সালমা ইউসুফ। শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোভিত্তিক একজন বিনিয়োগ গবেষক। তিন বছরের এক ছেলেসন্তান ও কাপড়চোপড়ে ঠাসা একটি সুটকেসকে সঙ্গী করে শ্রীলংকা ছেড়েছেন। পাড়ি দিয়েছেন দুবাইয়ে। সেখানে নতুন জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখছেন। এর কারণ, দেশের অর্থনীতিতে বিশৃংখলা। জুনে তিনি দেশ ছেড়েছেন। দুবাইয়ে তার স্বামীর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। সেখানে তার স্বামী একজন সেলস ও মার্কেটিং ডিরেক্টর হিসেবে একটি কাজ নিশ্চিত করেছেন। এ খবর দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে- সাত দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছে শ্রীলংকা।
এর ফলে হাজার হাজার পেশাদার দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন। সালমা তাদের একজন। কি পরিমাণ মানুষ শ্রীলংকা ছেড়েছেন তার প্রকৃত কোনো সংখ্যা নেই। কিন্তু প্রাথমিক ভিত্তিতে এবং ব্যবসায়ী নেতাদের দেয়া তথ্যে যে পরিমাণ মানুষকে দেশ ছাড়তে দেখা যাচ্ছে তা দেশটির ক্ষতির জন্য যথেষ্ট। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হলেও এই ব্রেইন ড্রেইন থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
সালমা ইউসুফ তাদের অন্যতম। তিনি বা তারা জানেন না আর কখনো দেশে ফিরবেন কিনা। ৩০ বছর বয়সী সালমা বলেছেন, দেশ ছাড়ার বিষয়ে আমার স্বামীকে রাজি করাতে অনেক সময় লেগেছে। কারণ সে চেয়েছে দেশটাতে থাকতে এবং দেশকে ভালবাসতে। কিন্তু মার্চে শ্রীলংকায় অর্থনৈতিক সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করে। রাজনৈতিক প্রতিবাদ সমাবেশে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দেশ। এতে প্রতিদিন জীবন চালানো কঠিন হয়ে ওঠে। সালমা বলেন, এ সময় আমরা অনুধাবন করতে পারি, যদি শিগগিরই দেশ ছেড়ে না যাই তাহলে ভয়াবহ এক কঠিন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
তিউনিশিয়া থেকে হাইতি। হাইতি থেকে পাকিস্তান- সর্বত্র আকাশচুম্বী মুদ্রাস্ফীতি। এর ফলে বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যে নিপতিত হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে প্রতিবাদ বিক্ষোভ, অসন্তোষ। এমনকি ধনী দেশগুলো বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। তারা কৃচ্ছ্রতাসাধন করছে। মার্চ থেকে শ্রীলংকানরা ভয়াবহ জ্বালানি এবং রান্নার গ্যাসের সংকটে ভুগতে শুরু করে। দ্রæত সেখানে ফুরিয়ে যেতে থাকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ওষুধ, খাদ্য এমনকি গুঁড়ো দুধের সরবরাহ ফুরিয়ে যেতে থাকে। বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণে অসন্তোষ ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে।
জুলাই থেকে স্বাস্থ্যসেবা এবং কৃষি কাজের মতো অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিসের জন্য শুধু জ্বালানি দেয়া হয়। খাবারের মূল্য বাড়তেই থাকে। জুলাইয়ে বছরের সঙ্গে বছরের তুলনায় খাদ্যে মুল্যস্ফীতি বেড়ে যায় শতকরা কমপক্ষে ৯০ ভাগ। অর্থাৎ খাবারের দাম প্রায় দ্বিগুন হয়ে যায়। ভোক্তাদের মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায় শতকরা ৬০.৮ ভাগ। এমন এক কঠিন অবস্থায় পড়ে দেশ ছেড়ে যাওয়া অভিবাসীরা বলেন, তারা সরকারের ওপর থেকে আস্থা হারিয়েছেন। তাদের আশঙ্কা ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদ নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে। তাতে মধ্যবিত্তরাও দলবদ্ধ হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হবেন।
বর্তমানে উন্নত জীবনের আশায় যারা দেশ ছাড়ছেন তার মধ্যে বেশির ভাগই দক্ষ পেশাদার। এর মধ্যে আছেন ডাক্তার, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী। এর ফলে মেধাশূন্য হয়ে যাচ্ছে শ্রীলংকা। দুই কোটি ২০ লাখ মানুষের দেশটি এর ফলে নতুন পৃথিবীতে দক্ষতায় উদ্বেগজনকভাবে পিছিয়ে পড়বে। ইনস্টিটিউট অব পলিসি স্টাডিজের মাইগ্রেশন অ্যান্ড আরবানাইজেশন পলিসি রিসার্সের প্রধান ড. বিলেশা বীরারত্নে বলেন, দক্ষ জনশক্তির দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এক উদ্বেগজনক প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে।
২০২০ এবং ২০২১ সালের প্রথম ৬ মাসে যথাক্রমে ৪০,৫৮১ এবং ৩০,৭৯৭ জন মানুষ অভিবাসী হয়েছেন। কিন্তু ২০২২ সালের প্রথম ৬ মাসে নিবন্ধিত এমন সংখ্যা প্রায় ১,১৩,১৪০। এ তথ্য বিলেশা বীরারত্নের। তবে এ বিষয়ে সরকারের কাছে কোনো তথ্য নেই। এ বিষয়ে বার বার অনুরোধ করা সত্তে¡ও তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে অভিবাসন বিষয়ক অফিস। কিন্তু পাসপোর্ট অফিসের বাইরে এখন দীর্ঘ লাইন দৃশ্যমান।
এ বছরের প্রথম ৫ মাসে শ্রীলংকা ইস্যু করেছে ২,৮৮,৬৪৫টি পাসপোর্ট। আগের বছরে একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ৯১,৩৩১টি। এ তথ্য সরকারি।