শিক্ষাবর্ষের ১৯ দিন পার হয়েছে। কিন্তু এখনো ৩ কোটি বই মুদ্রণই হয়নি। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের বই সোয়া ২ কোটি এবং প্রাক-প্রাথমিক স্তরের ১ লাখ ১০ হাজার।
অবশিষ্ট প্রাথমিক বই স্তরের। সবচেয়ে বেশি সংকট তৈরি হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমের বই নিয়ে। প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই সারা দেশে খুবই কম গেছে। প্রথম শ্রেণির সঙ্গে এবার দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়েরও দরপত্র দেওয়া হয়। এজন্য এই শ্রেণির বইও মুদ্রণ বাকি আছে।
শিক্ষক ও অভিভাবকরা জানান, এ অবস্থায় এখন বইয়ের জন্য হাহাকার চলছে। আর এই সুযোগে একশ্রেণির ব্যবসায়ী বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিক্রির মহোৎসবে মেতে উঠেছেন। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থান থেকে ইতোমধ্যে বিনামূল্যের বই বিক্রি ও পাচারের অভিযোগ এসেছে।
আর রাজধানীর বাংলাবাজারে পোস্ট অফিসের সামনে ফুটপাত, নীলক্ষেত, মিরপুর-১০ নম্বর গোলচক্কর এলাকা; মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ এবং ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের সামনের লাইব্রেরিসহ বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে গড়ে ওঠা লাইব্রেরিতে চড়া দামে বই বিক্রি হচ্ছে।
অবশ্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম অবশ্য দাবি করেন, ‘অধিকাংশ পাঠ্যবই চলে গেছে। সামান্য কিছু বই যায়নি। সেগুলোর মুদ্রণ কাজ চলছে। জানুয়ারির মধ্যেই সব বই সরবরাহ করা সম্ভব হবে।’
যদিও এনসিটিবিরই আরেকটি সূত্র জানায়, গত রোববার পর্যন্ত প্রাথমিকে ৮ কোটি ২০ লাখ আর মাধ্যমিকে ২১ কোটি বই সরবরাহ করা হয়েছে। এবার সরকার সারা দেশে প্রায় ৩৩ কোটি ৯০ লাখ পাঠ্যবই বিতরণের জন্য মুদ্রণ করছে।
এর মধ্যে প্রাথমিকে ৯ কোটি ৬৬ লাখ ৮ হাজার ২৪৫টি এবং মাধ্যমিকে ২৩ কোটি ৮৩ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৮টি। এই হিসাব অনুযায়ী, মুদ্রণ-অবশিষ্ট সোয়া ৪ কোটির মধ্যে গত ৫ দিনে সর্বোচ্চ ১ কোটি বই সরবরাহ করা হতে পারে।
মুদ্রণ সংশ্লিষ্টরা জানান, পাঠ্যবই সরবরাহে মধ্য ফেব্রুয়ারি লেগে যেতে পারে। এজন্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা অতিরিক্ত এক থেকে দুই মাস সময় চেয়েছে। এর মূল কারণ কাগজ সংকট। তবে এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানান, দু-একটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান নোট-গাইড ছাপানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এজন্য বই সরবরাহে বিলম্ব করছে তারা।
ওইসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ‘ব’ আদ্যাক্ষরের একটি প্রতিষ্ঠানের মূল প্রতিষ্ঠান হাজার কোটি টাকার গাইড ব্যবসায় জড়িত। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রকাশনী যাতে বাজার দখলে নিতে না পারে, সেজন্য তারা সরকারি বইয়ের মুদ্রণ বন্ধ রেখে গাইড ছাপাচ্ছিল।
এমন অভিযোগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদ্য সাবেক সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের তিরস্কারও করেছেন বলে জানা গেছে। এরপর প্রতিষ্ঠানটি পাঠ্যবই মুদ্রণে সক্রিয় হলেও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তরেরই ৫৮ লাখ বই সরবরাহ বাকি রেখেছে।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে যুগান্তরকে বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান নোট-গাইডের ব্যবসা করে, তাদের পাঠ্যবইয়ের কাজ না দিলেই ভালো হতো। কেননা বই বিলম্বে দিলে তাদের দুটি লাভ। প্রথমত, বাজারে পাঠ্যবইয়ের সংকট হলে নোট-গাইড বিক্রি বেড়ে যায়।
পাশাপাশি তারা তাদের চ্যানেলে বিভিন্ন লাইব্রেরিতে সরবরাহ করে বিনামূল্যের বই টাকায় বিক্রি করতে পারে। আরেকটি দিক হচ্ছে, বাজার ধরতে তারা বিনামূল্যের বই ছাপানো বন্ধ করে নোট-গাইড ছাপিয়েছে। না হলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রকাশকরা বাজার ধরে ফেলবে। এছাড়া নতুন সিলেবাসের বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিয়ে তারা যে নোট-গাইড তৈরি করেনি সেই নিশ্চয়তাই বা কে দেবে।
জানা যায়, এবার মাধ্যমিকের বই মোট দুটি দরপত্রের মাধ্যমে ছাপানো হচ্ছে। এর মধ্যে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই ১৮০ লট আর অষ্টম-নবম শ্রেণির বই ২৮০ লট হিসাবে পরিচিত। মাধ্যমিকের যে ৩০ শতাংশ বা সোয়া ২ কোটি বই সরবরাহ বাকি আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আটকে আছে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির। মানিকগঞ্জের এসআর নামে একটি প্রতিষ্ঠান ২ লাখ ৭৩ হাজার ৬৩২টি বই ছাপানোর কাজ পায়। কিন্তু বৃহস্পতিবার পর্যন্ত একটিও ছাপায়নি।
এই স্তরে সবচেয়ে বেশি বই আটকে রেখেছে অ্যাপেক্স প্রিন্টিং। প্রতিষ্ঠানটি ৩৪ লাখ ৬৪ হাজার ৬৭৭টি বই ছাপানোর কাজ পায়। এখনো ৪৯ দশমিক ৩০ শতাংশ বা ১৭ লাখ ৭ হাজার ৯৪১টি বই সরবরাহ করেনি। দ্বিতীয় স্থানে আছে অনুপম। তাদের কাছে ১২ লাখ বই আটকে আছে। শাপলা নামে একটি প্রতিষ্ঠান ৬ লাখ ২৩০টি বইয়ের কাজ নিয়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রায় ৪৯ শতাংশ বা ২ লাখ ৯১ হাজার ৭৫৯টি বই ছাপায়নি।
এভাবে ভাই ভাই নামের প্রতিষ্ঠানের কাছে ১১ লাখ ৩০ হাজার, মানামার কাছে ১১ লাখ ২১ হাজার, মাস্টার সিমেক্সের কাছে ৬ লাখ ৬৯ হাজার বই আটকে আছে। সরকারি প্রিন্টিং সাড়ে ৪৪ লাখ বইয়ের কাজ নিয়েছে। এখনো ৬ লাখের বেশি বই তারা দেয়নি। এই প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রাক-প্রাথমিকেরও ১ লাখ ১০ হাজার বই আটকা আছে। এই স্তরের বই মোট ১৬ জনের কাছে আটকে আছে বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে ২৮০ লটের দরপত্রের বই আটকে রেখেছে ১১টি প্রতিষ্ঠান। সংখ্যার বিচারে সবচেয়ে বেশি বইয়ের কাজ পেয়েছে বারোতোপা নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তারা ১ কোটি ৬৬ লাখ ৭৫ হাজার ৪১০টি বইয়ের কাজ পায়। প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত ৩৪ শতাংশ ৫৭ লাখ ৮৭ হাজার ১৪টি বই ছাপাতেই পারেনি। বর্ণশোভা কাজ পায় প্রায় সাড়ে ৩৪ লাখ বইয়ের
। তারা এখনো ৬ লাখের বেশি সরবরাহ করেনি। ভয়েজার নামে একটি প্রতিষ্ঠান অনুপাতের বিচারে ৫২ শতাংশ বই সরবরাহ করতে পারেনি। এই প্রতিষ্ঠানটি মোট ২৪ লাখ ২৮ হাজার ১০৬টি বইয়ের কাজ নিয়েছে। কিন্তু এখনো ১২ লাখ ৭৪ হাজার ৫৫টি বই ছাপায়নি। আনন্দ প্রিন্টার্স দুইবারে ৪৫ লাখের বেশি বইয়ের কাজ নেয়। কিন্তু এখনো প্রায় ১৪ লাখ বই সরবরাহ করেনি। সবমিলে প্রাথমিকের অন্তত ৮০ লাখ বই সরবরাহ করার কাজ বাকি আছে বলে জানা গেছে।
অতিরিক্ত সময় দাবি : এনসিটিবি সূত্র জানায়, উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বই সরবরাহের শেষ তারিখ ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে। নিয়ম অনুযায়ী এখন জরিমানাসহ ২৮ দিনের মধ্যে বই সরবরাহ করতে পারবে। কিন্তু জরিমানা থেকে বাঁচতে প্রতিষ্ঠানগুলো ১ থেকে ২ মাস বাড়তি সময় চেয়েছে।
ওইসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে-বারোতোপা, ভয়েজার, দশদিশা, এসআর, প্রমাসহ অন্তত ২৪ প্রতিষ্ঠান। এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান যুগান্তরকে বলেন, সময় যে যাই দাবি করুক না কেন, সবাইকে এ মাসের মধ্যে বই দিতে হবে। পাশাপাশি যারা দেরি করে বই দিচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে আইনানুগ ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।