সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মানুষ
কেনার চেয়ে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বেশি ভাঙানো হয়েছে :: বাড়ছে সরকারের ব্যাংক ঋণ
নিরাপদ বিনিয়োগের উৎস সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মানুষ। দীর্ঘদিন ধরেই সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এতে প্রতি মাসেই নিট বিনিয়োগের পরিমাণ ঋণাত্মক ধারায় নেমে যাচ্ছে। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসেও সঞ্চয়পত্র বিক্রির চেয়ে প্রায় ৪৪০ কোটি টাকা ভাঙানো বেশি হয়েছে। সব মিলে চলতি অর্থবছরের আট মাসে এ খাতে বিক্রির চেয়ে ভাঙানোর পরিমাণ বেশি ছিল প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। ফলে এ খাত থেকে সরকার এখন কোনো ঋণই পাচ্ছে না, উল্টো সঞ্চয়পত্রের আসল ও সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এজন্য ব্যাংক ঋণ নিতে হচ্ছে।
নিম্ন মধ্যবিত্ত, নারী, প্রতিবন্ধী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন প্রকল্প চালু রয়েছে। সামাজিক সুরক্ষায় সঞ্চয়পত্রে তুলনামূলক বেশি মুনাফা দেয় সরকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, পণ্য ও সেবার দামের ঊর্ধ্বগতিতে জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে, যার প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়ে। গত বুধবার গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং-সানেমের প্রকাশিত জরিপে বলা হয়, মূল্যস্ফীতির চাপে ৩৫ শতাংশ পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে আর সঞ্চয়বিমুখ হয়েছে ৫৫ শতাংশ পরিবার।
বাজেটে চলতি অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এটি গত অর্থবছরের চেয়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বেশি। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৭ হাজার ১০৫ কোটি টাকা এবং ভাঙানো বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৭ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা। সব মিলে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় ৫৫ হাজার ৮৬২ কোটি টাকার এবং ভাঙানো হয় ৫৯ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। এর বাইরে মুনাফা পরিশোধ করা হয়েছে ৩১ হাজার ১০৪ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন পর্যালোচনা আরও দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর থেকে সঞ্চয়পত্র বিক্রির চেয়ে বেশি ভাঙানো হচ্ছে। তবে জানুয়ারিতে নিট বিক্রি কিছুটা ইতিবাচক ধরায় ফিরলেও ফেব্রুয়ারিতে
আবার নেতিবাচক ধারায় নেমেছে। এর মধ্যে গত ডিসেম্বরে নিট বিক্রির পরিমাণ ঋণাত্মক ধারায় ছিল প্রায় ১ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা, নভেম্বরে ৯৭৮ কোটি ৩৯ লাখ, অক্টোবরে ৯৬৩ কোটি ১৬ লাখ ও সেপ্টেম্বরে প্রায় ৭৩ কোটি টাকা ঋণাত্মক ধারায় ছিল। গত অর্থবছরেও সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সরকার নিট ঋণ পেয়েছিল ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর আমাদের সময়কে বলেন, তিনটি কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। প্রথম কারণ হলোÑ এখন মানুষের হাতে টাকা কম। ফলে সংসার চালাতে সঞ্চয়ে হাত দিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগে আয়কর রিটার্নের সিøপ জমা করতে হচ্ছে। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের অনেকেই এ ঝামেলায় যেতে চান না। তৃতীয়ত বিভিন্ন প্রকার সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়েছে। ফলে যাদের আগে থেকে বেশি বিনিয়োগ ছিল, তারা মেয়াদপূর্তিতে নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। এ ছাড়া প্রবাসী বন্ডে বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা ও এনআইডি শর্তের কারণে সেখানে কম বিনিয়োগ হয়েছে। যদিও সম্প্রতি প্রবাসী বন্ডের বিনিয়োগ সীমা ও এনআইডি শর্ত প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
বাড়ছে ব্যাংক ঋণ : সঞ্চয়পত্র থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া বাড়িয়েছে সরকার। তবে এবার বাংক ঋণের পুরোটাই জোগান দিতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। কারণ তারল্যে টান পড়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারকে ঋণ দিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৪৫ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ না নিয়ে উল্টো আগের নেওয়া ঋণের প্রায় ৪ হাজার ৪৫ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। ফলে সরকারের নিট ব্যাংক ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা।