জাতীয় মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের এর একটি মন্তব্য যার হেড লাইন “আইন প্রয়গকারী সংস্থার মানসিক পরীক্ষা প্রয়োজন ” ( যুগান্তর , ঢাকা ২৪ অক্টোবর ২০১৪ )।
ড. মিজানুর রহমানের মন্তব্যটি সামগ্রিক ভাবে কোন বিশেষ সংস্থাকে হেয় করার উদ্দ্যেশে করা হয়েছে বলে বিশ্বাস করিনা । কারন আমরা জানি যখন যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন দক্ষ ও অভিজ্ঞ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যে কোন দলের সুষ্ঠু ভাবে সরকার পরিচালনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় হাতিয়ার । এই দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা এক সরকারের আমলে এক দিনে , এক মাসে বা এক বছরে তৈরি হয়না । দিনের পর দিন , বছরের পর বছর এবং যুগের পর যুগ ধরে যখন যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশের আইন প্রয়গকারী বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সেই সরকার দেশের স্বার্থে দক্ষ করে গড়ে তোলে ।
সুতরাং দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বিবেচনায় সামগ্রিক ভাবে কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বা বাহিনীকে হেয় বা খাটো করে বিবেচনা করার কোন যুক্তি যুক্ত কারন নেই । যে সব বাহিনী সমস্ত দেশের সাধারন মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে , যারা সমস্ত দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাদের কে সামগ্রিক ভাবে হেয় করে দেখা মানে সমস্ত দেশের ভাব মূর্তিকে হেয় করে বা খাটো করে চিন্তা করা ।
ড. মিজানুর রহমানের উক্তিটি তদন্তাধিন বা বিচারাধীন যে বিশেষ বিষয়ের উপর করা হয়েছে সে বিষয়ের উপর আমার কোন মন্তব্য না রেখে শুধু বলা যেতে পারে যে , তাঁর উক্তিটিকে নেতিবাচক হিসাবে গ্রহন না করে এটাকে সর্বতোভাবে , সামগ্রিক ভাবে ইতিবাচক পরামর্শ হিসাবে গ্রহন করা যেতে পারে ।
তবে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতার এই পরামর্শ বা গুরুত্ব শুধু কোন বিশেষ বাহিনী বা সংস্থার জন্য না বরং যে কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কর্তব্য কর্মে যারা নিয়োজিত আছেন বা সার্বক্ষণিক মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপে যারা থাকেন এবং যে কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যারা সার্বক্ষণিক নিয়োজিত আছেন তাঁরা মানসিক সুসাস্থের জন্য এবং মানসিক চাপ প্রসমনের জন্য মাঝে মাঝেই বিজ্ঞ , সুপ্রতিষ্ঠিত , আন্তরিক কোন মনোবিজ্ঞানীর সাথে স্বেচ্ছা প্রণোদিত ভাবে “ counseling ” করতে পারেন বা মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শ এবং উপদেশ গ্রহন করতে পারেন । এক্ষেত্রে খুব সহজে , বিনা খরচে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শর জন্য বিভিন্ন সংস্থাতে বা প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারী / বেসরকারী উদ্যোগে সার্বক্ষণিক ভাবে সাধারন চিকিৎসকের পাশাপাশি একজন করে মনবিজ্ঞানী নিয়োগ দেয়া যেতে পারে ।
একজন সরকারী কর্মকর্তার স্ত্রী হিসাবে এবং নিজের পেশা বা কর্ম ক্ষেত্রের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞটা থেকে যতটুকু বুঝেছি , যতটুকু জেনেছি তার থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, যে কোন বেক্তি যে কোন পেশাতেই থাক না কেন সেখানে গুরু দায়িত্বপূর্ণ সার্বক্ষণিক কাজের চাপ , কর্মক্ষেত্রে অতিমাত্রায় দায়িত্ব কর্তব্য বা দুশ্চিন্তা অথবা যে কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যারা বা যে সমস্ত সংস্থার কর্মকর্তা , কর্মচারী বা ব্যক্তিবর্গ নিয়োজিত আছেন তাদের সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা কতটা প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ।
এ সমস্ত গুরু দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ নিজেরাও বুঝতে পারেন না যে কর্মক্ষেত্র থেকে দিনের পর দিন কত খানি মানসিক স্বাস্থ্য ঝুকিতে তাঁরা থাকেন । মানসিক অসুস্থতা তখন ই গুরুত্ব পায় যখন সেটা শারীরিক অসুস্থতা রূপে দৃশ্যমান হয় ।
গবেষণা থেকে জানা যায় যে ,
Chronic stress increases the risk of developing health problems including obesity, diabetes, heart disease, cancer, and a weakened immune system. Chronic stress affects a person’s mental health.
(ইন্টারনেট )
অনেক দায়িত্বপূর্ণ , গুরুত্বপূর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যারা সার্বক্ষণিক নিয়জিত থাকেন তাদের মধ্যে অনেক সময় একধরনের মানসিক অস্থিরতা এবং অসহিষ্ণুতা কাজ করে যা আনেক ক্ষেত্রে পরিবার , পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতা এবং সমাজকে সংক্রমিত করে ।
যখন কাউকে তার কর্মক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক অতিরিক্ত দায়িত্ব , কর্তব্য এবং কাজের চাপ এর মধ্যে থাকতে হয় তখন ফলশ্রুতিতে অনেক ক্ষেত্রে অনিবার্য ভাবে সেটা শারীরিক ও মানসিক চাপে পরিণত হয় ।
“ When people feel under pressure at work it can lead to stress and anxiety. A short period of stress on its own is not likely to be considered a disability under law, but prolonged stress can become more serious and make existing mental health problems worse. It is in the best interests of employers and employees to avoid this situation, and create mentally healthy workplaces that are free from discrimination where well-being is a priority.”
(- ইন্টারনেট )
অনেক ক্ষেত্রে সৎ বিবেকবান ব্যক্তি যারা তারা দায়িত্ব কর্তব্য দুশ্চিন্তার মাত্রাতিরিক্ত গুরুভারে নিঃশব্দে মানসিক ভাবে অসুস্থ হন । দীর্ঘ মেয়াদী মানসিক অসুস্থতা থেকে কখনো কখনো ধীরে ধীরে বিভিন্ন মারাত্মক শারীরিক অসুস্থতাতে আক্রান্ত হন । অনেক সময় অকাল মৃত্যু পর্যন্ত বরণ করেন । ব্যক্তি বিশেষে , কাজের গুরুত্ব বিবেচনাতে বা কাজের ঝুঁকি অনুযায়ী বিভিন্ন জনের ক্ষেত্রে মানসিক চাপের লক্ষণ ভিন্নতর হতে পারে ।
কর্মক্ষেত্রের অতিরিক্ত মানসিক চাপে যেসব শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা তৈরি হয় তার মধ্যে অন্যতম লক্ষণগুলো হচ্ছে –
প্রত্যক্ষ জ্ঞান সম্বন্ধীয়:
• স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা বা সমস্যা
• মনোযোগ অক্ষমতা
• বিচার বিবেচনা লোপ পাওয়া
• সার্বক্ষণিক সবকিছুতে নেতিবাচক চিন্তা করা
• উদবিগ্নতা বা অনিয়ন্ত্রিত কাজ বা চিন্তা
• বিরামহীন দুশ্চিন্তা
আবেগ বা অনুভূতি সম্বন্ধীয়:
• বিষণ্ণ বা খিটখিটে মেজাজি
• ক্রোধ বা দেহে/শরীরে অস্বস্তিকর ভাব
• উদবিগ্নতা
• কমনীয়তা লোপ পাওয়া
• নিজেকে পরাভূত ভাবা
• একাকীত্ব বা নিঃসঙ্গ অনুভব করা
• উদ্যমহীনতা বা অসুখী
শারীরিক সম্বন্ধীয়:
• অবিরত যন্ত্রণা বা ব্যাথা
• ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য
• বমি বমি ভাব বা মাথা ঘোরা
• বুকে ব্যাথা , দ্রুততর হৃদস্পন্দন
• ঘন ঘন ঠাণ্ডা লাগা
আচরণ সম্বন্ধীয়:
• অধিক বা কম খাদ্য গ্রহন
• অতিরিক্ত ঘুম বা স্বল্প ঘুম
• অন্য থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখা
• কর্তব্য বা দায়িত্বে দীর্ঘসূত্রতা বা অবহেলা করা
• মাদক, সিগারেট বা ড্রাগ এ আসক্ত হয়া
• স্নায়বিক সমস্যা ( ইন্টারনেট)
সুতরাং যিনি যে পেশাতেই থাকেন না কেন ইচ্ছায় /অনিচ্ছায়ে বা প্রয়জনে/ অপ্রয়োজনে কর্ম ক্ষেত্রের মাত্রাতিরিক্ত চাপ থেকে যে সব মানসিক সমস্যা তৈরি হয় সেগুল উপেক্ষা , অবজ্ঞা বা লুকিয়ে রাখার কোন যুক্তি যুক্ত কারন নেই । এসব মানসিক সমস্যাই পরবর্তীতে মারাত্মক শারীরিক সমস্যার রূপ ধারন করে ।
আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে , যে কোন ছোট বড় শারীরিক সমস্যা নিয়ে যে কোন সময়ে আমরা সাধারণ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই অথচ ভয়ানক ভাবে মানসিক অসুস্থতাতে আক্রান্ত ব্যক্তি বা তাদের পরিবারের সদস্য পরামর্শ , উপদেশ বা চিকিৎসার জন্য সেচ্ছায় , সহজে , সপ্রণোদিত ভাবে কোন মনোবিজ্ঞানী বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে লজ্জা বোধ করেন । এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিরা শুধু নিজে অসুস্থ বা অশান্তিতে ভোগেন না বরং তাঁরা পরিবার , সমাজ , জাতিকে অসুস্থ এবং অশান্তিতে ভোগান ।
সমস্ত কিছু বিবেচনায় সব কিছুর ঊর্ধ্বে মানসিক সুস্বাস্থ্য এবং “মানসিক শান্তি” হোক আমাদের সবার সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার মুল মন্ত্র ।
লেখক: সাবিহা ইয়াসমিন ইসলাম
এডভোকেট,
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট