নানা কড়াকড়িতে নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমে অর্ধেকে নেমেছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বলছে- গত অর্থবছরে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৯ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬২ শতাংশ। তার পরও চলতি অর্থবছরেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে বেশি ঋণ পাওয়ার আশা করছে সরকার।
নিম্ন মধ্যবিত্ত, সীমিত আয়ের মানুষ, মহিলা, প্রতিবন্ধী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন প্রকল্প চালু রয়েছে। সামাজিক সুরক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে সঞ্চয়পত্রে তুলনামূলক বেশি মুনাফা (সুদ) দেয় সরকার। কিন্তু গত বছরে সঞ্চয়পত্র কেনায় নানা কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। সবশেষ পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে আয়কর রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এর আগে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার ওপরে বিনিয়োগের মুনাফার হার ২ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে। তবে ১৫ লাখ টাকার নিচে মুনাফার হার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া চলতি বাজেটে দুই লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে হলে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ছাড়া পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র শুধু সঞ্চয় অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এর আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র এবং পরিবার সঞ্চয়পত্র- এই তিনটি স্কিমের বিপরীতে সমন্বিত বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা একক নামে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা এবং যৌথ নামে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। আগে একক নামে সর্বোচ্চ এক কোটি ৫৫ লাখ এবং যৌথ নামে দুই কোটি ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে পারতেন গ্রাহকরা। এসব কারণে অনেকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমিয়েছেন।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মূল বা আসল পরিশোধের পর যা থাকে তা নিট বিক্রি হিসেবে পরিগণিত হয়। এই নিট বিক্রিকে সরকারের ঋণ বলা হয়। প্রতি অর্থবছরের বাজেটে নিট বিক্রি হিসাবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। ২০২০-২১ অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের প্রাপ্ত তথ্য বলছে, সর্বশেষ জুন নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। তার আগের মাসে নিট বিক্রি হয়েছিল মাত্র ৬৩৮ কোটি টাকা। সব মিলে গত অর্থবছরের নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের চেয়ে অর্ধেকেরও কম।
অথচ করোনার পরও ২০২০-২১ অর্থবছরে তার আগের অর্থবছরের চেয়ে তিন গুণ বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে সরকার সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। এটি তার আগের অর্থবছরে ছিল মাত্র ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা।
এদিকে নানা কড়াকড়িতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমলেও চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ খাত থেকে আগের চেয়ে বেশি ঋণ পাওয়ার আশা করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবার বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এটি গত অর্থবছরের চেয়ে তিন হাজার কোটি টাকা বেশি।
এদিকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় ব্যাংকঋণ নির্ভরতা বেড়েছে সরকারের। গত অর্থবছরে সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নিট ঋণ নিয়েছে প্রায় ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছে ৩১ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নেওয়া হয়েছে ৪১ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছরের সরকার বড় অঙ্কের ব্যাংকঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা দিয়েও শেষ পর্যন্ত অনেক কম ঋণ নিয়েছিল। ওই অর্থবছরের পুরো সময়ে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে নিট ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ছিল মাত্র ২৪ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। তবে তার আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে রেকর্ড ৭২ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা ঋণ নেয় সরকার।