আলম শামস :
বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। ১৯৭৩ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পিএইচ.ডি প্রদান করে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক মনোনীত করে। এ থেকেই তাঁর অসীম প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত ছিল বিশেষত প্রাশ্চ্যতত্ত্ব, ইতিহাস ও রাজনীতিতে। তিনি `শিক্ষকদের শিক্ষক` হিসেবে অভিহিত হতেন। তাঁর অনুগামীদের মধ্যে শুধু বুদ্ধিজীবী নয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক রাজনৈতিক নেতাও ছিলেন।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ১৯১৪ সালে ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার পারাগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আব্দুল আলি পুলিশ অফিসার ছিলেন। তিনি ঢাকার মুসলিম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর তিনি ১৯৩১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৩৬ সালে সেখান থেকেই প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হন। ওই বছই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে এ বিভাগ থেকে অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান দুটি পৃথক বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক অল্প কিছু প্রবন্ধ ছাড়া অধিক কিছু রচনা না করলেও অসাধারণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কারণে কিংবদন্তির খ্যাতি অর্জন করেন। আহমদ ছফা তাঁকে নিয়ে ‘যদ্যপি আমার গুরু’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। মনীষী সরদার ফজলুল করিমও এই জ্ঞান তাপসকে নিয়ে তাঁর সাথে আলাপচারিতার ওপর একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন।
জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের ব্যক্তি জীবন ছিল খুবই সাদাসিধে। তিনি ছিলেন চিরকুমার। খুব বেশি বই পড়তেন। কিছু জানার উদ্দেশ্যে তাঁর কাছে এলে তিনি ভীষণ উজ্জীবিত বোধ করতেন। তবে তার লেখার অভ্যেস তেমন ছিল না। তাঁর আগ্রহ এবং পান্ডিত্য ছিল প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস এবং রাজনীতি। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস কী ছিল?
এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান লিখেছেন :
The “pernicious” influence of his political ideas on the dissenting politicians of the 1960s once led the Ayub regime to dismiss him from his teaching position at Dhaka University on the allegation that he was not mindful of his duties as a teacher, but which the government failed to establish in the court. His “treasonable” acts during the War of Liberation earned him in absentia a fourteen-year rigorous imprisonment. (বাংলাপিডিয়া)
জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেন : ‘‘অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে যাঁরাই এসেছেন তারা প্রত্যেকেই অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে বলেছেন- শিক্ষকের শিক্ষক। এই একটি মাত্র উক্তিতে আমরা বুঝতে পারি অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক-এর মননশীলতার গভীরতার পরিমান। যা তা লোক তাঁর পাশে ভিড় করেননি। তাঁর অনুগামীদের মধ্যে যেমন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মতন প্রাজ্ঞ নেতা, তেমনি আহমদ ছফার মতন প্রাজ্ঞ লেখক। আহমদ ছফা তো বটেই- সলিমুল্লাহ খান, অধ্যাপক আহমেদ কামাল প্রমূখ- রাজ্জাক ঘরানার স্বার্থক উত্তরসূরী।’
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের জ্ঞানের আলোয় আলোকময় হয়েছেন অল্পসংখ্যক মানুষ। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা, তাঁর সান্নিধ্যে যারা এসেছেন, তারা। অথচ আবদুর রাজ্জাক বই লিখেননি বলে বাঙালি জাতির বৃহত্তর অংশ জানতেই পেল না তার ভাবনা। আবদুর রাজ্জাক এক মৌন পাহাড়, যে পাহাড়ের সোনার খনির সন্ধান অল্প সংখ্যক অভিযাত্রীই জানেন। গভীর জ্ঞানের আলোয় আলোকময় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ১৯৯৯ সালের ২৮ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। আজ তার মৃত্যুদিনে তাঁকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক।