স্টাফ রিপোর্টার:॥ মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা গৌরবের ২৭ বছর ৩য় দিনে স্মৃতিচারণ পরিষদের ব্যবস্থাপনায় মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী চাঁদপুরের কৃতি সন্তান ডাঃ দেলোয়ার হোসেন স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন। এ সময় তিনি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বেশ কয়েকটি ফরিদগঞ্জ উপজেলার সম্মুখ যুদ্ধের ঘটনা নব প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেন।
তিনি বক্তব্যের শুরুতে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন, চাঁদপুর জেলার যোগ্য সন্তান মরহুম মিজানুর রহমান চৌধুরী, নওজোয়ান এম.ওয়ালী উলূøাহ,হাফেজ হাবিবুর রহমান, অ্যাড. আব্দুল আউয়াল, ফ্লাইট লেফ. এ.বি ছিদ্দিক, মরহুম আব্দুল করিম পাটওয়ারী, রাজা মিয়া পাটওয়ারী, গোলাম মোর্শেদ ফারুক, সেকান্দর আলী, ডাঃ আব্দুস সাত্তার, আব্দুর রব মিয়া, অ্যাড. সিরাজুল ইসলাম, অ্যাড.আবু জাফর, রফিউদ্দিন সোনা আখন্দ, নুরুল হক বাচ্চু মিয়াজী, প্রফেসর আব্দুস সাত্তার, জীবন কানাই চক্রবর্তী সহ আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধাদেরকে। তিনি বলেন, শ্যামল সেনগুপ্ত, ওস্তাদ মন্তাজ উদ্দিন আহমেদ, মোঃ আক্কাস, রাধা গোবিন্দ দুলাল, বাদল রায় চৌধুরী, দিলীপ দত্ত সহ অনেকে মিলে সেদিন স্বাধীনতার সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য ও দেশমাতৃকার গানে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতে সঙ্গীত নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। বক্তব্যে তিনি চাঁদপুরের প্রথম শহীদ কালাম-খালেক-সুশীল ও শংকরকে স্মরণ করেন। এদের সাথে ট্রাক রোডে বোমা বানাতে গিয়ে আহত আনোয়ার হোসেন ও দীজেন্দ্র লালকেও স্মরণ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সংগ্রহ করতে জহিরুল হক পাঠান, সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে খাবার লুট করে নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে রামপুর ও সোনাপুর থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। ফরিদগঞ্জের চরকুমিরা পাটওয়ারী বাড়ির সিরাজুল ইসলামের বাড়িতে এনে সেই টাকা রাখা হয় আমাদের দেয়ার জন্য। রাজাকাররা পাকিস্তানিদেরকে বাবা আসেন বলেন ফরিদগঞ্জে নিয়ে আসে। ফরিদগঞ্জের কাছে আমরা যুদ্ধের জন্য ২টি রাইফেল ও এলএমজি নিয়ে গুলিবর্ষন শুরু করি। সেটিও জহিরুল হক পাঠানের নেতৃত্বে করা হয়। আমরা গেরিলা যোদ্ধা। ভারত থেকে ৫টি এলএমজি, ২ হাজার গুলি আমাদেরকে দেওয়া হয়। আমরা অস্ত্র, খাদ্য ও গুলি পেয়ে যাই। সংগ্রাম কমিটির সাথে জহিরুল হক পাঠান আলোচনায় বসেন। তখন বলা হয় জহিরুল হক পাঠানের নেতৃত্বে যুদ্ধ করতে। আমরা ফরিদগঞ্জের খাজুরিয়া বাজারে শোডাউন করি কলিম উল্লাহর নেতৃত্বে। সেখানে সিংহ বাড়ির সামনে বসে রুটি কলা খাই। আমাদের কাছে খবর আসে পাকিস্তানিরা আমাদের উপর হামলার জন্য এগিয়ে আসে। আমরা তাদেরকে প্রতিহত করতে যুদ্ধ শুরু করি। ফরিদগঞ্জের রূপসা, আস্টা, গল্লাক, গাজীপুর সহ বেশ কয়েকটি গণপ্রতিরোধ যুদ্ধ আমরা করি। গ্রামবাসীরা কোস্ট টেটা নিয়ে আমাদের সাথে যুদ্ধে শরীক হয়। নরেনপুরের জনতারা প্রাক বাহিনীর অত্যাচারে বাড়িতে থাকতে পারেনি। আমাদের কাছে খবর আসার পর আমরা সেখানে যাই। গোপনে নরেনপুর গ্রামের জঙ্গলে বসে রান্না করে খাওয়া দাওয়া করেছি। এক দোকানীর ঘরের বেড়া কেটে তাকে জিম্মি করে সেখানে আশ্রয় নেই। পাকিস্তানিরা এখানে কোন পথে আসা যাওয়া করে তা রেকি করার জন্য। কয়েকদিন রেকি করার পর আমরা দেখলাম তারা একটি নির্দিষ্ট সময়ে নরেনপুর ক্যাম্পে খাওয়া দাওয়া করতে আসে। তারা সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ জন। নরেনপুর সেতুর সামনে আমরা বসে পড়লাম। সুবেদার আলী আকবর পাকিস্তানিদের দেখেই জয় বাংলা বলার সাথে সাথে আমরা ফায়ার শুরু করি। ২০/২৫ মিনিট যুদ্ধ করতে হলো। আমাদের গুলি শেষ। অজিত সাহা তখন আমাদের সাথে ছিল। তার পাশেই ছিল ভবই গ্রাম। সুবেদার আব্দুর রব একাধারে বোমা নিক্ষেপ শুরু করে।আমরা সেই ক্যাম্প থেকে কাঠের ও স্টিলের আলমিরা ভেঙ্গে ২৮ জোড়া বুট, ২৮ জোড়া পিটি সু, ৮টি ছাগল, ১০ বস্তা ময়দা, চিনি, তেল, ডালডা, স্বর্ণালংকার ও ১৬ জন তরুণীকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি। তারপর ডাঃ সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী ও শোরশাক গ্রামের পল্লী চিকিৎসক জয়নাল তাদের চিকিৎসা প্রদান করেন। জনতা রাগে ক্ষোভে নরেনপুর ক্যাম্পটি অগ্নিসংযোগ করে। বাঙালি জাতির ছিল বীরের জাতি। নরেনপুর ক্যাম্প আমরা আগুনে ফুড়িয়ে দেই। উঘারিয়া বাজার খালপাড়ে গৌড় লেড়িহর ড. সুলতানের বাড়ির পাশে কমান্ডার সুবেদার আলী আকবর পাটওয়ারীর বাড়ির সামনে ৭ থেকে ৮ জন পাকিস্তানিকে গুলি করে খতম করি। ১৯৭১ এর ১৬ জুলাই সকাল ৭টায় খাজুরিয়া বাজার গণপ্রতিরোধ যুদ্ধে আমরা দুই ভাগে যুদ্ধ করি। একটি গ্রুপ ডলটা বাজার ও নরেনপুর ক্যামেপর কাছে বাঁশ ঝাড়ের ভেতর যুদ্ধ হয়েছে। ৩শ পাকিস্তানি ভাগ হয়ে বেশ কয়েকটি গ্রাম ফুড়িয়ে দেয়। বেশ কয়েকজন নারীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে। কয়েকশত মানুষকে তারা আহত করে। আমরা এই মাটিতে স্বাধীন করেছি। এই পবিত্র মাটি রক্ষা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন বিএলএফ বাহিনী চাঁদপুর মহাকুমারের কমান্ডার ছিলেন আব্দুল মমিন খান মাখন। তার নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধ করেছি। পরবর্তীতে কমান্ডার ছিলেন রবিউল আউয়াল কিরন। আর ডেপুটি লিডার ছিলেন হাজীগঞ্জের খোরশেদ আলম বাচ্চু। পরবর্তীতে বিএলএফ এ বাহিনীটি ২টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। চাঁদপুর উত্তরাঞ্চলের কমান্ডার ছিলেন জহির উদ্দিন বাবর ও দক্ষিন অঞ্চলের কমান্ডার ছিলেন আব্দুল মমিন খান মাখন। চাঁদপুর থানার প্রথম কমান্ডার ছিলেণ শহীদ জাবেদ ও সৈয়দ আবেদ মুনসুর। হাজীগঞ্জ থানার বিএলএফ কমান্ডার ছিলেন মোঃ খাতেম আলী, ফরিদগঞ্জের বিএলএফ ছিলেন মোঃ হানিফ পাটওয়ারী, কচুয়া থানার কমান্ডার ছিলেন এ.এস.এম সানু, পরবর্তীতে ওয়াহিদুর রহমান দায়িত্ব পালন করেন। মতলব থানার কমান্ডার ছিলেন এম.এ খালেক। মহান মুক্তিযুদ্ধদ্ধের সময় বিএলএফ বাহিনীর অবদান জাতি চিরদিন স্মরণ রাখবে। রণাঙ্গনে এফএফ বাহিনীর বৃহত্তর কুমিল্লার কমান্ডার ছিলেন খালেকুজ্জামান ভূইয়া ও সহকারি ছিলেন আব্দুল আজিজ। চাঁদপুর মহকুমা ছিলেণ খান মোঃ বেলায়েত হোসেন। এফএফ বাহিনীর অবদান জাতি চিরদিন স্মরণে রাখবে। চাঁদপুরে নৌ কমান্ডদের অবদানও কম নয়। নৌ কমান্ড শাহজাহান কবির বীর প্রতীকের নেতৃত্বে পাকিস্তানি নৌ যুদ্ধ জাহাজ নদীতে ধ্বংস করা হয়। মেজর অব. রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, ১নং সেক্টর কমান্ডার ও লে. কর্নেল অব. আবু ওসমান চৌধুরী ৮নং সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালণ করেন। এরা ২ জনই চাঁদপুরের কৃতি সন্তান। এদের অবদানও কোন অংশে কম নয়। বেঙ্গল প্লাটুনের দায়িথ্ব পালন করেন ইসমাইল হোসেন বেঙ্গল।
বিজয় মেলার চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মহসীন পাঠানের সভাপতিত্বে ও স্মৃতিচারণ পরিষদের সদস্য সচিব মুক্তিযোদ্ধা সানা উল্লাহ খানের পরিচালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাশেম।
শিরোনাম:
শনিবার , ১২ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ , ২৭ আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।