গ্রাহকের অর্থ ফেরতের বিষয়টি সমাধানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ
যুবকের কাছে ২০ কোটি টাকা পাওনা চাঁদপুরের গ্রাহকরা ॥ সম্পত্তি নিয়ে হরিলুট
৭ বছর অতিক্রম হলেও অর্থ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নেই
স্টাফ রিপোর্টার:
॥ ১৯৯৬ সালে বাণিজ্যে মন্ত্রনালয়ের অনুমোদন নিয়ে শুরু হয় যুবকের পথচলা। সেই পথচলা থেকে সারা দেশের ন্যায় চাঁদপুরে সাধারন গ্রাহকের মাঝে ২০০০ সালে পরিচিতি লাভ করে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (যুবক)। পরিচিতি পর্বের পর থেকে তূলনামূলক বেশি লাভ প্রদানের আশ্বাষে সে সময়ের সকল সমিতিকে পিছনে ফেলে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলে যুবক। আত্মপ্রকাশের প্রথম দিকে চাঁদপুরে সাধারন গ্রাহক ৬ হাজার টাকায় ১ হাজার টাকা লাভ পায়। এরপর ৭ হাজার টাকায় ২ হাজার টাকা লাভ প্রদান শুরু করে যুবক। এতে করে সারা দেশের ন্যায় চাঁদপুরের শত শত সাধারন গ্রাহক তাদের কষ্টার্জিত অর্থ অধিক লাভের প্রত্যাশায় যুবকে বিণিয়োগ করতে থাকে। জেলা যুবকের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুত্র থেকে জানাযায়, চাঁদপুর জেলায় যুবকের কার্যালয় ছিলো শহরের গুনরাজদি রোড এলাকায়। কার্যালয় অফিসে প্রধান সমন্ময়কারীর দয়িত্বে ছিলো ফজলুল হক প্রধান, সচীব হাসানুল বান্না, এরিয়া ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বে ছিলো রাজিব পোদ্দার, সোলায়মান খান, হারুনুর রশিদ ও ইয়াছিন খান রিপন। যুবক কার্যালয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও মাঠ কর্মীদের উপর বিশ্বাষ করে জেলার হাজার গ্রাহক তাদের অধিক লাভের প্রত্যাশায় লক্ষ লক্ষ টাকা যুবকে বিণিয়োগ করতে থাকে। পূর্নাঙ্গ যৌবন লাভ করে যুবক। এরপর ২০০৬ সালে যুবককে অবৈধ ব্যাংকিং বিষয়ক কারন দর্শানোর নোটিশ প্রদান করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই সাথে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা লেখি শুরু হয় যুবক নিয়ে। এরপর ৩১ ডিসেম্বর সকল গ্রাহকের আমানত ফেরত দেওয়ার জন্য নোটিশ প্রদান করে । যুবক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ৩১ মার্চ ২০০৭ পর্যন্ত ৩ মাস সময় চেয়ে নেয়। পরবর্তিতে কয়েকধাপে এ সময় বাড়ানো হয়। কিন্তু গ্রাহকের অর্থের সুরাহা হয়না। একপর্যায়ে গ্রাহকরা অনেকটা হতাশ হয়ে পড়ে। সারাদেশের অনেক জেলার ন্যায় চাঁদপুরের যুবক গ্রাহকরা তাদের বিণিয়োগের অর্থ উত্তোলনের জন্য অফিস ও কর্মকর্তাদের দ্বারস্ত হতে থাকে। আটকে যায় যুবক গ্রাহকদের অর্থ। সে সময় চট্রগ্রামে যুবক লেনদেন স্বাভাবিক থাকায় চাঁদপুরের অফিস ব্যবস্থপনার দায়িত্বরত কর্মকর্তারা চট্রগ্রাম থেকে কিছু অর্থ ট্রান্সফার করে আনে। এ অর্থ আনার বরাত দিয়ে অসাধু কর্মকর্তারা সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সাধারন গ্রাহকের সাথে শুরু করে প্রতারণা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গ্রাহকদের জানায় যদি কেউ তাদের টাকা নিতে চায় তাহলে মূল অর্থ বিণিয়োগের দলিলের বিণিময়ে শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ টাকা পাবে। সাধারন অনেক গ্রাহক তাতেই রাজি হয়ে শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ অর্থ নিয়ে চিরতরে যুবক থেকে সরে দাঁড়ায়। যেসব কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ১০ থেকে ১৫ ভাগ শতকরা হিসাবে টাকা নেয়। খোঁজ নিয়ে জানাযায় সেসব অসাধূ কর্মকর্তারা চট্রগ্রাম থেকে গ্রাহকের মূল দলিলের প্রকৃত অর্থ পুরোটাই পেয়েছেন। এভাবে শকতরা হিসেবে চাঁদপুরের সাধারন যুবক গ্রাহকদের কোটিকোটি টাকা প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। সুত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে যুবকের কাছে চাঁদপুরের গ্রাহকদের পাওনা ছিলো প্রায় ২০ কোটি টাকা। চাঁদপুরের সাধারন অনেক গ্রাহক এ চক্রের ফাঁদে পা না দিয়ে তারা তাদের লেনদেনের দলিল নিয়ে আজ পর্যন্ত কোম্পানির দিকে তাকিয়ে আছে। যুবক সংশ্লিষ্ট চাঁদপুরের প্রতারক চক্রটি সাধারন গ্রাহককে জমি না দিয়ে তারা তাদের নিজেদের আত্মিয় স্বজনদের নামে বেনামে জমি রেজিষ্ট্রেশন করে নেয়। এমনকি গুনরাজদিতে ৩০ শতাংশ জমির উপর যুবকের যে কার্যালয়টি ছিলো সে জমি সাধারন গ্রাহকদের দেওয়ার কথা থাকলেও পরবর্তিতে তা ঐ চক্রটি নানা অযুহাতে নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। বলতে গেলে যুবকের দু:সময়ে যুবকের সম্পত্তি নিয়ে চলতে থাকে হরিলুট।
যুবকে কর্মরত একজন কর্মী মো: ছালাউদ্দিন মিয়ার সাথে আলাপকালে তিনি জানান, তিনি ২০০৬ সালে শেষ দিকে যুবকে যোগদান করেন। তিনি প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা পাবেন যুবক থেকে। তার মাধ্যমে যেযব গ্রাহকরা টাকা বিণিয়োগ করেছে সেসব গ্রাহকদের কাছে তিনি বেশ কয়েকবার লাঞ্চিত হয়েছেন। শুধু তাই নয় তিনি আর্থিক, সামাজিক, পারিবারিক ও রষ্ট্রিয়ভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছেন। তবে তিনি এখনো আশাবাদি তার বিণিয়োগের টাকা ফেরত পাবেন। তার কাছে অর্থ বিণিয়োগের সম্পূর্ন দলীলপত্র রয়েছে।
কথা হয় যুবকে কর্মরত গ্রুপ ইনচার্জ তাফাজ্জল ইসলামের সাথে তিনি জানান, তার অধিনে ১০ জন বিণিয়োগকারী ছিলো। তিনি প্রায় দেড় কোটি টাকা বিণিয়োগ করেছেন। এ টাকার জন্য তিনি সামাজিকভাবে অনেক হেয়প্রতিপন্ন হয়েছেন। এখনো আশাবাদি তিনি তার বিণিয়োগের টাকা ফেরত পাবেন। তিনি আরো জানান তার কাছে টাকা বিণিয়োগের সম্পূর্ন দলীলপত্র রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) সম্পত্তি কেনাবেচা হচ্ছে। অবৈধ ব্যাংকিংয়ের দায়ে বন্ধ এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন। কিছু ক্ষেত্রে যুবকের গ্রাহকরা তাদের পাওনার সঙ্গে সমন্বয় করে জমি কিনছেন। কিছু ক্ষেত্রে অন্যের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। এ ছাড়া অনেক সম্পত্তি দখল হয়ে গেছে। এভাবে সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় গ্রাহকদের অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কেননা, যুবকের সম্পত্তি বিক্রি করে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়ার কথা।
গত বছর যুবক পরিবারের দায়মুক্তির লক্ষ্যে উত্তরণ কার্যক্রম হিসেবে গ্রাহকের উদ্দেশে একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। যুবক স্যাটেলাইট প্রকল্পের প্রধান নির্বাহী সৈয়দ রাশেদুল হুদা চৌধুরী স্বাক্ষরিত এই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দুই হাজার ৯১টি প্লটে জমি বিক্রির রেজিস্ট্রেশন শেষ হয়েছে। এসব জমি প্রতি শতক ৪০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। এদিকে, গত বছর ঈদুল আজহার বিশেষ অফার দিয়ে জমি বিক্রি করেন যুবক-সংশ্লিষ্টরা। গ্রাহকদের মধ্যে বিতরণ করা লিফলেটে বলা হয়, ঈদ অফারে নগদ প্লট ক্রয়ে শতকপ্রতি ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা ছাড় দেওয়া হবে। যুবক গ্রাহকদের চুক্তি দলিল সমন্বয়ে শতকপ্রতি ৬০ হাজার টাকা ছাড় দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, যুবকের বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এতে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে বিশেষ আদালত গঠনের ও প্রশাসক নিয়োগের সুপারিশ রয়েছে। এ বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া যাচাই-বাছাই করতে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আইন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে বলা হয়, যুবকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও দেওয়ানি দায় সুরক্ষায় প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। সুপারিশ বাস্তবায়নে করণীয় জানতে চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় গ্রাহকের অর্থ ফেরতের বিষয়টি সমাধানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যুবকের বিষয়ে খুব শিগগির একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, যুবকের গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি প্রশাসক নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় একই সুপারিশ করেছে। এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। কমিশনের প্রতিবেদনে যা ছিল :২০১৩ সালে যুবক কমিশনের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুবকের কাছে তিন লাখ তিন হাজার ৭৩৯ জন গ্রাহকের পাওনা অর্থের পরিমাণ দুই হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। দেশের ৪৯টি তফসিলি ব্যাংকে যুবকের বিভিন্ন হিসাবে অর্থ রয়েছে মাত্র ৭৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। সারাদেশে যুবকের নামে মোট জমির পরিমাণ ৬২ হাজার ৩৫০ শতাংশ। ৩১টি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ছিল যুবকের। জমি ও বাড়িসহ অন্যান্য সম্পদ প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে বিক্রি করে গ্রাহকদের বিনিয়োগ করা আসল টাকা পরিশোধের সুপারিশ করেছিল কমিশন। প্রশাসক নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত এসব সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার আওতায় নেওয়ার সুপারিশ করে কমিশন। তবে সর্বোপরি যুবক গ্রাহকরা জানায় তারা তাদের অর্থ ফিরত পেতে আশায় বুক বেঁেধ আছেন। তাদের কষ্টার্জিত অর্থ প্রশাসনের সহায়তায় তারা অবশ্যই ফেরত পাবেন বলে বিশ্বাষ করেন অধিকাংশ গ্রাহক।