সাথীর জন্য আমার খুব দুঃখ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, তার মতো হতভাগী আর কেউ নেই। স্কুলে তার পরীক্ষার ফি বাকি ছিল মাত্র ৮০ টাকা। আর এ জন্য সাথী আক্তারকে শাস্তি হিসেবে রোদের মধ্যে এক ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। সাথী মেনে নিতে পারেনি এই অপমান। তাই গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে সে। আজ মঙ্গলবার সাথীর আত্মহত্যার এই খবর প্রকাশিত হয়। সাথীর মতো আমরাও মেনে নিতে পারছি না তার এই অপমান। মেনে নিতে পারছি না তার এমন করুণ মৃত্যু। লজ্জা ও অপমানবোধ কতটা তীব্র হলে আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে এইটুকুন একটি মেয়ে?
এইটুকুন মেয়েই তো। মাত্র ১৪ বছর বয়স হয়েছিল সাথীর। পড়ালেখা করত চাঁদপুরের সদর উপজেলার বাগাদী ইউনিয়নের বাগাদী গণি উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে। স্কুলের মাসিক বেতন, পরীক্ষার ফিসহ ছিল ৪০০ টাকা। এর মধ্যে ৩২০ টাকা পরিশোধ করা হয়। বাকি ৮০ টাকা না দেওয়ায় গত রোববার বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন সাথীসহ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে রোদের মধ্যে এক ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখেন। পরদিন সকালে সে পরীক্ষার ফির বকেয়া ৮০ টাকা মায়ের কাছে চাইলে তিনি তা জোগাড় করতে বাড়ির অন্য মানুষের কাছে যান। এরই ফাঁকে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে সাথী। টাকা ছাড়া স্কুলে গেলে আবারও একইভাবে অপমানিত হতে হবে, হয়তো এই ভেবেই সে আত্মহত্যা করেছে।
সাথীর বাবা দেলোয়ার হোসেন পেশায় দিনমজুর। হয়তো ঠিক সময়ে মেয়ের স্কুলের বেতন ও পরীক্ষার ফির টাকা জোগাড় করতে পারেননি। ৮০ টাকা কম পড়ে গিয়েছিল। আর তাতেই সহকারী প্রধান শিক্ষকের রাগ হয়ে গেল। রাগের চোটে রোদে এক ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখলেন সাথীকে। সঙ্গে আরও কয়েকজনকে। তারাও সাথীর মতো ঠিক সময়ে বেতন ও পরীক্ষার ফি জমা দিতে পারেনি।
এ কেমন দেশে বাস করছি আমরা! মাত্র কয়েকটি টাকার জন্য একজন শিক্ষক কী করে শিক্ষার্থীদের এমন শাস্তি দিতে পারেন? তিনি তো আসলে শিক্ষক নন, শিক্ষক নামের কলঙ্ক। কোনো শিক্ষার্থী সময়মতো বেতন বা পরীক্ষার ফি জমা না দিলে সে জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ তার অভিভাবককে নোটিশ দিতে পারে বা ডেকে নিয়ে বলতে পারে। কোনো শিক্ষার্থীকে শাস্তি দিতে পারে না।
গত এপ্রিল মাসে সাভার পৌর এলাকায় একইভাবে শিক্ষকের অপমান সইতে না পেরে দশম শ্রেণির এক ছাত্রী আত্মহত্যা করে। সাভার পৌর এলাকার সবুজবাগ মহল্লার চাইল্ড হেভেন স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী সোনালী আক্তার তিন মাসের বকেয়া বেতন ১ হাজার ৮০০ টাকার মধ্যে ৫০০ দিয়ে প্রথম সাময়িক পরীক্ষার বসার অনুমতি চাইলে প্রধান শিক্ষক মো. কাবুল মিয়া ওই ছাত্রীকে গালাগাল করে বিদ্যালয় থেকে বের করে দেন। সোনিয়াও মেনে নিতে পারেনি তার এই অপমান। দুঃখ, ক্ষোভ ও লজ্জায় বাসার সিলিং ফ্যানে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে সে।
এ রকম আরও অনেক ঘটনা অতীতে ঘটেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ রকম কি চলতেই থাকবে? এর কি কোনো প্রতিকার নেই? আর কত সাথী, আর কত সোনিয়া এভাবে প্রাণ দেবে?
শিক্ষকতা হচ্ছে একটি মহান পেশা। শিক্ষকের অবস্থান সমাজের অনেক উঁচুতে। কিন্তু কিছু শিক্ষকের কর্মকাণ্ডে তাঁদের সে মর্যাদা ধুলায় লুটাচ্ছে। ওই শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের মারধর করেন, গালাগাল করেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধ করতে সরকার ২০১০ সালের ৯ আগস্ট একটি পরিপত্র জারি করে। ওই পরিপত্রে দেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কিছু শিক্ষক যে এই নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা করছেন না, তা বোঝাই যাচ্ছে। মুষ্টিমেয় যেসব শিক্ষক কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এমন নিষ্ঠুর আচরণ করেন—আসুন, আমরা এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই।
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক (source: prothom-alo.com)