মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী রায়ের খসড়া ফাঁস হওয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক কর্মচারীকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ।
গ্রেফতারকৃত কর্মচারীর নাম নয়ন আলী। নয়ন আলী ট্রাইব্যুনালের মাস্টারোলে নিয়োগপ্রাপ্ত ঝাড়ুদার। আর রায় ফাঁসের কাজে ফারুক নামে আরও এক কর্মচারী জড়িত এবং তাকেও গ্রেফতারের চেষ্টা করা হচ্ছে।
শুক্রবার বিকেলে মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে এক প্রেসব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম।
তিনি জানান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায়ের খসড়া ফাঁসের ঘটনায় শুক্রবার তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৭ ও ৬৩ ধারায় শাহবাগ থানায় তিনজনকে আসামি করে মামলা করে পুলিশ। ওই তিনজনের মধ্যে বৃহস্পতিবার নয়ন আলীকে গ্রেফতার করা হয়। অপরদুই জন বর্তমানে পলাতক রয়েছে বলে জানা গেছে।
এদের মধ্যে একজন ট্রাইব্যুনালের কর্মচারী ফারুক অপরজন সালাউদ্দিন কাদেরের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলামের সহকারী মেহেদী।
গত মঙ্গলবার সালাউদ্দিন কাদেরের ফাঁসির রায় দেন ট্র্রাইব্যুনাল-১। রায় ঘোষণার আগেই রায়ের খসড়া ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠে। পরদিন বুধবার দুপুরে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে রেজিস্ট্রার এ কে এম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ রায়ের খসড়া কপি ফাঁসের কথা স্বীকার করেন।
এরপর পরই তদন্তে নামে গোয়েন্দাদের একাধিক টিম। প্রাণপ্রণ চেষ্টার পর অবশেষে গ্রেফতার করা হয় নয়ন মিয়াকে।
জানা গেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় যে কম্পিউটারে লেখা হয়েছে সেখান থেকেই পেনড্রাইভে করে তা নিয়ে গেছেন ট্রাইব্যুনালের কর্মচারী আটক হওয়া নয়ন মিয়া। পুলিশ জানিয়েছে, টাকার লোভেই সে এই কাজ করেছে।
ট্রাইব্যুনালে মাস্টাররোলে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর চাকরি নিয়েছিলেন নয়ন মিয়া। চাকরির সুবাদে ট্রাইব্যুনালের প্রায় সব কক্ষেই যেতে পারতেন তিনি। রায় লেখার কম্পিউটারও ধরতে পারতেন তিনি।
রায় ফাঁস হওয়ার পর এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের সাধারণ ডায়েরির সূত্র ধরে কম্পিউটারটি গত বৃহস্পতিবার জব্দ করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পুলিশ দেখতে পায় এটাতে ব্লুটুথে ফাইল আদান-প্রদানের কোন সুযোগ নেই। এরপর পুলিশ ধারণা করে পেনড্রাইভে করেই হয়তো ফাইল নেয়া হয়েছে।
এরপর ওই কক্ষের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে পুলিশ দেখতে পায় নয়ন মিয়া একটি পেনড্রাইভে করে কম্পিউটার থেকে কিছু একটা নিয়েছে। এরপরই নয়ন মিয়াকে আটক করে পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, নয়নের সাথে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ফখরুল ইসলামের সহকারী মেহেদী হাসানের যোগাযোগ ছিল। মেহেদী হাসান তার কাছে কিছু নথিপত্রের জন্যে আসলে তা ঐ পেনড্রাইভে করেই দেন নয়ন। পেনড্রাইভ খুলে মেহেদী হাসান রায়ের অংশবিশেষ দেখতে পান। এরপর তিনি তা নয়নের কাছ থেকে নিয়ে যান।
এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এমএস ওয়ার্ড ফাইলটি নিয়ে প্রথমে পিডিএফ ফরম্যাটে কনভার্ট করা হয়। এরপর ফাইলটি ইমেইল বা অন্য কোন উপায়ে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। সেখান থেকেই একটি অনলাইনে রায়টি প্রকাশ করা হয়।
মনিরুল ইসলাম জানান, নয়ন এই কাজে মোটা অংকের টাকা পেয়েছেন মেহেদী হাসানের কাছ থেকে। আরও বিস্তারিত জানতে শনিবার তাকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করবেন তারা।
নয়নের সাথে ট্রাইব্যুনালের স্থায়ী কর্মচারী ফারুকেরও যোগসাজস ছিল বলেও জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম। এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জেনে জানানো হবে বলেছেন তিনি।
নয়ন, ফারুক এবং মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে।
অপরাধ প্রমাণ হলে আসামিদের সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সশ্রম কারাদ- হতে পারে বলে জানিয়েছেন মনিরুল ইসলাম।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মঙ্গলবার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ফাঁসি দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিএনপি নেতার পরিবার ও আইনজীবীর অভিযোগ, যে রায়টি ফাঁস হয়েছে সেটা আইন মন্ত্রণালয়ের ছয়তলায় ভারপ্রাপ্ত সচিবের কক্ষে একটি কম্পিউটারে লেখা হয়েছে। আলম নামে একজন ঐ কম্পিউটার চালাতেন।
তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, আইন মন্ত্রণালয়ের আলম নামে কোন কর্মচারী নেই।
এদিকে, গতকাল শুক্রবার দুপুর আড়াইটার দিকে সালাউদ্দিন কাদেরের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলামের কাকরাইল অফিসে অভিযান চালিয়ে দুইটি সিপিইউ ও কিছু সিডি জব্দ করে ডিবি পুলিশ।
বিকেলে রাজধানীর কাকরাইলে চারতলা বাসার দ্বিতীয় তলায় অভিযান চালায় ডিবি। এসময় ব্যারিস্টার ফখরুল অফিসে ছিলেন না। তবে অফিস থেকে দুইজনকে আটক এবং দু’টি সিপিইউ, একটি প্রিন্টারসহ কয়েকটি সিডি জব্দ করা হয়।
গত ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সাকা চৌধুরীর ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন। সাকার পরিবার অভিযোগ করে, এই রায় আইন মন্ত্রণালয় থেকে আগেই ফাঁস করা হয়েছে।
পরে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার জানান, রায়ের কিছু অংশ ঘোষণার আগেই ফাঁস হয়ে গেছে। এ বিষয়ে শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।
ref.tazakhabar