শিল্পী মমতাজ বেগম। এক দরিদ্র বাউল পরিবারে জন্ম। শৈশব-কৈশোর-যৌবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে চরম অভাব আর দৈন্যতায়। বাবা মধু বয়াতির ছিল ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। ঘরহীন, সংসারহীন বাউল বাবার হাত ধরেই শিল্পী মমতাজের গানের ভুবনে পথ চলা। গানকে সঙ্গী করেই জীবনের সমস্ত ক্ষুধা নিবারণের এক জীবন্ত উদাহরণ কিংবদন্তি মমতাজ। কোনো বাধা-প্রতিবন্ধকতাই দমিয়ে রাখতে পারেনি গানপাগল মমতাজের স্বপ্নকে। গান দিয়েই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তিনি। হাজারো দুঃখের মাঝে গান গেয়েই আনন্দ খুঁজে পান। গানেই প্রেম-ভালোবাস, গানেই বিরহ অনুভূত করে চলছেন। ফলে সংসার জীবনের অস্থিরতা থাকলেও তা সঙ্গীত জীবনের কোনো ছন্দপতন ঘটাতে পারেনি। বরং নিজের সুর আর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যতায় জনমানুষের আজ অতি কাছের মমতাজ। পালাগানে শুরু হলেও বিচ্ছেদ আর মুর্শিদী গানে প্রতিষ্ঠা পাওয়া। কেবল দেশেই নয়, দেশের বাইরেও মেলে ধরেছেন তার এই অসাধারণ প্রতিভা। আবার সঙ্গীত জীবনের বিশালতায় ঠাঁই দিয়েছেন রাজনীতি আর সামাজিক কর্মকাণ্ডকেও। ধলেশ্বরী পাড়ের সেই পালাগান শিল্পী মমতাজ আজ সংসদ সদস্যও। সঙ্গীত জীবন, রাজনীতি, সামাজিক ভাবনা, জীবনের অর্জন-বিসর্জন নিয়ে সাপ্তাহিক-এর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন সায়েম সাবু।
চাঁদপুর নিউজ-এর পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি সাপ্তাহিক-এর সৌজন্যে হুবহু তুলে ধরা হলো-
সাপ্তাহিক : শৈশব দিয়েই শুরু করা যাক।
মমতাজ বেগম : ঢাকার শ্যামলীতে ১৯৭৬ সালে এক বাউল পরিবারে আমার জন্ম হয়। বাবা বিখ্যাত বাউল শিল্পী মধু বয়াতী। মা উজালা বেগম। বাবা মাকে নিয়ে তখন ঢাকায় থাকতেন। তবে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার জয়মণ্ডপ ইউনিয়নের ভাকুম নামক গ্রামই আমার আসল ঠিকানা। আমি আমার জন্ম পরিচয় বলতে গেলে এ গ্রামের নামই বলে থাকি। কারণ শিশুকালেই বাবা-মার সঙ্গে গ্রামে চলে যাই। ওই গ্রামের ধূলিবালিতেই আমার বেড়ে ওঠা।
সাপ্তাহিক : কয় ভাইবোন আপনারা?
মমতাজ : আমার বাবার দুই পরিবার ছিল। আমার বড় মায়ের ঘরে এক ভাই ও তিন বোন। আর আমার মায়ের ঘরে আমি এবং আরও দুই ভাই রয়েছেন।
সাপ্তাহিক : দাদাকে দেখেছেন?
মমতাজ : না, আমার দাদা আলম ব্যাপারীকে দেখিনি। আমার জন্মের অনেক আগেই তিনি মারা যান। তবে দাদার ছোটভাই দেলন ব্যাপারী অল্প কিছুদিন আগে গত হয়েছেন। শত বছরের বেশি বয়স হয়েছিল তার। খুব কাছে থেকেই তাকে দেখেছি। তার মুখে বিশাল দাড়ি ছিল। দাড়িতে বড় বড় জটও ছিল। দাদা দেলন ব্যাপারীর চুল, দাড়ি আর পোশাকেই ফকিরি ভাব ফুটে উঠত। দেলন ব্যাপারীর পরিবর্তে লোকজন দেলন ফকির বলে ঢাকতেন দাদাকে। দাদা বৈঠকি গান করতেন। মূলত আমাদের পুরো পরিবারই ছিল বাউল পরিবার। আমার বাবারা তিন ভাই। দাদা দেলন ব্যাপারীর ঘরে চার ভাই। সবাই গান নিয়ে থাকতেন। কেউ গান গাইতেন, কেউ গান ভালোবাসতেন। বাড়িতেই গানের আসর বসত। সত্যি কথা বলতে কি, পরিবারের সবাই ছিলেন গানপাগলা মানুষ।
বাবার অন্য ভাইয়েরা গ্রামেই থাকতেন। আমাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠী নিয়েই ভাকুম গ্রাম। বাপ-দাদার বিষয়-সম্পত্তি অনেক ছিল। সময়ের ব্যবধানে জমি-জায়গা বিক্রি করে দেয়া হয়। গ্রামের পাশেই বিশাল এক জায়গা আমার বাবা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বাবা বেঁচে থাকতেই আমি সেই জমি ফের কিনে নিই।
সাপ্তাহিক : সে জমিতে কী করলেন?
মমতাজ : সেই জমিতে আপাতত আমার বাবা-মায়ের নামে ‘মধু-উজালা কোল্ডস্টোরেজ’ করেছি। তবে আরও পরিকল্পনা আছে।
সাপ্তাহিক : আপনার চাচাদের অবস্থা কেমন ছিল?
মমতাজ : আমার চাচারা বেশ ভালোই ছিলেন এবং এখনও ভালোই আছেন। তারা আগে থেকেই বেশ ধনী। কারণ, তারা গানের ভক্ত থাকলেও ঘরোয়াভাবেই গান করতেন। বাউল বেশে গ্রামের বাইরে গিয়ে গান করতেন না। এ কারণে সংসারে কোনো প্রভাব পড়েনি। কিন্তু আমার বাবা ছিলেন চাচাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তার জীবনে গান ছাড়া আর কিছু ছিল না। বাবা এমনই গানপাগল ছিলেন যে, এক মাস দুই মাস বাড়িতে আসতেন না। দিনের পর দিন বিভিন্ন ফকিরি বাড়িতে, মাজারে বাউল গান করে বেড়াতেন। সংসারের প্রতি কোনো টান ছিল না। বড় পরিবার ছিল আমাদের। বাউল গান করে তো এত বড় সংসার চালানো সম্ভব হতো না। আমি দেখেছি, বাউলের গান শুনে মানুষ আনন্দ পায়, দুঃখের মাঝে সুখ পেতে চায় কিন্তু বাউলের কোনো মূল্যায়ন করে না। এখনও তাই। বাউলরাও হয়ত মানুষকে আনন্দ দিয়েই সুখ পায়। এ কারণেই সংসার জীবন বাউলদের নয়। মানুষের আনন্দ-বেদনার মাঝেই বাউলের জীবন।
সাপ্তাহিক : বাবা ঘরছাড়া। এ সময় সংসার চলল কীভাবে?
মমতাজ : একপর্যায়ে বিষয়টি এমন দাঁড়ালো যে আমরা ক্রমেই বড় হচ্ছি, আর বাবা ঘরছাড়া হচ্ছেন। সংসারের কোনো চিন্তা করতেন না। দাদার রেখে যাওয়া সম্পত্তি একের পর এক বিক্রি করতে থাকলেন। দীর্ঘদিন বাবা বাড়িতে না থাকায় মা অন্যের কাছে ধারদেনা করে সংসার চালাতেন। চাচারা সহযোগিতা করতেন। এরপর বাবা বাড়িতে এসে দেখতেন, অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেছে। পরে ওই পাওনাদারের কাছে আরও কিছু টাকা নিয়ে জমি বিক্রি করতেন। এক সময় বাড়ির ভিটা এক চিলতে জায়গা ছাড়া কিছুই আর থাকল না। এরপর থেকেই অভাব ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। কারণ, তখন আর বিক্রির কিছুই ছিল না। তবে চাচাদের সংসার আগের মতোই ছিল।
সাপ্তাহিক : বাবার এই বাউল জীবন চাচারা কীভাবে দেখতেন?
মমতাজ : আমার বাবা ভালো গান করতেন। প্রথম দিকে চাচারা উৎসাহ দিতেন। কিন্তু এক সময় বাবার এই ছন্নছাড়া জীবন তারা অপছন্দ শুরু করলেন। মাও বাবাকে বলতেন, সংসার তো আর চলে না। একটু সংসারে নজর দাও। আবার আমি যখন গান শুরু করলাম তখন চাচারা আমার বাবাকে বলতেন, তুমি গান গাইতে গাইতে ফকির হইলা, এবার মেয়েটার সর্বনাশ করবা। মেয়ে গান করলে ওকে ভালো জায়গায় বিয়েও দিতে পারবা না। বরং পড়াশোনা করলে ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে পারবা। আমার গান গাওয়াকে প্রথম প্রথম চাচারা মানতে পারেনি। বাবাকে অনেক নিষেধ করতেন। সংসার এবং বাস্তবতার কারণে বাধা দেয়ার যৌক্তিক কারণও ছিল। কারণ চাচারা তো আমাদের ভালোই চাইতেন।
সাপ্তাহিক : চাচাদের বাধা আপনার বাবা কীভাবে নিলেন?
মমতাজ : বাবা চাচাদের বাধা মানেননি। বাবা বলতেন, আমার এতগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে মমতাজ গান পছন্দ করে। ও গানও ভালো গায়। গাইতে থাকুন না, দেখি কী হয়। আমি ছিলাম বাবার সবচেয়ে ছোট সন্তান। বাবা আমাকে সবচেয়ে বেশি আদর করত। নদীতে গোসল করতে গেলে বাবা আমাকে কাঁধে করে নিয়ে যেতেন। আমাকে ছাড়া বাজারে যেতেন না। কোথাও গানের অনুষ্ঠান হলে বাবা আমাকে নিয়ে যেতেন। আমিও বাবার গান অনেক পছন্দ করতাম। আমার বাবা চাচাদের বোঝাতেন। এক সময় চাচারাও বাবাকে বাধা দেয়া থেকে বিরত থাকলেন।
সাপ্তাহিক : জন্ম ঢাকায় বললেন। বাবা-মায়ের ঢাকায় থাকেন কেন?
মমতাজ : ওই সময় রজবের চাঁদে খাজা বাবার উপলক্ষে ঢাকা শহরে অনেক উরস হতো। মিরপুর এবং হাইকোর্ট মাঝারে বাউলদের দু’টি সমিতি ছিল। এই বাউল সমিতি থেকেই বিভিন্ন জায়গায় প্রোগ্রামের ডাক আসত। আমি ছোটবেলায় দেখিছি, ঢাকা শহরে প্রচুর বাউল গানের অনুষ্ঠান হতো। প্রতি মোড়ে মোড়ে গান হতো। মিরপুর খাজা বাবা শাহ আলীর মাজারে মাসব্যাপী বাউল গানের অনুষ্ঠান হতে দেখেছি। বাবা মিরপুর বাউল ক্লাবে বসতেন। সেখান থেকেই নানা জায়গায় গান করতে যেতেন। এ কারণেই বাবা মাকে নিয়ে শ্যামলীতে থাকতেন। মূলত মিরপুর মাজার কাছে হওয়ার কারণেই শ্যামলীতে থাকা।
সাপ্তাহিক : তাহলে শৈশব কি ঢাকাতেই কেটেছে?
মমতাজ : না, শৈশব ঢাকায় কাটেনি। শিশুকাল ঢাকায় কেটেছে। আমার বয়স যখন চার বছর তখনই বাবা মাকে নিয়ে গ্রামে চলে যান। শৈশব গ্রামেই কেটেছে। গ্রামেই বাবার কাছে গান শুনতাম এবং শিখতাম।
সাপ্তাহিক : ওই সময় গ্রাম কেমন দেখেছেন। গ্রামের আর্থসামাজিক অবস্থা কেমন ছিল?
মমতাজ : বেশিদিনের কথা তো নয়। এরপরেও বলতে হয়, তখন গ্রামের অবস্থা খুব ভালো ছিল তা বলা যাবে না। তিন দশক আগে গ্রামের যে চিত্র তা আমাদের ভাকুমেও ছিল। বেশিরভাগ বাড়িতেই ছনের ঘর ছিল। যাদের বাড়িতে টিনের ঘর ছিল তাদেরকেই পয়সাওয়ালা বলা হতো। অভাব ছিল তবে মানুষের চাহিদা কম ছিল। মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। ছোটবেলায় মাছ আমরা কিনে খাইনি। নদীতে মাছ ধরতাম। বাড়ির আঙ্গিনায় সব ধরনের শাকসবজিই হতো। হাঁস-মুরগি, গরুর দুধও কিনতে হতো না। এখন তো আপনি গ্রাম আর শহরের মধ্যে তেমন পার্থক্য করতে পারবেন না। গ্রামের মানুষের চাহিদা আর শহরের মানুষের চাহিদার মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, শিক্ষার কারণে আধুনিকতার ছোঁয়া সব জায়গাতেই লেগেছে।
সাপ্তাহিক : গ্রামের শৈশব। কেমন কেটেছে সেই সময়ের দিনগুলো?
মমতাজ : ধলেশ্বরী নদী হচ্ছে আমাদের বাড়ির একেবারে কাছে। শৈশবের বেশিরভাগ সময়ই আমার নদীতে কেটেছে। নদীতে সাঁতার কাটাই ছিল আমার প্রধান কাজ। নদী দিয়ে বড় বড় পাল তোলা নৌকা যেত। আমরা ছেলেমেয়েরা পিছনের বৈঠা বেয়ে নৌকায় উঠতাম। সঙ্গে যারা থাকত তারা মাঝিদের বলত, মমতাজ গান গাইতে পারে। মাঝিরা আমার গান শুনত। গান শুনে আমাদের কখনও কখনও দুপুরে খাওয়াইত। বাড়ি থেকে আনা ফলমূল দিত। মাঝিরা অনেক আদর করত। এভাবে গান গাইতে গাইতে দুই-তিন মাইল উজানে চলে যেতাম। আবার নৌকা থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে সাঁতার কেটে আমাদের ঘাটে চলে আসতাম। সে মজা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
আমি বাড়ির কাজ করতাম না। বাড়ির সবার ছোট ছিলাম বলেই হয়ত বেশি ডানপিটে ছিলাম। মা-ভাবিরা অনেক বকত। ভাবিরা বলত, ‘ও মাইয়্যা মানুষ। ছেলেদের মতো চলাফেরা। সারাক্ষণ দস্যির মতো ঘুরে বেড়ায়। ছেলেদের মতো নদীতে সাঁতার কাটে।’ অনেক সময় মার কাছে নালিশ করতেন তারা। দাঁড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, বউছি খেলা নিয়েই দিন কাটত। ছেলেমেয়ের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সবাই মিলেমিশে খেলাধুলা করতাম। গরমের দিনে জ্যোৎস্না রাতে গ্রামের মাঠে গোল্লাছুট খেলার মজাই আলাদা। মধ্য রাত পর্যন্ত মাঠেই থাকতাম।
স্কুল যাওয়া আর খেলাধুলা নিয়েই সময় পার করেছি। গ্রামে যাত্রা গান হতো। গ্রামের মানুষই অভিনয় করত। আমরা রাত জেগে দেখতাম। পরের দিন আবার আমরা ওই অভিনয়গুলো নকল করে দেখাতাম। মেয়েদের মধ্য থেকেই কেউ নায়ক আবার ছেলেদের মধ্য থেকে কেউ নায়িকা হতাম। ওইভাবেই সাজতাম। ডায়ালগ দিতাম। এমন কোনো খেলাধুলা বা কাজ নেই যা আমি করিনি। ছেলেরা যা করত আমিও তাই করতাম। শুধু করতাম না ঘরের কাজ। ঘরের কাজ করা আমি কখনও পছন্দ করিনি। এখনও করি না।
সাপ্তাহিক : শৈশবের এই দস্যিপনা নিয়ে কোনো স্মৃতি মনে পড়ে?
মমতাজ : অনেক স্মৃতিই তো আছে। শৈশব স্মৃতিই মজার স্মৃতি। আমার দুরন্তপনা নিয়ে ভাবিরা কিছু বললেও মা তেমন কিছু বলেনি। মা প্রচুর কাজ করতেন। এখনও করেন। গ্রামের মায়েরা যেমন হয়। কাজ ছাড়া মা কিছুই বোঝেন না। কিন্তু ভাবিরা চাইতেন যে, আমি বাড়ির কাজ করি। ননদদের নিয়ে ভাবিদের যে রকম ভাবনা হয় আর কী। ভাবিরা আমাকে নিয়ে মাকে নালিশ করলেও মা পাত্তা দিতেন না। মা বলতেন, আমি তো তোমাদের দশ জনের কাজ একাই করি। আমার মেয়ে কাজ করে না তাতে হিংসা কেন। তবে একদিন মার কাছেও ধরা খেয়ে যাই। বাড়িতে অনেক মুরগির বাচ্চা ফুটেছে। আমাদের বাড়ির পাশেই বটগাছে একটি চিলের বাসা ছিল। বিকাল হলেই চিল এসে মুরগির বাচ্চা ধরে নিয়ে যেত। মা ওইদিন আমাকে বলল দেখ মমতাজ, ‘আমি রান্না করছি। তুই কিন্তু আজ খেলতে যাবি না। মুরগির বাচ্চা পাহারা দে।’ মার কথা শুনে আমি বললাম দুর ছাই, আমি বাচ্চা টাচ্চা পাহারা দিতে পারুম না। এই বলেই এক দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছি। যেই না বাড়ি থেকে চলে গেছি, তখনই চিল এসে বাচ্চা নিয়ে গেছে। আর কোথায় যায়। এবার তো মায়ের পালা। বাড়িতে আসলে মা তো দিল ইচ্ছামতো উত্তম মধ্যম। বকনিরও শেষ নাই।
সাপ্তাহিক : এরপর?
মমতাজ : আমি তো কান্নাকাটি করে অস্থির। আগেই বলেছি, আব্বা আমাকে খুব ভালোবাসত। আব্বা আমার নাম খুবই সুন্দর এবং শুদ্ধ করে ঢাকতেন। আব্বা রাতে বাড়িতে খেতে বসেই জিজ্ঞেস করতেন আমি খেয়েছি কিনা। আর কারও কথা জিজ্ঞেস না করলেও আমার কথা জিজ্ঞেস করতেন। ঘুম থেকে ডেকে তুলে আমাকে খাওয়াতেন। তো ওই দিন রাতে বাড়িতে এসে আব্বা দেখছেন যে, আমার মন খুব খারাপ। আমি কান্নাকাটি করছি। ঘটনা শুনে তো আব্বা মায়ের ওপর ভীষণ রাগ। মাকে সেই রকম বকুনি দিলেন। ওইদিনের স্মৃতি মনে একেবারে গেঁথে আছে। বাবা আমাকে কখনও বকুনি দেয়নি, মারধরও করেনি।
সাপ্তাহিক : ভাইদের আদর কেমন পেলেন?
মমতাজ : ভাইরাও আমাকে অনেক ভালোবাসতেন। এখনও তাই। শৈশবেই তো গানের দলে চলে যাই। আমি যখন পালা গান শুরু করি তখন আমার বাবা হারমোনিয়াম বাজাতেন। বড় ভাই ইউনুস আলী মন্দিরা বাজাতেন। ছোট ভাই এবারত বাঁশি বাজাতেন। অর্থাৎ পরিবারের তিনজনকেই আমি গানের দলে পেয়েছি। এ কারণে ভাইদের আদর যত্নও একটু বেশি পেতাম।
সাপ্তাহিক : ভাইদের কি অবস্থা? তারা কি গ্রামেই থাকেন?
মমতাজ : ওরাও এখন অনেক ভালো আছে। বড় ভাই অনেক আগেই বিয়ে করেছেন। বড় ভাইয়ের এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়েকে আমিই বিয়ে দিয়েছি। জামাই আমার সঙ্গেই থাকত। বড় ভাইয়ের ছেলে আমার সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র বাজায়। ও আমার ন্যাম ফ্ল্যাটে থাকে। বলতে গেলে আমার সঙ্গেই আছে। ছোট ভাই আমার এক বান্ধবীকে বিয়ে করে গ্রামেই বসবাস করছে। ছোট ভাইয়ের ছেলেমেয়েরাও মাঝে মাঝে আমার কাছে আসে। ছোট বলে ওরা এখানে থাকতে চায় না। বলতে পারেন, সবার কাছাকাছিই আছি।
সাপ্তাহিক : আপনার নাম বাবা শুদ্ধ করে ডাকতেন বললেন। মমতাজ নাম রাখার প্রেক্ষাপট জানতে পেরেছিলেন? কার ইচ্ছাতে এ নাম?
মমতাজ : বাবা-মায়ের দুজনের ইচ্ছাতেই এ নাম রাখা। আমার বড় দুই ভাই হওয়ার কারণে মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল যেন পরবর্তী সন্তান মেয়ে হয়। মায়ের কাছে গল্প শুনেছি, আমি যখন তার গর্ভে ছিলাম তখন একদিন রাতে মায়ের কাছে আমার নামকরণ নিয়ে বাবা আলোচনা করছিলেন। মা বলছিলেন, এবার ছেলে সন্তান হলে আমি লালন পালন করব না। আমার এবার মেয়ে চাই। ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে তখন তো আর পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ ছিল না। বাবা তখন নাকি মাকে বলছিলেন, মেয়ে হলে নাম রাখব মমতাজ। এভাবেই গর্ভে থাকা অবস্থাতেই আমার নাম রাখা হয়। মূলত বাবার ইচ্ছাতেই এই নাম। আমি দেখেছি, বাবার মতো করে আর কেউ আমার নাম ধরে ডাকতে পারেনি।
সাপ্তাহিক : সম্রাট শাহজাহানের প্রেয়সী মমতাজ। তাজমহল প্রেমের অতুলনীয় নিদর্শন। সম্রাট শাজাহানের মমতাজের সঙ্গে নিজের নামের সার্থকতা কখনও মিলিয়ে দেখেছেন?
মমতাজ : দুটোতেই প্রেম, ভালোবাসা রয়েছে। মমতাজের প্রতি সম্রাট শাহজাহানের ছিল মধুর প্রেম। আর আমার বাবা-মাও প্রেমের মধ্য থেকেই আমার নাম রেখেছেন। আমার প্রতি বাবা-মার এই প্রেম হচ্ছে বাৎসল্য প্রেম। প্রেম হচ্ছে পাঁচ প্রকার। মমতাজের মধুর প্রেমের মর্যাদা দিয়ে শাহজাহান তাজমহল গড়েছেন। আর আমার বাবা-মা বাৎসল্য প্রেমে মগ্ন হয়ে আমার নাম রেখেছেন। বাবা-মার এই প্রেমকে আমি সম্রাট শাহজাহানের প্রেমের চেয়ে খাটো করে দেখি না। বাবা-মা বেঁচে থেকেই আমার নামের সার্থকতা দেখে গেছেন। বাংলার ১৬ কোটি মানুষ আমাকে ভালোবেসে যে তাজ পরিয়েছেন তার মর্যাদা কী সম্রাট শাহজাহানের তাজমহলের চেয়ে কম নয়। আমার গানের প্রতি গণমানুষের এই প্রেমকে আমি আরও অনেক বড় দেখি।
সাপ্তাহিক : কখন, কোন স্কুলে পড়ালেখা শুরু?
মমতাজ : আগে তো গ্রামের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে স্কুলে যেত। আমার বেলাতেও তাই হয়েছে। আমি ৭ বছর বয়সে স্কুলে যাওয়া শুরু করি। সহপাঠীরাও আমার সমবয়সীই ছিল। গ্রামের জয়মণ্ডপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখার যাত্রা শুরু। স্কুলে যাওয়ার জন্য বাবা-মার তরফ থেকে যে তাগিদ ছিল বিষয়টি তা নয়। বলা যায়, অন্যের দেখাদেখি অনেকটা নিজ উদ্যোগেই স্কুলে যাওয়া শুরু করি। আগে ‘বি’ ক্লাসে পড়তে হতো। এরপর ক্লাস ওয়ানে। আমার পাশের বাড়ির এক হিন্দু ছেলে ‘বি’ ক্লাস থেকে ওয়ানে উঠল। আমি তখন তার ‘বি’ ক্লাসের বইগুলো কিনতে চাইলাম। বইয়ের দাম হলো ৭ টাকা। আমি তখন তাকে বললাম, ঠিক আছে বইগুলো আমাকে দাও, আমি স্কুলে যেতে থাকি। টাকা পরে দেব। বই নিয়ে আমি মাকে বললাম, নিকুঞ্জের কাছ থেকে বই কিনেছি। ওকে ৭ টাকা দিতে হবে। পরে মা মুরগি বিক্রি করে সেই বইয়ের দাম দেয়। এভাবেই প্রথম স্কুলে যাওয়া।
সাপ্তাহিক : স্কুলের শিক্ষকদের কেমন পেলেন?
মমতাজ : স্কুলে যাওয়ার পরেই তো স্যারদের আমার প্রতি চোখ পড়ে গেল। স্যাররা বললেন, মধু বয়াতির মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ও অবশ্যই গান গাইতে পারবে। স্কুলে অনুষ্ঠান হলেই আমার ডাক পড়ত। আমারও লজ্জা-শরম একটু কম ছিল। কেউ শুনতে চাইলেই ঝটপট শুনিয়ে দিতাম। হাটে, ঘাটে, রাস্তায় কেউ গান শুনতে চাইলেই বলে ফেলতাম। কোনো বাছ-বিচার করতাম না। আগেই বলেছি, গোসল করতে গিয়ে নৌকায় উঠে মাঝিদের গান শোনাতাম। একদিন তো মাঝিরা গান শুনে খুশি হয়ে আমাদের কয়েক বান্ধবীকে কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ালেন। শুধু তাই নয়, মাঝিদের একজন আমাকে ৫ টাকা বকশিশও দিলেন। গান গাওয়ার প্রথম বকশিশ।
সাপ্তাহিক : গানে প্রথম বকশিশ পেয়ে কেমন লাগল?
মমতাজ : বাপরে বাপ ৫ টাকা বকশিশ। সে আনন্দ আর ধরে না। তখন ৫ টাকা মানে বিরাট কিছু। কিন্তু টাকা নিয়ে পড়লাম আরেক বিপদে। পরনে তো কেবল একটি হাফপ্যান্ট। টাকা রাখি কোথায়। দুই মাইল উজান থেকে নদী সাঁতরায়ে ঘাটে আসতে হবে। টাকা তো ভিজে যাবে। আমার এই বিপদ দেখে আরেক মাঝি একটি পলিথিনের কাগজ বের করলেন। পরে ওই টাকা পলিথিনে পেঁচিয়ে আমার কোমরের সুতার সঙ্গে গিট্টু দিয়ে দিলেন। এভাবেই টাকা নিয়ে বিপদ থেকে রক্ষা পেলাম।
সাপ্তাহিক : কী করলেন সেই টাকায়?
মমতাজ : বাড়িতে এসে মাকে বললাম। আমি তো মহাখুশি। এর কয়েক দিন পরেই রথের মেলা। আমার টাকার গরম আর দেখে কে। রথের মেলা এলেই আমরা বান্ধবীরা চিন্তায় পড়ে যেতাম। মেলায় খরচ করব, সেই টাকার জন্য ঢেঁকি শাক, কচুর লতি, নদী থেকে কলমি শাক কুড়িয়ে বাজারে বিক্রি করতাম। আমরা অনেক কষ্টে দুই তিন টাকা যোগাড় করতাম। এবার রথের মেলায় তো আমার আর সে চিন্তা নেই। নগদ টাকা হাতে। মেলায় গিয়ে ৫ টাকায় অনেক কিছু কিনে ফেললাম। গান গাওয়ার টাকায় মেলায় খরচ করে অনেক মজা পেলাম।
সাপ্তাহিক : স্যারদের নিয়ে আর কোনো স্মৃতি মনে পড়ে?
মমতাজ : স্যারদের যে আদর, ভালোবাস পেয়েছি তা কখনও ভুলতে পারব না। আগেই বলেছি, আমরা যখন বড় হতে থাকলাম তখন পরিবারে খুব অভাব যাচ্ছিল। অনেক সময় ঘরে চালও থাকত না। না খেয়ে স্কুলে যেতাম। বাবা খাবারের চালই আনতে পারেনি সেখানে স্কুলে টিফিনের টাকা প্রত্যাশা করা অসম্ভব ছিল। বাবা অনেক সময় খাতা-কলমও কিনে দিতে পারেনি। আমাদের অভাব-কষ্ট স্যাররা জানতেন। টিফিন হলে আমিও লুকিয়ে থাকতাম। কিন্তু স্যাররা খুঁজে খুঁজে বের করে বলতেন, তুই আমাদের সঙ্গে টিফিন করবি। তুই কোনো লজ্জা করবি না, আমাদের সঙ্গে টিফিন করে গান শোনাবি। গান শুনিয়ে অনেকদিন স্যারদের সঙ্গে টিফিন করেছি। এ কারণেই শৈশবে স্যারদের খুব কাছাকাছি হতে পেরেছিলাম। আমি কবিতাও আবৃত্তি করতে পারতাম। একবার তো কবিতা আবৃত্তি করে প্রথম হয়েছিলাম। আর গানের তো শেষ ছিল না। এক স্যার বলতেন, তুই লালনগীতি গাইতে পারবি। আমি বলতাম, পারব। এরপর আরেক স্যার বলতেন ভাওয়াইয়া গা। গাইতাম। গানে আমার কোনো না ছিল না। পল্লীগীতি, লালনগীতি, মুর্শিদী, বিচ্ছেদ সবই গাইতাম।
সাপ্তাহিক : শৈশবেই গানে বিশেষ পারদর্শিতা। প্রথম কার কাছে, কীভাবে শিখলেন?
মমতাজ : বাবার কাছ থেকেই প্রথম গান শেখা। বাবা প্রচুর গান গাইতেন। তবে বাবা প্রথমে বুঝতে পারেনি যে আমি গান গাইতে পারব। বাড়িতে বৈঠকি গানের আসর বসত। সেখানে বাবা কিচ্ছা শোনাতেন। পাড়ার লোকজন কিচ্ছা শুনতে আসতেন। হারমোনিয়াম নিয়ে কিচ্ছা বলার মাঝে মাঝে অনেক গান গাইতেন। আমি বাবার পাশে বসতাম। পরে বাবাও আমাকে তার সঙ্গে সঙ্গে গান ধরতে বলতেন। বাবাই আমার গানের প্রথম ওস্তাদ।
সাপ্তাহিক : পড়ালেখায় কেমন মনোযোগ ছিল?
মমতাজ : আমি পড়ালেখাতেও ভালো ছিলাম। প্রাইভেট পড়তাম না। বাড়িতেও কেউ আমাকে পড়াতেন না। এরপরেও পড়ালেখায় খুব খারাপ ছিলাম না। স্কুলের স্যারদের সহযোগিতা পেয়েছি।
সাপ্তাহিক : স্কুল জীবনের বিশেষ কোনো ঘটনা মনে পড়ে?
মমতাজ : তৃতীয় শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা আমার জন্য একটি স্মরণীয় ঘটনা। বাবা কুমিল্লায় প্রোগ্রাম নিয়েছেন। সন্ধ্যায় চলে গেলাম। বাবা-মেয়ে সারা রাত অনুষ্ঠানে গান করেছি। সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরু হবে। আমি তো চিন্তায় অস্থির। সঙ্গে বই খাতা নিয়েছি। তবে পড়ার সময় বের করতে পারিনি। ফজর আজানের আগে গান শেষ হলো। আমি বাবাকে বার বার বলছি তাড়াতাড়ি চলো, পরীক্ষা দিতে হবে। ফজর আজানের পরপরই ট্রেনে রওনা হলাম। পরীক্ষার হলে যখন প্রবেশ করলাম, তখন বেলা ১১টা বাজে। দুই ঘণ্টার পরীক্ষার মধ্যে এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। স্যাররা জিজ্ঞেস করলেন, বিলম্ব কেন? আমি বললাম, বাবার সঙ্গে কুমিল্লায় গান করতে গিয়েছিলাম। সকালে রওনা হয়েছি। স্যাররা বললেন ঠিক আছে, তুই নিশ্চিন্তে লেখা শুরু কর। তোর জন্য এক ঘণ্টা বাড়ানো হবে। তাই হলো। স্যারদের এই আন্তরিকতা তো কোনোদিন ভুলতে পারব না।
সাপ্তাহিক : গানের জন্য স্কুলে বিশেষ পরিচিত পেলেন। এসময় কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেননি?
মমতাজ : স্কুলে আমার কোনো বিকল্প ছিল না। গানে আমি সবসময় প্রথম হতাম। স্কুলগুলোর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শেষে নির্বাচিতদের নিয়ে সিঙ্গাইর উপজেলায় একবার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। স্কুল থেকে আমাকে সেখানে পাঠানো হয়। এরশাদের আমলের ঘটনা। আমাদের আসনের জাতীয় পার্টির এমপি গোলাম সারওয়ার মিলন তখন মন্ত্রী। অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি। উপজেলা চেয়ারম্যানও ছিলেন। এই প্রথম এত মানুষের সামনে গান করছি। প্রথম গান গাওয়ার পর দর্শকরা অনুরোধ জানিয়ে বললেন, যে মেয়েটি গান করছে তাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। ওকে টেবিলের ওপরে উঠানো হোক। আমি একেবারেই পিচ্চি ছিলাম। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। দর্শকদের অনুরোধে তাই হলো। টেবিলের উপরে উঠে গান গাইলাম। গানে দর্শকরা মুগ্ধ। মন্ত্রী গোলাম সারওয়ার মিলন আমাকে দুই হাজার টাকা বকশিশ দিলেন। উপজেলা চেয়ারম্যান দিলেন পাঁচ শত টাকা। ওই অনুষ্ঠানে প্রায় তিন হাজার টাকার মতো বকশিশ পাই। ওই সময় তিন হাজার টাকা আমার জন্য অনেক বড় কিছু। স্যারদের কারণেই আমার এমন প্রাপ্তি। ওই দিনও আমার সঙ্গে এক স্যার ছিলেন।
সাপ্তাহিক : পড়াশোনা এবং গান গাওয়া এ দুটির মধ্যে কোনটিকে গুরুত্ব দিলেন?
মমতাজ : আমার তো সবসময় গান গাওয়াই ভালো লাগত। বাবা মঞ্চে গান করতেন। বাবার সঙ্গে অনেকেই গান গাইতেন। মাইকে ক্যাসেট বাজত, তা দেখে মনে মনে খুব ইচ্ছা জাগত যে, কোনো দিন যদি আমি এভাবে গান গাইতে পারতাম। মঞ্চে উঠে মাইকে উচ্চৈঃস্বরে গান করব এমন ইচ্ছা ছোট বেলা থেকেই লালন করতাম। গানের প্রতি এই মুগ্ধতা এবং ভালোবাসা থাকার কারণে হয়ত পড়ালেখার স্বপ্নটা ক্রমেই ফিকে হতে থাকে। তবে বুঝতাম যে পড়ালেখা ছাড়া জীবনে বড় কিছু হওয়া যায় না। কিন্তু এটি বোঝার পরেও গানের প্রতি ভালোবাসা কমাতে পারিনি।
সাপ্তাহিক : শৈশব বন্ধুদের কেমন পেয়েছিলেন?
মমতাজ : সত্যি কথা বলতে কী, পরিবারে অভাব ছিল বটে কিন্তু আমি যে ভাগ্য নিয়ে জন্মেছি তা হয়ত অনেকেরই নেই। মানুষের প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা, আমি তা নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি। ছোটবেলা থেকেই আমি মানুষের অসাধারণ ভালোবাসা পেয়ে আসছি। জীবনে অনেক স্টেজ পার করেছি। কিন্তু সব জায়গাতেই মানুষ আমাকে অতি ভালোবাসা দিয়েছে। স্কুলের বন্ধুরা থেকে শুরু করে গানের আসর, বাউল জগৎ, রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সমস্ত জায়গায় মানুষ আমাকে খুব কাছে থেকে মূল্যায়ন করে। মানুষের কাছাকাছি থাকার জন্য আমিও আন্তরিক। মানুষের সঙ্গে মিশতে আমার মধ্যেও কোনো জড়তা কাজ করে না। সব শ্রেণীর মানুষ আমাকে যেভাবে সাড়া দেয় তার চেয়ে বড় কোনো অর্জন আছে বলে আমার জানা নেই। ছোটবেলার বন্ধুদের যে ভালোবাসা তার তো তুলনা হয় না।
সাপ্তাহিক : বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়?
মমতাজ : আমি ঢাকায় থাকলেও গ্রামের বাড়িতে অনেক সময় কাটে। আগে তো গ্রামেই থাকতাম। মা গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। এখন ব্যবসা, রাজনীতির কারণে গ্রামে যেতেই হয়। গ্রামে গেলে শৈশবের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়, সাক্ষাৎ হয়। আমি প্রায় সবার সঙ্গেই যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করি। অনেক বন্ধুই পড়াশোনা করে ভালো চাকরি করছেন। তারাও আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন।
সাপ্তাহিক : শিক্ষকরা এখন কেমন দেখেন?
মমতাজ : স্কুল জীবনে যে শিক্ষকদের কাছাকাছি ছিলাম তারা এখনও অতি আপন বলেই আমাকে মূল্যায়ন করে থাকেন। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয়। স্যারেরা কোনো বিষয় নিয়ে আমার কাছে আসতে দ্বিধা করেন না। আমি তো তাদেরই মমতাজ। যে দু’জন শিক্ষক আমাকে নানা অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন তারা হচ্ছেন আব্দুর রশিদ এবং আদম আলী স্যার। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন তারা। রশিদ স্যারকে আমি চাচা বলে ডাকতাম। আপনি আসার আগেও রশিদ স্যার আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, মা তুই এবার নির্বাচন কর। এলাকার গরিব, দুঃখী মানুষের পাশে তোকেই দাঁড়াতে হবে। আমরা তোর নির্বাচন করব। আমার জন্য এটিই আশার কথা। স্যারদের আশীর্বাদ নিয়েই তো পথ চলছি।
সাপ্তাহিক : বাবার সঙ্গে প্রথম কখন গান করলেন?
মমতাজ : তখন শ্যামলীতে থাকতাম। আমি একেবারেই পিচ্চি। বাবা নিয়মিত মিরপুরে খাজা বাবার মাজারে গান করতে যেতেন। প্রতি সন্ধ্যায় সেখানে বাউলদের গানের আসর বসে। একদিন আমি বাবার সঙ্গে যাওয়ার জন্য বায়না ধরি। ফিরতে অনেক রাত হবে বলে বাবা আমাকে নেবে না। পরে মায়ের অনুরোধে বাবা আমাকে শাহ আলী বাবার মাজারে নিয়ে যায়। আমার বাবা, ওস্তাদ মালেক সরকার, মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান, ইসলাম সরকার গান করছেন। আমি ওস্তাদ ইসলাম সরকারের কাছে বসা। অনুষ্ঠানের মাঝে ওস্তাদ ইসলাম সরকারের কাছে বায়না ধরলাম, কাকা আমি গান গাইব। কাকা বলছেন তুমি গান জানো? আমি বললাম, পারব। তখন ইসলাম কাকা বাবাকে বললেন, ভাই ভাতিজি যে গান গাওয়ার বায়না ধরছে। বাবা তো ধমক। বাবা বলেন, ও গান জানে নাকি। পারবে না। আমিও নাছোড়বান্দা। পরে ইসলাম কাকা দর্শকদের উদ্দেশে বললেন, আমাদের মধু বয়াতির পাঁচ বছরের মেয়ে মমতাজ আপনাদের গান শোনাবে। দর্শকদের হাতে তালি। যন্ত্রের সঙ্গে তাল, লয় ঠিক রেখে গাইলাম। কোনো ভুল হয়নি। সবাই তো অবাক। দর্শকরা মহাখুশি। প্রচুর টাকা বকশিশ পেলাম। দু’হাত টাকায় ভরে গেল।
সাপ্তাহিক : বাবা কী বললেন?
মমতাজ : ইসলাম কাকা বাবাকে বললেন, মেয়ের সাহস দেখেন। ও পারবে। আপনি ওকে গান শেখান। তখন বাবা বললেন, বাড়ির গরু তো পালানের ঘাস খায় না। আমি গান ভালো করতে পারি বটে, কিন্তু ওস্তাদ ভালো নাও হতে পারি। আমি তো সময় দিতে পারব না। তখন ইসলাম কাকাই বাবাকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, একমাত্র মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানই পারে মমতাজকে গান শেখাতে। সে যেমন গায় তেমন শেখায়। মমতাজকে তার কাছে দিয়ে দেন।
সাপ্তাহিক : তাহলে এমন নাটকীয়তার মধ্যেই মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের সংস্পর্শে আসা?
মমতাজ : হ্যাঁ, পরের দিন বাবা মাজারে গিয়ে দেওয়ানের সঙ্গে কথা বললেন। মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান সবসময় নেশায় মগ্ন থাকত। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার নেশা করা শুরু হতো। রাজ্জাক দেওয়ান আমার বাবাকে কাকা বলে ডাকতেন। তিনি হচ্ছেন খালেক দেওয়ানের শিষ্য। আর বাবা ছিলেন খালেক দেওয়ানের আরেক শিষ্য ইউসুফ দেওয়ানের ছাত্র। ইউসুফ দেওয়ানকে বাবা চাচা বলতেন বলেই রাজ্জাক দেওয়ানও বাবাকে চাচা বলতেন। পরে আলোচনার এক পর্যায়ে বাবা রাজ্জাক দেওয়ানকে বললেন, আমি তো মমতাজকে গান শেখাতে চাই আর সে দায়িত্বটা আপনাকেই নিতে হবে। রাজ্জাক দেওয়ান বললেন, আপনার মেয়ে গান শিখবে, সে তো ভালো কথা। ওকে অবশ্যই গান শেখাব। এই তো শুরু হলো গান শেখার পালা।
সাপ্তাহিক : প্রাথমিক অবস্থায় শেখার ক্ষেত্রে কোন ধরনের গানে মনোযোগ দিলেন?
মমতাজ : পালা গান, বিচ্ছেদ, মুর্শিদী সবই শিখতে শুরু করলাম। রাজ্জাক দেওয়ান প্রচুর গান লিখতেন। গান লেখায় তার কোনো তুলনা হয় না। তিনি কোথাও গান করতে গেলেই বাবাকে বলতেন, মমতাজকে নিয়ে আসবেন। পরে সেখানে তার লেখা পালা গান আমার ডায়েরিতে লিখে দিতেন। আমার সুবিধা ছিল, তিনি বাবাকে বুঝিয়ে দিতেন আর বাবা বাড়িতে গিয়ে আমাকে বোঝাতেন। অতি সহজেই আমি তা রপ্ত করতে পারতাম। এভাবেই পালা গানের পালা শুরু হলো।
সাপ্তাহিক : শাহ আলীর মাজারে কোন গানটি গাইছিলেন?
মমতাজ : ‘আমি ভাবছিলাম কী এই হালে দিন যাবে রে সুজন নাইয়া, পার করো দুঃখিনী রাধারে’ এই গানটি ওইদিন মঞ্চে গাইছিলাম। তবে এই গানের আরও একটি ঘটনা আছে। গানটি বাবা নাকি কোনো একদিন বাড়িতেই প্রথম আমার কাছ থেকে শুনেছিলেন। আগেই বলেছি, অভাবেই আমাদের বেড়ে ওঠা। বৃষ্টি বাদলের দিন। বাবার প্রোগ্রামও নেই। বুঝতেই তো পারছেন বাড়ির কী হাল। ওইদিন বাবা বাড়ি ছিলেন না। দিনের বেলায় ঘরে শুয়ে শুয়ে গানটি গাইছিলাম। হঠাৎ বাবা বাড়িতে এসে শুনতে পান যে, কেউ একজন ঘরের ভেতর থেকে গান গাইছে। দুয়ারে দাঁড়িয়ে পুরো গানটাই নাকি তিনি শুনছিলেন আর মা বাইরে থেকে দেখছেন। গান শেষ হওয়ার পর বাবা আর ঘরে ঢোকেননি। তিনি আবার বাইরে চলে যান। ওইদিনই প্রথম বাবা আমার গান শুনতে পান।
সাপ্তাহিক : মঞ্চে প্রথম গাইলেন। কেমন লাগছিল?
মমতাজ : ওই দিন তো ছিল আমার জীবনের একটি ইতিহাস। দু’হাতের মুষ্টিভর্তি টাকা। আনন্দ দেখে কে। বাবাকে বললাম, আমাকে একটি মাটির ব্যাংক কিনে দিতে হবে। টাকা দিয়ে এই করব, ওই করব কত পরিকল্পনা যে মাথায় চলে এলো তা বোঝানো যাবে না। গানের প্রতি উৎসাহও বেড়ে গেল।
সাপ্তাহিক : সঙ্গীত পরিবারের মেয়ে। দাদা বৈঠকি গান করতেন। বাবা বাউল ছিলেন। তখন পরিবার নিয়ে ভাবনাগুলো কেমন ছিল?
মমতাজ : ছোটবেলায় তো অতসব বুঝতাম না। বাবার গান ভালো লাগত। বাবা যখন যে ঢংয়ে গান গাইতেন তখন সেটাই আমার কাছে ভালো লাগত। এলাকায় অনেক যাত্রা গান হতো। বাবাকে যাত্রা পালায় বিবেকের গান গাইতে দেয়া হতো। মেকআপ রুম থেকেই বাবা সুর ধরে মঞ্চে উঠতেন। সুর ধরলেই মানুষ বুঝতে পারতেন যে মধু বয়াতি গান গাইছেন। বাবার কণ্ঠে অসাধারণ পাওয়ার ছিল। যাত্রাপালার মাঝখানে বাবা যখন বাউলের বেশে সত্য কথা নিয়ে বিবেকের গান ধরতেন তখন নিজের মধ্যে আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করত। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যেত। একইভাবে দাদার গানেও উৎসাহ পেতাম। ভাবতাম এইভাবে যদি আমিও গাইতে পারতাম।
সাপ্তাহিক : রাতের বেলায় যাত্রাপালা দেখতে যেতেন। বাবার সঙ্গেই যেতেন?
মমতাজ : বাবা অনেক সময় মানা করতেন। বলতেন, সারা রাত যাত্রাপালা দেখে এসে দিনে কোনো কাজ করবে না, পড়াশোনা করবে না। যাত্রা দেখার কোনো দরকার নেই। কিন্তু আমরা শুনতাম না। বাবা চলে যাওয়ার পরেই ভাইয়ের সঙ্গে চলে যেতাম। যাত্রা শুরু হলে চুপিচুপি প্যান্ডেলের কাছে যারা বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন তাদের কাছে গিয়ে বসতাম। বলতাম, কাকা একটু জায়গা দেন বাবা যেন না দেখে। কিন্তু মঞ্চে উঠেই বাবা টের পেতেন যে, আমি বাঁশিওয়ালা কাকার কাছে বসে আছি। তখন আর কিছু বলতেন না। যাত্রাপালা আমার খুব প্রিয় ছিল।
যাত্রা দেখতাম আর ভাবতাম, আহা! আমি যদি এখানে নায়িকা হয়ে অভিনয় করতে পারতাম। নায়িকার যিনি অভিনয় করতেন তাদের একজনের নাম ছিল মমতাজ। আমার নাম মমতাজ হওয়ায় বাবাকে সেও বাবা বলে ডাকতেন। আরেকজনের নাম ছিল মায়া রানী। ওদের অভিনয় দেখে খুব ভালো লাগত। হাসি, কান্না দেখে নিজেরও ওরকম করতে ইচ্ছা করত।
সাপ্তাহিক : ওই সময়ের যাত্রাপালার সঙ্গে তুলনা করে এখন কী বলবেন?
মমতাজ : সে সময় তো মানুষ মুগ্ধ হয়ে যাত্রা দেখত। তখন একটি নাচ শুরু হলেই দর্শকরা প্রতিবাদ করত। আর এখন যাত্রার নামে কেবল নর্তকী নাচানো হয়।
এখন তো মানুষ গানবাজনার অনুষ্ঠানে যেতে পারে না। আগে দেখতাম যাত্রা অনুষ্ঠানে অর্ধেক মহিলা দর্শকও থাকতেন। এখন আর সে পরিবেশ নাই। মহিলারা আর কোথাও গান শুনতে যেতে পারছেন না।
সাপ্তাহিক : পারিবারিকভাবে গানের জগতে বিচরণ। আপনাদের গান করা সে সময় সমাজের মানুষেরা কীভাবে দেখত।
মমতাজ : যে কোনো বিষয় নিয়েই মানুষের মাঝে নেগেটিভ, পজিটিভ ধারণা কাজ করে। তখনও ছিল, এখনও আছে। মিডিয়ার এত প্রসারের পরেও মানুষ নেগেটিভ ধারণা থেকে বের হতে পারেনি। বিষয়টি এমন যে, কেউ একজন গান খুব পছন্দ করেন কিন্তু তার মেয়ে বা বোন গান করবেন তা মেনে নিতে পারেন না। সমাজের অনেকেই ভালো চোখে দেখতেন। আবার কেউ সমালোচনাও করতেন। এই বাধা যে অতিক্রম করতে পারে কেবল তারাই প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন। বাধা আসবেই। তাকে জয় করাই হচ্ছে সার্থকতা।
সাপ্তাহিক : সমাজের মানুষের সহযোগিতা পেয়েছেন?
মমতাজ : হ্যাঁ, সমাজের অনেকেই তো সহযোগিতা করেছেন। যারা মাতব্বর ছিলেন, তাদের অনেকেই বাবার গান পছন্দ করতেন। আমার ছোটবেলার গানে তারাও উৎসাহ দিতেন। তাদের আশীর্বাদ এবং সহযোগিতার কারণেই এই জায়গায় আসতে পেরেছি।
সাপ্তাহিক : বলছিলেন, বাবা অনেকটাই সংসার ছাড়া। বাউল বাবাকে নিয়ে মায়ের কী ভাবনা ছিল?
মমতাজ : আমার মায়ের নাম উজালা বেগম। মা জীবনে খুবই কষ্ট করেছেন। বাবা ছিলেন উদাসীন। সংসারের সবকিছু মাকেই করতে হতো। তবে বাবার বাউল জীবন নিয়ে মা কখনও বিরক্ত হননি বরং অনেক পছন্দ করতেন। এক সময় আমিও বাউল জীবনে চলে গেলাম। আমার জন্য মায়ের কষ্টটাই ছিল সবচেয়ে বেশি। আমার এ পর্যায়ে আসার জন্য বাবার থেকে মায়ের ভূমিকা কোনো অংশেই কম নয়।
সাপ্তাহিক : যেমন?
মমতাজ : ওস্তাদ মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান যখন আমাকে গান শেখাতে আসতেন তখন মা-ই তার সেবাযত্ন করতেন। ওস্তাদ প্রচুর পান খেতেন। আমার মাও পান খায়। কিন্তু মা খুব পরিপাটি একজন মানুষ। মা এখনও আমার চেয়ে অনেক গোছানো। বাবাও খুব পরিপাটি ছিলেন। বাবা নিজের কাপড় নিজে পরিষ্কার করতেন। একেবারে সাদা কাপড় পরতেন। ওস্তাদ রাজ্জাক দেওয়ান যখন বাড়িতে আসতেন তখন পানের পিকে পুরো বাড়ি ভরে যেত। মা পিক ফেলানোর বাসন দিলেও ওস্তাদের সেদিকে খেয়াল থাকত না। কিন্তু আমার ওস্তাদকে নিয়ে মা কোনোদিন বিরক্ত হননি।
আবার অনেক সময় দেখা গেছে, বাড়ি থেকে তিন-চার কিলোমিটার দূরে কোনো গানের অনুষ্ঠান গান গাইতে হবে আর তখন আমি পায়ে হেঁটে যেতে চাইতাম না। রিকশা, ভ্যানও ছিল না। তখন মা আমাকে কোলে করে নিয়ে গানের আসরে রেখে আসতেন। আমার ওস্তাদ যখন গান শেখাতে আসতেন মা তখন তার গোসল থেকে শুরু করে সবই করতেন। শীতকালে পানি গরম করে দিতেন। গরমকালে সারাক্ষণ পাখার বাতাস করতেন। শিষ্য হিসাবে যা আমার করার কথা তা আমার মা করতেন। আমি এগুলো বুঝতামও না, অভ্যাসও ছিল না। মা নিজেই সেবাযতœ করে ওস্তাদের কাছ থেকে আমার জন্য কাজ আদায় করে নিতেন। লোকে বলত, সন্তানের জন্য মহিলা কত কষ্ট করছে। মূলত বাবার কাছ থেকে শুরু হলেও মায়ের পরিশ্রমের কারণেই শিল্পী মমতাজ হতে পারছি।
সাপ্তাহিক : বাউল জীবনের বাইরে বাবাকে কেমন দেখেছেন?
মমতাজ : বাউলদের হিংসা থাকে না। বাবাও তাই ছিলেন। কখনও মিথ্যা কথা বলতেন না। কারও সঙ্গে ঝগড়াও করতেন না। বাবা একেবারে নিরীহ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। বাবার কাছ থেকে কেবল ভালোবাসা আর আদরই পেয়েছি আমরা। কখনো চড়াও হতে দেখিনি। বাবা ছিলেন একজন সহজ-সরল ভালো মানুষ। বড় ধরনের কোনো চাহিদাও ছিল না তার।
সাপ্তাহিক : শৈশবে গান শেখা বা গাওয়া নিয়ে কোনো স্মৃতি?
মমতাজ : বাবার সঙ্গে পালা গানের অনুষ্ঠানে যাই। গভীর রাত পর্যন্ত পালা গান চলত। আমি তখনও পালা গান করি না। পালা শুনতে শুনতে এক সময় দর্শকরা ভাবের গান অর্থাৎ মুশির্দী, বিচ্ছেদ গান শুনতে চাইতেন। তখন বাবা বলতেন আমি তো পালা করলাম, এবার আমার মেয়ে গান গাইবে। ও ভালো গায়। ওর গান শুনুন। রাত তিনটার দিকে ঘুম থেকে উঠে গান গাওয়া লাগত। দয়ালের গান, মুর্শিদের গান শুনে তো মুরুব্বি দর্শকরা কান্নাকাটি করে অস্থির। গানের সময় আমিও কাঁদতাম। বাবার সঙ্গে থাকা এক দোহারী আমাকে একদিন বললেন, ‘তুই পিচ্চি মাইয়্যা। তুই দয়াল, মুর্শিদের কী বুঝিস। মুরুব্বিরা কান্না করে ঠিক আছে। তুই কান্না করস ক্যান।’ আমি তখন বললাম, কান্না করুম না ক্যান। রাত তিনটার সময় আমারে ঘুম থেকে তুইল্যা গান করতে কইব্যা, আমার বুঝি কষ্ট হয় না। এত রাতে গান করলে খিদাও লাগে, ঘুমও লাগে। এই দুঃখেই তো কান্না করি।’ আমি ঘুমের জন্য কাঁদতাম। আর দর্শকরা মনে করতেন নিজের গানে মত্ত হয়ে নিজেই কাঁদছি। কী যে হাস্যকর ঘটনা তা বলে বুঝানো যাবে না। গান শেখা, গাওয়ার ক্ষেত্রে এরকম তো অনেক ঘটনাই আছে।
সাপ্তাহিক : গান শেখার ধরনটা কেমন ছিল?
মমতাজ : ওস্তাদ মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান অনেক সহজভাবে আমাকে গান শেখাতেন। বাবার সঙ্গে যখন পালা গান করতাম তখনও রাজ্জাক দেওয়ানের শেখানো পদ্ধতিই অনুসরণ করতাম। যেমন, গুরু-শিষ্যের পালা যখন হতো, তখন আমি শিষ্যের পালা নিতাম। স্রষ্টা এবং জীবের মধ্যে পালা হলে আমি জীবের পালা নিতাম। একইভাবে শরিয়ত-মারফত পালার সময় আমি শরিয়ত পালা নিতাম। কারণ, মারফতের অনেক গোপন তথ্য জানতে হয়। আমি অত যুক্তি, প্রশ্ন জানতাম না। ওস্তাদ আমাকে যে প্রশ্নগুলো লিখে দিত তার মধ্য থেকেই জেরা করতে হতো। যে পালাগুলো সহজ ছিল সেই পালাগুলো আমাকে দেয়া হতো।
সাপ্তাহিক : এ ক্ষেত্রে বাবার সহযোগিতা কেমন পেয়েছেন?
মমতাজ : বাবা একেবারে কাছে ছিলেন বলেই আমি পালা গান শিখতে পেরেছি। বাবার যখন বয়স হয়ে গেল তখন পালার মধ্যে গানগুলো আমাকেই করতে হতো। বাবা যুক্তিতর্কে ভালো করতেন কিন্তু আমি গান ভালো করতাম। যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো করেছি।
সাপ্তাহিক : বিখ্যাত বাউল শিল্পী রশিদ সরকারের সঙ্গে আপনার পালা গানে আপনার সফল জুটি। দু’জনে একসঙ্গে সারা দেশে গান পালা করেছেন। তার সঙ্গে কখন জুটি বাঁধলেন?
মমতাজ : আমি তখন একটু একটু পালা গান শিখতেছি। একদিন শুনতে পেলাম যে, আমাদের মানিকগঞ্জের পুটাইল নামের এক জায়গায় পালাগানের আসর বসবে। গাইবেন বিখ্যাত বাউল শিল্পী রশিদ সরকার এবং আলেয়া বেগম। রশিদ সরকার তখন সারাদেশের হাতেগোনা চার-পাঁচ জন পালাগান শিল্পীর মধ্যে একজন। সারা দেশেই এক নামে পরিচিত। আমি বাবাকে বললাম যে, চলো গান শুনতে যাব। দিনের বেলায় গান। গিয়ে রশিদ সরকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তার বাড়ি সিঙ্গাইর সদরে। বাবার সঙ্গে অনেক গান করছেন তিনি। আমাকে দেখে বাবাকে বললেন, ওকে নিয়ে এসেছেন ভালোই হয়েছে। গান শুনতে পারবে। আমরা গান শোনার জন্য অপেক্ষা করছি। মানুষে মানুষে মাঠ কানায় কানায় ভরে গেছে। বেলা বাড়ছে কিন্তু আলেয়া বেগম আসছে না। দর্শক তো গান শোনার জন্য চিৎকার চেচামেচি শুরু করে দিল। এক পর্যায়ে রশিদ সরকার মঞ্চে উঠে দর্শকরদের উদ্দেশে দু’টি গান করে বললেন, আমাদের পালাগানের আরেক শিল্পী আলেয়া বেগম এখনও আসতে পারেনি। আপনারাই বলুন, কী করা যায়। তখন তো মোবাইলও ছিল না যে ফোন করে খোঁজ নিতে পারবে। শিল্পী আসেনি এই কথা শুনে তো দর্শক আরও অস্থির। তখন রশিদ সরকার বাবাকে বললেন, আপনি মমতাজকে পালা শেখাচ্ছেন। ও কি গাইতে পারবে। বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম, ওনাকে গুরু-শিষ্য নিতে বলো। শিষ্যের পালা হলে আমি গাইতে পারব। তখন রশিদ সরকার মঞ্চে উঠে দর্শকদের বললেন, আলেয়া যেহেতু আসেনি আর আসবে কিনা তা বলাও যাচ্ছে না, তাই বিকল্প ভাবতে হচ্ছে। আপনারা চাইলে ছোট্ট একটি মেয়েকে নিয়ে আমি গাইতে চাই। ও মধু বয়াতির মেয়ে মমতাজ। গান শিখছে। আমরা গুরু-শিষ্যের পালা করব। দর্শকরা আপাতত শান্ত হলো।
সাপ্তাহিক : ওইদিন কেমন গাইলেন এ রকম একজন পালা শিল্পীর সঙ্গে?
মমতাজ : রশিদ সরকার অনেক জানতেন। কিন্তু আমি তো ভালো গান করতাম। মঞ্চে উঠে শুরু করলাম। আমার ওস্তাদ মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের লেখা গান। গানে অনেক প্রশ্ন। তো একপর্যায়ে রশিদ সরকার বলে ফেললেন, তোমার এক গানের প্রশ্নের উত্তর দিতে দফারফা। তিনি খেপে গেলেন। পাবলিক তো মহাখুশি। রশিদ সরকারের মতো বাউলকে খেপিয়ে দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। আমি তখন বললাম, পারলে উত্তর দেন। না পারলে বলেন যে, জানি না। তখন সে আরও উত্তেজিত। বললেন হ্যাঁ, রশিদ সরকার পারবে না এমন কোনো বিষয় আছে? এরকম টান টান উত্তেজনা নিয়েই গান শেষ করলাম। দর্শক বলতে শুরু করল, রশিদ সরকারে মতো শিল্পীর সঙ্গে মধু বয়াতির মেয়ে গান করল। এতো বিশাল ব্যাপার। পরে রশিদ সরকার বাবাকে বললেন, ও তো ভালো গায়। শ্রম দিন। পারলে আমিও সহযোগিতা করব। এভাবেই রশিদ সরকারের সঙ্গে পালাগানে জুটি বাঁধা।
সাপ্তাহিক : মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের কাছে কোথায় গান শিখতেন?
মমতাজ : মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের বাড়ি ছিল কেরানীগঞ্জের আটিবাজার। আমি যখন তার কাছে গান শিখি তখন তিনি থাকতেন সাভারের কাছে আমিনবাজারে। আমিনবাজারে তার শ্বশুরবাড়ি। সেখানেই তিনি থাকতেন। মূলত মিরপুর শাহ আলী বাবার মাজার কাছে হওয়ার কারণেই তিনি আমিনবাজারে থাকতেন। ওস্তাদ মিরপুর বাউল সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। আমি আমিনবাজারেই তার কাছে গান শিখতাম। যখন শীতকাল অর্থাৎ গানের প্রোগ্রাম আসত তখন তিন, চার মাস তার কাছেই থাকতাম। শীত চলে গেলে বাড়িতে চলে যেতাম। ওস্তাদ আবার মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়িতে এসে আমাকে গান শেখাতেন। মাতাল রাজ্জাকের সঙ্গে এভাবেই থাকা।
সাপ্তাহিক : গান শিখতে পালাগানের বাইরে আর কোন ধরনের গানকে গুরুত্ব দিলেন?
মমতাজ : আমি তো গানই শুরু করেছি বিচ্ছেদ, মুর্শিদী দিয়ে। যেমন, বিজয় সরকারের বিজয় বিচ্ছেদ ভালো গাইতাম। রজব আলী দেওয়ান, খালেক দেওয়ান, মালেক দেওয়ানের গান করতাম। লালনগীতি গাইতাম। পাঞ্জুশাহ, জালান উদ্দিন খা, রশিদ উদ্দিনের গান অনেক গেয়েছি। এরকম বড় বড় সাধকদের গান করতাম।
রশিদ সরকার, মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান, আমার বাবার মতো বড় বড় বাউলের সঙ্গে বেড়ে ওঠা। সুতরাং তাদের থলিতে যা ছিল সবই আমাকে উজাড় করে দিয়েছেন। রশিদ সরকার কোনো নতুন গান গাইলেই আমি ডায়েরিতে নোট করে রাখতাম। আর ওস্তাদ মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের ডায়েরি তো আমার কাছেই থাকত। রাধাবল্লভ, রাধারমনের গান ভালো লাগত।
সাপ্তাহিক : দর্শকরা বিশেষত আপনার কোন গান পছন্দ করত?
মমতাজ : দর্শকরা আমার বিচ্ছেদ গান খুব পছন্দ করত। রাজ্জাক দেওয়ান, রশিদ সরকার এবং আমার বাবার কাছ থেকে নেয়া বিচ্ছেদগুলোই আমাকে পরিপূর্ণ করে তুলেছে।
সাপ্তাহিক : এসময় কী আরেক বাউল শিল্পী শাহ আলম সরকারের লেখা গানও গাইলেন?
মমতাজ : শাহ আলম অনেক পরের শিল্পী। আমি যখন সারাদেশে পালাগানে বিশেষ পরিচিতি পেয়ে গেলাম তখন আবুল সরকারের কাছ থেকে এসে শাহ আলমরাও পালাগান শুরু করলেন। দু’জনই নতুন। শুনতাম যে, শাহ আলম নামের আরেক জন ভালো পালাগান করছেন। একদিন কাকতালীয়ভাবে শাহ আলমের সঙ্গে পালাগান পড়ে গেল। ও ছিল খুবই পাকনা এবং ঝানু। ওই দিন নতুনে নতুনে ব্যাপক জমে উঠল। শাহ আলমরা আমার সমবয়সী। তবে আকলিমা, আলেয়া আমার সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু নামে, গানে এমন হয়ে গেলাম যে সিনিয়র, জুনিয়র সবার সঙ্গেই গান করতে হতো। দর্শকরা সবার মাঝেই আমাকে খুঁজে বেড়াতেন। তবে সিনিয়রদের সঙ্গেই আমার বেশি গান হতো। আমার শুরুই তো ছিল সিনিয়রদের সঙ্গে। শাহ আলমের লেখা গান অনেক পরে গাইছি।
সাপ্তাহিক : গান শেখার বাইরে ওস্তাদগণ আপনাকে আর কীভাবে সহযোগিতা করতেন?
মমতাজ : হ্যাঁ। যেমন, রশিদ সরকার আমাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। কেউ গানের জন্য বায়না করতে এলে সরকার বলতেন, ভালো গান শুনতে চাইলে আরেকটি মেয়েকে বায়না করেন। তখন আমার নাম বলতেন। বায়নাকারীরা বলতেন, ওস্তাদ যে কী বলেন। কোথায় আপনি আর কোথায় মধু বয়াতির মেয়ে মমতাজ। তখন আবার রশিদ সরকার বলতেন, দেখুন আমি আপনাদের তথ্যের খোরাক মেটাতে পারব। তবে গানের খোরাক মমতাজই ভালো মেটাতে পারবে। আগেই বলেছি, রশিদ সরকার অনেক বেশি জানতেন। তাকে পাল্লা দিয়ে কেউ পালাগান করবে এমন সাহস কারও ছিল না। তিনি ভালো লিখতেন, সুর করতেন এবং গাইতেন। কিন্তু এরপরেও তিনি আমার গানের প্রতি দুর্বল ছিলেন। একইভাবে রাজ্জাক দেওয়ানও আমাকে সহযোগিতা করেছেন। বায়নাকারীদের বলতেন, ‘আমার লগে কারে লইবি। রশিদ সরকাররে। ও ছোঁড়া তো খালি ঝগড়া করব। তোরা ঝগড়া শুনবি নাকি গান শুনবি। গান শুনতে চাইলে আমার লগে এই মাইয়্যারে ল। তোগো ভালো লাগব। ভালো না লাগলে টাকা দিস না।’ ওস্তাদ পালায় বকাঝকা করতেন। সুর ভাঙা ভাঙা ছিল। তবে ভালো লিখতেন। ওস্তাদরা এভাবেই আমাকে এগিয়ে দিয়েছেন।
সাপ্তাহিক : আপনার পক্ষ থেকে সহযোগিতার সুযোগ আসেনি?
মমতাজ : সিনিয়র ওস্তাদদের সঙ্গে কোনো প্রোগ্রামে গেলে সেখান থেকে আরও দশ জায়গার বায়না আসত। তখন আমিও বলতাম ‘রশিদ সরকার, রাজ্জাক দেওয়ান, পরশ আলী দেওয়ান হলে আমি গান করব। সিনিয়রদের লগে নেন। আমিও পোলাপান। আবার পোলাপানদের লগে কী গান করুম।’ আমাকে নেয়ার জন্য তখন সিনিয়র ওস্তাদদের নিতে বাধ্য হতেন।
সাপ্তাহিক : আপনি যখন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী তখন কোন জায়গায়, কোন শ্রেণীর মানুষের কাছ থেকে আপনার ডাক আসল?
মমতাজ : মুরুব্বি দর্শকরা আমাকে বেশি মূল্যায়ন করত। আগেই বলেছি দয়ালের, মুর্শিদী, বিচ্ছেদ গান শুনে আসরে মুরুব্বিরা একে অপরকে ধরে কান্নাকাটির রোল ফেলে দিত। তারা হাউমাউ করে কেঁদে উঠতো। এটি আমাকে অবাক করত। তখন ভাবতাম মানুষের বিবেককে জাগাতে পেরেছি। কোনো জায়গায় বা ফকিরি বাড়িতে গান করতে গেলে পরের বছরের জন্য অ্যাডভ্যান্স টাকা দিয়ে দিত। বলত, পরের বার তোমাকে আসতেই হবে।
সাপ্তাহিক : পড়াশোনায় কখন সমাপ্তি টানলেন?
মমতাজ : এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ হয়নি। যখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি তখনই প্রতিষ্ঠিত পালাগান শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি। ষষ্ঠ শ্রেণীতে রশিদ সরকারের সঙ্গে পালাগান করছি। তাহলে বুঝতেই পারছেন কত ব্যস্ত হয়ে গেলাম। প্রতিনিয়ত পালা থাকত। টাকা পয়সা আসতে শুরু করল।
আগে তিন হাজার টাকা দিয়ে বায়না করা হতো। আর আমি শুরুই করেছি পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে। এরপর হঠাৎ করে চাহিদা বাড়িয়ে বললাম, আমাকে নিতে হলে দশ হাজার টাকা লাগবে।
সাপ্তাহিক : এই টাকা কী পুরো টিমের জন্য?
মমতাজ : হ্যাঁ, পুরো টিমের জন্যই এই টাকা।
সাপ্তাহিক : তার মানে পেশাদার হয়ে গেলেন বলেই পড়াশোনায় আর মন দিতে পারলেন না?
মমতাজ : তাই তো হলো। বাবা গান ছেড়ে দিলেন। পরিবারের অবস্থাও ভালো ছিল না। পুরো পরিবার আমার ওপর নির্ভর করতে লাগল। ধীরে ধীরে গানের জগতেই ঠাঁই মিলল।
সাপ্তাহিক : পড়াশোনা ছেড়ে গানের দলে গেলেন। কষ্ট হয়নি?
মমতাজ : সে কষ্ট ভোলার নয়। আমি তো এখনও মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি যে বইখাতা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছি। আবার কখনও কখনও স্বপ্ন দেখি যে, পরীক্ষা শুরু হবে। কিন্তু গানের আসরে আছি। বই ব্যাগে করে নিয়ে গেছি কিন্তু পড়তে পারিনি। পরীক্ষার হলে সবাই লিখতেছে। আমি পারছি না। এই স্বপ্নগুলো এখনও তাড়া করে বেড়ায়। সত্যি কথা বলতে কি, আমি স্কুলে ভালো ছাত্রী ছিলাম। একবার পড়লেই মনে থাকত। আসলে পড়ালেখা কপালে ছিল না। কী আর করা।
সাপ্তাহিক : পরীক্ষা না দিতে পারার আর কোনো কারণ?
মমতাজ : অন্য কোনো কারণ ছিল না। কেবল গানের প্রতি মনোযোগ থাকার কারণেই পড়াশোনা করতে পারেনি। পালাগান করতে গিয়ে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। ধরুন, শরিয়ত-মারফত নিয়ে আগের দিন পালাগান করতে হয়েছে। কিন্তু কোনো কারণে হয়ত প্রতিপক্ষের কোনো মারফতি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। উত্তর দিতে না পারার পর থেকেই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেত। বাড়িতে এসে পবিত্র হাদিস, কোরান নিয়ে বসে পড়তাম। কোন সূরা, কোন হাদিস থেকে প্রশ্নটি করা ছিল তা খুঁজে বের করতে অস্থির হতাম। ওই সময় বোখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, আবু দাউদ শরীফ, মেসকাত শরীফ পড়তে শুরু করলাম। গিরিশ চন্দ্র সেনের কোরানের তরজমাসহ নানা তাফসীর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলাম। পালাগানে কেউ বলবে যে, কেবল দুটি গান গাইলেই বয়াতি হওয়া যায় না আর এই কথা শুনতে আমার ভালো লাগত না। প্রশ্নের জবাব বের করার জন্যই কোরান হাদিস নিয়ে বসে যেতাম। পাঠ্যবই রেখে ধীরে ধীরে হাদিস কোরানের দিকে জোর দিতে থাকলাম।
সাপ্তাহিক : কেবল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই কোরান হাদিস পড়া? এসময় অন্য কোনো তাগিদ কাজ করেছে কীনা?
মমতাজ : তা তো অবশ্যই ছিল। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পড়াশোনা করতে গেলে তো জানাই হয়। আমি দেখেছি, সাঁইজিরা হাদিস-কোরানের মধ্য থেকে কথা বলতেন। তারা বলতেন, কোরান যত পড়বে ততো জানবে, শিখবে, নিজের মধ্যে আলো পাবে। আপনি যতবার কোরান শরীফ পড়বেন ততো জ্ঞানী হবেন। একবার, দুইবার পড়ে বুঝতে পারবেন না। অনেক জন অনেকভাবে কোরান হাদিস ব্যাখ্যা করেছেন। সেগুলোর সঙ্গে তুলনা করে নিজের উত্তর বের করা অনেক কঠিন কাজ ছিল।
সাপ্তাহিক : যেমন?
মমতাজ : কোন সূরা কখন, কীভাবে, কেন নাজিল হলো সে সম্পর্কে জানতে হতো। সাহাবীদের জীবনী, পীর-মাশায়েখদের জীবনী নিয়ে বিশদ পড়াশোনা করতে হতো। শরিয়ত-মারফত নিয়ে কথা বলতে হলে আপনি না জেনে তো বলতে পারবেন না।
সাপ্তাহিক : হাদিস কোরানে শরিয়ত-মারফতে মৌলিক কী পার্থক্য পেলেন?
মমতাজ : কোরান হাদিসের আলোকে আপনি যা করছেন অর্থাৎ যা দেখা যাচ্ছে তাই শরিয়ত। আর মারফত হচ্ছে, দু’চোখে যা দেখা যায় তারও বাইরে কিছু অনুভব করা অর্থাৎ অন্তর চক্ষু দিয়ে উপলব্দি করাই হচ্ছে মারফত বা গোপনীয় বিষয়। আল্লাহর ওলী, পীর, মাশায়েখরা তো গোপন এবাদত করেন। এ ব্যাপারে কথা বলতে হলে আপনাকে অন্তর চক্ষু দিয়ে কোরান হাদিস বিশ্লেষণ করতে হবে। স্রষ্টার ওপর আলোচনা আপনি এমনিই করতে পারবেন?
সাপ্তাহিক : ঈশ্বর বা ধর্মের প্রতি আপনার নিজের বিশ্লেষণ কী। ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন কী না?
মমতাজ : অতি কঠিন একটি বিষয়। এক কথায় বলতে গেলে খোদায়ী শক্তির ওপর বিশ্বাস তো রাখতেই হবে। এই মহাসত্ত্বাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু হঠাৎ করে ধর্ম নিয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক না। হুজুর পাক (স.) যে বিধান আমাদের জন্য রেখে গেছেন সেই বিধান অনুযায়ী চলতে পারলেই মুক্তি। এবাদত বন্দেগী করতে করতেই মানুষ কামেল হয়। সেই লেভেলে গিয়ে ধর্ম নিয়ে মন্তব্য করা যায়। যেমন, মুনসুর হেল্লাজ। তিনি এবাদত-বন্দেগী বা জানতে জানতে এমন এক পর্যায়ে গেছেন যখন তিনি নিজেকে আয়নাল হক অর্থাৎ খোদা দাবি করেছেন। সব কিছুর একটি পর্যায় লাগে। তবে ধর্ম নিয়ে অতিকথা না বলাই ভালো। ধর্মে অবশ্যই বিশ্বাস করি তবে ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাস করি না।
সাপ্তাহিক : পালাগান মানেই তর্ক-বিতর্কের খেলা। পালাগান করতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হননি?
মমতাজ : এক শ্রেণীর মানুষ তো সারা জীবনই এসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকেন। আমরা হাদিস কোরানের আলোকে যত যুক্তিতর্কই উপস্থাপন করি না কেন তারা কোনোদিনই তা বরদাস্ত করেনি এবং করবেনও না। ওই সময় তো আরও জটিল অবস্থা ছিল। পালাগান মূলত ফকিরি বাড়ি, মাজারে হয়ে থাকে। মৌলভী, মুন্সিরা সাধারণত এসব পছন্দ করেন না। এ কারণে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। অনেক সতর্ক থেকে কথা বলতে হয়েছে। তবে আমি দেখেছি, যারা পছন্দ করেন না তারা বেশি পড়াশোনা করেন বলেও মনে হয়নি।
সাপ্তাহিক : কেমন লাগত সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা?
মমতাজ : যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারাই তো আনন্দের। অনেক ভালো লাগত। বড় বড় মাওলানার সঙ্গে বাহাস করা অনেক বড় বিষয়। দেখেছি, ওস্তাদরা দিনের পর দিন কোরান, হাদিস ঘেঁটে মাওলানাদের প্রশ্নের জবাব দিতেন। প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে অনেক জানা হয়ে যেত।
সাপ্তাহিক : সুফিবাদের সঙ্গে বাউল জীবনের সম্পর্ক কেমন দেখতে পেলেন?
মমতাজ : সুফিবাদে হিংসা, বিদ্বেষ যেমন থাকে না তেমনি বাউলদের জীবনেও হিংসার কোনো ঠাঁই নেই। আমার দৃষ্টিতে দুটো একই। বিশেষ কোনো তফাৎ আছে বলে মনে হয় না। সুফিরা স্রষ্টার সৃষ্টিকে ভালোবাসতে বলেন। বাউলরা তাই করেন। বাউলদের গানে মানবমুক্তির কথাই বলা হয়। ইসলামের মৌলিক কথাও তাই। মানুষের কল্যাণই মানুষের আসল ধর্ম।
সাপ্তাহিক : আবারও একটু শৈশবে ফিরি? প্রথম ইসলাম সরকারের অনুমতি নিয়ে গান করলেন। পরবর্তীতে তার সঙ্গে গান করা হয়নি?
মমতাজ : আসলে ওইদিনই তার সঙ্গে গান করা। এরপরে তো তার পরামর্শে ওস্তাদ মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের কাছে গান শিখলাম। ইসলাম সরকার শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। মাথায় টিউমারের মতো কিছু একটা ছিল। কিন্তু ডাক্তারের কাছে তাকে চিকিৎসা নিতে দেখিনি। মাথার ওই সমস্যার কারণেই অল্প বয়সে তিনি মারা যান। তবে ওস্তাদ রাজ্জাক দেওয়ানের সঙ্গে তিনি অনেক গান করতেন।
সাপ্তাহিক : ওস্তাদ রাজ্জাক দেওয়ানের কাছে বিশেষ করে কোন গান শিখলেন?
মমতাজ : তার কাছে মূলত পালাগান শিখতাম। আর বিচ্ছেদ তো আমার বাবার কাছেই শিখেছি।
সাপ্তাহিক : রশিদ সরকার?
মমতাজ : রশিদ সরকার আমাকে নিয়ে মঞ্চে গান করতেন। শেখা আমার রাজ্জাক দেওয়ানের কাছেই। রশিদ সরকার অনেক বড় মাপের শিল্পী ছিলেন। তার সঙ্গে গান করে ব্যাপক প্রচার হতো।