ্টা করলেও কাছে রাখাটা হয়ে উঠে নাই বিভিন্ন কারণে! এবং আমার মায়ের ছোট মেয়েটাকেও আমার কোলের মধ্যেই রেখে দিছি। কারণ আম্মুকে ছাড়া থাকতে পারলেও আমার ছোটবোনটাকে ছেড়ে থাকা এই মুহূর্তে আমার পক্ষে অসম্ভব!
আমার সাহসী মা, একা থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন হাসিমুখেই! এক বারও কোনো বিষয়ে না বলেনি! আমার আম্মু ভীষণ গল্পপ্রিয় মানুষ। সে আমার সাথে আড্ডা দিতে ভালোবাসে। কথা বলতে ভালোবাসে। রাজ্যের ঘটনা আমাকে না বলতে পারলে তার ভাল্লাগে না। যেহেতু আমিও প্রচুর টকেটিভ তাই আমাদের আড্ডা জমে ভালো। কিন্তু একটা সময় আসলো যখন আমার আর গল্প করার সময় নাই। খেয়েছো কিনা খোঁজ নিতেও কয়েকঘন্টা দেরি হয়ে যাচ্ছে। নিজের সংসার, পড়ালেখা, বিজনেস, টিউশনি নিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছি আমি। দিনদিন আমার মা আরও একা হয়ে গেল! সব বুঝেও আমি এক প্রকার নিরুপায় দিন পার করেছি। একবার ব্যস্ততা বেড়ে গেলে বৃদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত আর সে ব্যস্ততা কমে না! এদিকে আমার মায়ের অবসর সময় কাটানোর বয়স। একা একটা মানুষ কতদিন এভাবে সুস্থ থাকবে! আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী, মেয়ে সবারই একটা আলাদা সংসার আছে। কেউই তাকে সার্বক্ষণিক যত্ন দিতে পারবে না। যেটা এই বয়সে এসে ভীষণ প্রয়োজন! আমি, রনি এবং মারিয়াম এ ব্যাপারে প্রচুর ভেবেছি।
একা বেঁচে থাকাটা একপ্রকার শাস্তি। আর এমন শাস্তি পাওয়ার মত কোনো অন্যায় তো সে করেননি! তাহলে কেনো শেষ সময়টা সে একা থাকবে? কেন তার পাশে কথা বলার একটা মানুষ থাকবে না? তার স্বামী মারা গেছেন বলে? তার প্রচুর অর্থ নেই বলে? তার বয়স হয়েছে বলে? আমাদের এই মুখপোড়া সমাজের জন্য? নাকি তার ছেলে সন্তান নাই এটাই তার সবচেয়ে বড় অপরাধ? আমরা হয়তো অর্থনৈতিক সাপোর্ট তাকে দিতে পেরেছি। কিন্তু মানুষের অভাব কখনও টাকা দিয়ে মেটানো সম্ভব না। আর্থিক সচ্ছলতা অবশ্যই জরুরি। এবং একসাথে বাস করার জন্য একটা নিজের মানুষও খুব জরুরি।
আসলে, পাছে লোকে কিছু বলবে এই ভয়গুলো আমার সবসময়ই একটু কম ছিল! কারণ ভালো অথবা খারাপ কোনোটাতেই পাছে কথা বলা লোকের অভাব হয় না। এই দেশ হিপোক্রেটের দেশ! আমার ঘোর বিপদের সময়ও সাহায্য করার চেয়ে পাছে কথা বলার লোকের সংখ্যা দ্বিগুণ দেখেছি আমি! এখনও আমার পাছে আমাকে নিয়ে কথা বন্ধ হয়নি। তাই এদের ভয়ে আমার কোনো কিছুই কখনও আটকে থাকেনি, থাকবেও না।
নিম্ন মানসিকতার সমাজ ও মানুষদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আজ আমরা আমার মায়ের বিয়ে দিয়েছি। এবং প্রাউডলি সেটা সবাইকে এই পোস্টের মাধ্যমে একযোগে জানিয়ে দিলাম। আলহামদুলিল্লাহ!
একজন পরিশ্রমী, সৎচ্চরিত্রের অধিকারী এবং দুঃখিনী এই ভদ্রমহিলাকে আমি সম্মান করি এবং ভালোবাসি। আমি সম্মান করি সেই ভদ্রলোককেও যিনি বিয়ে করার মাধ্যমে বাকি জীবনটা আমার আম্মুর পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আল্লাহ তাদের সহায় হোন। আমিন।’
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: পরিচিত অনেকের এ ব্যাপারে নেগেটিভ মন্তব্য থাকতে পারে। দয়া করে সেগুলো আপনাদের কাছেই রাখুন এবং নিজেদের মধ্যে গসিপ চালিয়ে যান। কারণ গসিপ করার জন্য আপনাদের নতুন টপিক দরকার। পুরোনোগুলো আর কতদিন ঘাটাঘাটি করবেন! আমাদের অথবা আমার আম্মুর মাথা খাওয়ার চেষ্টা না করলে খুশি হবো। আর যদি খোঁচা মারতে ইচ্ছে করে তবে আমার সাথে যোগাযোগ করুন। আমার আম্মুকে বিব্রত না করতে অনুরোধ করা হলো। ধন্যবাদ।)
এভাবে জান্নাতুল ফেরদৌস লিজা তার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন।